সাপ্লাই চেইন ব্যবস্থাপনার ধাপসমূহ
জাহাঙ্গীর আলম শোভন
সাপ্লাই চেইন ব্যববস্থাপনা মূলত পন্য সংগ্রহ থেকে ভোক্তার নিকট পৌছে দেয়া পর্যন্ত কতগুলো পক্রিয়ার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়ে থাকে। এই পক্রিয়ার অন্তভ’ক্ত অনেকগুলো কাজ রয়েছে। সবগুলো কাজ সূচারুরুপে সম্পন্ন করলেই কেবল সঠিকভাবে সাপ্লাই চেইন পরিচালনা করা যায়। কেউ ঠিকভাবে পন্য সংগ্রহ ও সরবরাহ করলো কিন্তু সময়মত  তা করতে পারলোনা, আবার সময় মতই করলো কিন্তু পন্যের কোয়ালিটি ঠিক রাখতে পারেনি আবার সবই ঠিক আছে কিন্তু বেশী অর্থ খরচ করেছে অথবা গ্রাহকের কাছ থেকে বেশী চার্জ নিচ্ছে তাহলে সেটাও সফল সাপ্লাই চেইন নয়। সফল সাপ্লাই চেইন হচ্ছে প্রচলিত ব্যবস্থার মধ্যদিয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি সঠিক সময়ে সঠিক উপায়ে সঠিক স্থানে সঠিক দামে সঠিক পন্যটি পৌছে দিলেন। তো একাজটি করার জন্য চাই কয়েকটি ধাপ অতিক্রম করে সফল হওয়া। অবশ্য কেউ যদি বিকল্প পদ্ধতি ব্যবহার করে সময় ও অর্থ অপচয় না করে সফলভাবে নতুন চেইন চালু করতে পারেন তিনি অবশ্যই অন্যদের চেয়ে এগিয়ে থাকবেন।
ডিমান্ড নোট তৈরী:
প্রথম একজন সাপ্লাই চেইন ম্যানেজার তার কি কি পন্য দরকার সেসব বিষয়ে একটি তালিকা তৈরী করবেন। কোন পন্য কোন টাইপের হবে, পরিমাণ কি হবে, সাইজ ও মান ইত্যাদি ঠিক করে নেবেন।
পন্যের তথ্য সংগ্রহ:
এররপর তিনি জেনে নেবেন কোন পন্য কোন এলাকায় পাওয়া যায়? কোন এলাকার পন্যের কোয়ালিটি কেমন? কোন এলাকায় দাম কেমন? শিপিং প্রসেস কি? খরচ কেমন? সময় কেমন লাগে? পথে কোন সমস্যা হয় কিনা? পন্য সংগ্রহে কি কি সুবিধা অসুবিধা রয়েছে? প্রচলিত পদ্ধতি কি? প্যাকিং এর পক্রিয়া ও খরচ ইত্যাদি যাবতীয় বিষয় না জানলে তিনি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হবেন।  তার কাজের প্রতিটি ধাপে তিনি সমস্যার সম্মুখিন হবেন।
যাচাই:
এবার তিনি তার কাছে থাকা তথ্য সমূহ যাচাই করে নেবেন। প্রয়োজনে কোথাও প্রতিনিধি পাঠাবেন, খবর নেবেন প্রয়োজনে নিজেও সফর করতে পারেন। এভাবে তিনি প্রতিটি বিষয় নিশ্চিন্ত হয়ে নেবেন। নিজেদের প্রস্তুতকৃত তালিকাটিও আরো যাচাই করে নেবেন যে সঠিক তালিকা হয়েছে কিনা বা বাস্তবতার আলোকে তাতে কোন পরিবর্তন এর পয়োজন আছে কিনা?
পন্য শ্রেণীদ্ধকরণ ও অগ্রাধিকার তালিকাকরণ ও বাজেট তৈরী করণ:
পন্য সংগ্রহের পূর্বেই  একবার শ্রেণীকরণ করে নিতে হবে। এই শ্রেণীবদ্ধকরণ কয়েকরকম হতে পারে। যেমন:
পন্যভিত্তিক: ভিন্ন ভিন্ন পন্যের ভিন্ন ভিন্ন তালিকা
এলাকাভিত্তিক: কোন পন্য কোন এলাকা থেকে সংগ্রহ করা হবে, সে অনুযায়ী
ভেন্ডার ভিত্তিক:  আপনার যদি তালিকাভুক্ত সরবরাহকারী থাকে অথবা না থাকে আপনি তৃতীয় পক্ষের কাছ থেকে পন্য সংগ্রহ করলে তার একটি ব্রিফ থাকা দরকার যে কোন এজন্ট কোন পন্য আপনাকে দিবে বা দিতে পারে।
বিভাগ ভিত্তিক: আপনার কোম্পানীতে অনেকগুলো বিভাগ থাকতে পারে কোন পন্য কোন বিভাগের জন্য সে তথ্যটিও আপনার কাছে সঠিকভাবে থাকা দরকার।
মূল্যভিত্তিক: দাম অনুসারে আপনি পন্যগুলোকে আলাদা তালিকায় সাজাতে পারেন। যাতে করে আপনার বাজেট তৈরীর কাজ সহজ হয় এবং লেনদেনের সময় সতর্ক হতে পারেন।
অগ্রাধিকার: এটি সবচে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কোন পন্যটি আগে দরকার বা না হলেই নয় এই ধারণাাও আপনার থাকতে হবে।
বাজেট: এ পর্যায়ে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়ে গেলে যাবতীয় খরচ বিশ্লেষন কওে আপনাকে একচি সাম্ভাব্য ব্যয়ের চার্ট তৈরী করতে হবে।
পন্যক্রয় বা সংগ্রহ:  
এবার আপনার নির্ধারিত পরিকল্পনা অনুযায়ী আপনি পন্য সংগ্রহ বা ক্রয় করবেন। ক্রয় করার সময় আবারো আপনাকে দাম, কোয়ালিটি, পরিমাণ, মেয়াদ, সাইজ ও প্যাকিং ইত্যাদি বিষয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে নিতে হবে। এক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত পার্টি হলে আপনি তার উপর ভরসা করতে পারেন। অথবা নিজরা চেক করে নিতে পারেন। অথবা শর্তসাপেক্ষে পন্য ক্রয় করতে পারেন।
প্যাকিং ও পরিবহন:  কোন পন্যের কি ধরনের প্যাকিং হবে এবং তার খরচ ও স্থায়ীত্ব সম্পর্কে আপনার ধারণা থাকা জরুরী। একবার সেটা সঠিকভাবে মানা হচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত হয়ে নিতে পারেন। পরিবহণ খরচ ও পরিবহন পদ্ধতি সম্পর্কে নখদর্পনে রাখুন। পরিবহন পথের সুবিধা অসুবিধাও জেনে রাখুন। পরিবহনে পন্যের কোন ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা আছে কিনা থাকলে তা কিপরিমাণ তাও আপনার জানা থাকা লাগবে। পন্য নামানো উঠানো বা লোড আনলোড সম্পর্কেও জেনে রাখা ভালো।
পন্য সজ্জিতকরণ ও গুদামজাত করণ:
পন্যগুলো আপনার দায়িত্ব আসার পর এগুলোকে সঠিকভাবে গুদামজাত করতে হবে। গুদামজাত করার সময় যেকটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে। সেগুলো হলো?
১. গুদামঘরের তাপমাত্রা সঠিক আছে কিনা? কোথাও পানি পড়ার আশংকা রয়েছে কিনা? কোন কারণে পানি আসলে তা নিষ্কাসন ও ঢালিয়ে যাবার সুবিধা রয়েছে কিনা?
২.  আগুন লাগতে পারে এধরেনের জিনিস থেকে গুদামঘরকে দূরে রাখতে হবে। ধুমপায়ী স্টোরকিপার নিয়োগ দেয়া যাবেনা। কোন কারণে আগুন লাগলে তার প্রতিরোধ ব্যবস্থা থাকতে হবে।
৩. গুদামঘরের দেয়াল ও ছাদ মজবুত আছে কিনা পরীক্ষা করে নিন। প্রয়োজনীয় আলো বাতাসের ব্যবস্থা নিন। কোল্ড স্টোর হলে কারিগরি ও বৈদ্যুতিক ব্যাপারে সতর্ক থাকুন।
৪. পন্য সাজিয়ে রাখার সময় যেগুলো আগে দরকার হবে সেগুলো সামনে অথবা উপরে রাখুন।
৫. যে পন্যগুলো চাপ সহনশীল নয় গেুলো নিচে রাখবেন না।
৬. ভারী পন্য হলে মানুষের পরিবর্তে টেকনোলজি ব্যবহার করুন। শ্রমিক  দ্বারা করালে এক সাথে সব সময় দুই এর অধিক শ্রমিক রাখুন।
৭. পন্য রাখার সময় দুটি সারির মাঝখানে এমনভাবে ফাঁক রাখুন যাতে সেখানে দিয়ে পন্যসহ মানুষ যাতায়াত করতে পারে।
৮. পন্য এমনভাবে উপরের দিকে সাজাবেন যাতে পড়ে না যায়।
৯. ইঁদুর বিড়াল ঢুকতে পারে এ ধরনের ব্যবস্থা যেন না থাকে।
১০. স্টক হিসাব রাখার জন্য একটি ভালো ব্যবস্থা রাখতে পারেন। পয়োজনে সফটওয়ার ব্যবহার করতে পারেন।
১১. বন্যার সময় পানি উঠবেনা, বর্ষায় পানি জমবেনা, ঝড়ে উড়ে যাবেনা এমন করে বানাতে হবে গুদামঘরটি।
১২. ২/১ দিন পর পর ভিতরে সামনে পেছনে চেক করতে হবে।
১৩. যদি খুব রুলাবাণি জমে সেজন্য মোছা বা হালকা ঢাকনি ব্যবহার করতে হবে। পলি বা কাপড়ের।
১৪. পাশ্ববর্তী কোন ঘরে কেমিক্যাল বা বিপদজনক কোনকিছুর স্টোর বা ওয়ারহাউজ যেন না থাকেভ
১৫. যেকোন ব্যক্তি যেকোন সময় স্টোওে ডুকতে পারবেনা। এ অধিকার সীমিত তরুন। প্রয়োজনে কারা কখন যাচ্ছে সে তথ্য সংরক্ষণ করুন।
১৬. বড়ো ধরনের ব্যবসা হলে বীমা কওে রাখুন।
১৭. হাতের কাছে হোস পাইপ ও অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা রাখুন রাখুন একটি নিরাপত্তা দরজাও।
১৮. স্টোর কিপার ও সংশ্লিস্টদের ফায়ার সার্ভিস থেকে অগ্নি নির্বাপন বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করুন।
১৯. স্টোর কিপার ও সংশ্লিস্টদেও কাছে থানা, ফায়ার সার্ভিস সহ প্রয়োজনীয় ফোন নাম্বার ও ফোন করার সুবিধা রাখুন।
২০. জরুরী বিপদে সংকেত দেয়ার জন্য ঘন্টা বা হুইসেল ব্যবস্থা রাখুন।
২১. মালপত্র চুরি ঠেকানোর জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলুন।
২২. ভেজা মাল, শুকনা মাল, রঙীন মাল, সাদাকালো মাল, কুচি মাল, ধুলীয় মাল আলাদা রাখুন।
২৩. দাহ্য পদার্থ ও অন্যান্য স্পর্শকাতর পন্যের ব্যাপারে সর্তক থাকুন।
২৪. কোন ছোটো খাটো ঘটনা ঘটলে থানায় ডায়রী করতে ভুলবেন না। এটা পরে কাজে লাগবে।
২৫. গুদামের আসে পাশে সন্তেজনক কোনকিছু দেখলে ব্যবস্থা নিন।
২৬. সম্ভব হলে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগান।
২৭. কয়েকদিন পর পর চেক করে প্রয়োজনীয় সংস্কার করে নিন।

মাননিয়ন্ত্রন:
মান নিয়ন্ত্রণ এর জন্য কঠোর হতে হবে। প্রতিটি ধাপে ধাপে চেক করে দেখতে হবে। পন্যের কোন ক্ষতি হলো কিনা। প্রয়োজনে কোয়ালিটি কন্ট্রোলার নিয়োগ দেয়া যেতে পারে। মান অনুসারে পন্যের গ্রেডেশান করে আলাদাভাবে রাখা যেতে পারে।
পন্য সরবরাহ:
পন্য কাস্টমারের নিকট নিকট সরবরাহের সময় মজবুত সুন্দর ও মানসম্পন্ন প্যাকিং ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
যথাসময়ে যথাস্থানে প্রেরনের জন্য যন্তশীল পরিবহণ ব্যবস্থার কথা ভাবতে হবে।
সরবরাহকারীর আচার ব্যবহার ভদ্র, ন¤্র ,স্মার্ট ও সহনশীল হওয়া চাই।
shutterstock_112218428

বিক্রয়োত্তর সেবা

আধুনিক যুগে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিও সাপ্লাই চেইন ব্যবস্থার অর্šÍভ’ক্ত।আপনি সবকিছু ঠিক রেখেও প্রতিশ্রুতি মোতাবেক বিক্রয়োত্তর সেবা দিতে না পারলে সব দক্ষতা একেবারে জলে ভেসে যাবে। এজন্য বিক্রয়োত্তর সেবার ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে।
১. প্রথমত আপনি এমনভাবে পোডাক্টস ডিজাইন করবেন। যেন বিক্রয়োত্তর সেবা দিতে না হয়। তাহলে গ্রাহক আরো বেশী খুশি হবে যদি বিক্রয়ের পরও তার আপনাকে ফোন করা না লাগে।
২. বিক্রয়োত্তর সেবার ক্ষেত্রে একটা সেশন ফ্রি থাকে। সেটা ৩/৬ মাস হতে পারে।
৩, ফ্রি হোক আর সার্ভিস চার্জ হোক। ফোন করা মাত্রই কাস্টমারের সাথে পজেটিভলি ডিল করতে হবে।
৪. যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব সমস্যার সমাধান করতে হবে।
৫. চেষ্টা করতে হবে সমস্যাটা বুঝে নিয়ে একবারেই সমাধান করার।
৬. যিনি সার্ভিস দিতে যাবেন, তিনি কাস্টমারের সাথে ন¤্র ও বিনয়ী ব্যবহার করবেন।
৭. সার্ভিসটা এমনভাবে দেবেন যেন দ্বিতীয়বার কোন সমস্যা নয়।
৮. যদি ক্ষয়ক্ষতি বেশী হয় পন্যটি রিপ্লেস করা উত্তম, যদি সম্ভব হয়।
৯. বিক্রয়ের সময় কাস্টমারকে সার্ভিসের শর্তগুলো বুঝিয়ে বলতে হবে। হাজার বার লেখা থাকলেও।
১০. বিক্রয়োত্তর সেবার ক্ষেত্রেও মান, সময়, যুক্তিসঙ্গত দাম এ বিষয়গুলো প্রযোজ্য হবে।
সংশ্লিষ্ট বিষয়ে রিপোর্ট তৈরী:
উপরের কার্যাবলীর আলোকে একজন সাপ্লাইচেইন ম্যানেজার নিজের সফলতা দক্ষতা ও ব্যর্থতার একটি পরিসংখ্যান তৈরী করবেন। সফলতা ও ব্যর্থতার হার বের করবেন। সেটা ফলাফল বিশ্লেষন করবেন। সফলতার কারণগুলো বের করে এ বিষয়ে আরো আত্মবিশাসী হবেন। ব্যর্থতার কারণগুলো খুজে নিয়ে তার সমাধান বের করবেন এবং পরের বছর সফলতার হার বৃদ্ধি করে  সাফল্যেও এগিয়ে যাবেন। এটাই পেশাদারিত্বের লক্ষণ।

10,938 total views, 2 views today

Comments

comments

Your email address will not be published.