সাপ্লাই চেইন এর গোড়ার কথা বা সরবরাহ শেকলের শুরুর কথা
জাহাঙ্গীর আলম শোভন

সাপ্লাই চেইন বা সরবরাহ শেকল পৃথিবীর আদিমতম পেশার একটি। যদিও একাডেমিক বিষয় হিসেবে এটি একেবারেই নতুন। গত শতাব্দীর মাঝামাািঝতে সাপ্লাই চেইন একটি সাবজেক্ট হিসেবে পাঠদান শুরু হয়। আধুনিক বিশ্বের অব্যাহত ব্যবসা বানিজ্যের বিস্তৃতি ও প্রয়োজনীয়তার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এটি পাঠন ও পঠন এর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। কিন্তু একটি কর্ম হিসেবে চাহিদা ও যোগান যতদিনের পুরনো ঠিক তেমনি পন্য সংগ্রহ ও সরবরাহ কার্যক্রম হিসেবে সরবরাহ শেকল ঠিক ততদিনের পুরেনো।

আদিম মানুষের গুহাজীবন থেকেই এর সূচনা, শিকারী মানূষেরা তাদের প্রয়োজনের তাগিদে বনের পশুর অবস্থান শনাক্ত করে তা শিকার করতো। উদ্বৃত্ত খাদ্য সংগ্রহ করতো এবং গোষ্টিগতভাবে তা ভোগ করতো। এটাই সরবারাহ শেকল বা সাপ্লাই চেইন এর আদিরুপ। সভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে এর পট পরিবর্তন হয় এবং এটি একটি কাঠামোগত কাজে পরিণত হয়ে যায়, যেমন কৃষিজীবি জীবনের বিকাশ ঘটলে তাতে এর রুপটা ধরা পড়ে। প্রাচীন কৃষিজীবি মানুষ ফসলের বীজ সংগ্রহ করতো এবং তা দিয়ে ফসল ফলিয়ে একটা নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তা ভোগ্যপন্য হিসেবে রুপান্তর করতো। সভ্যতার ইতিহাসে প্রাচীন রোমান ও গ্রীক সভ্যতায় কুমোর এবং কৃতদাসরা মাটির পাত্র তৈরী করতো এবং এজন্য প্রয়োজনীয় কাচামাল সংগ্রহ, পাত্র তৈরী এবং বিকোনোর কাজে তারা ঠিক আজকের পক্রিয়াটাই মেনে চলতো। খোদ ক্রীতদাস ব্যবসার ক্ষেত্রেও একথাটা প্রয়োজ্য। গত সহ¯্রাব্দের প্রথম দিক পর্যন্ত আফ্রিকা ও পূর্বএশিয়া থেকে মানুষদের ধরে নিয়ে ইউরোপের বাজারে কৃতদাস হিসেবে বিক্রি শুরু হয়। পুরো পক্রিয়াটা একটা শক্তিশালি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়েছিলো এবং এরা খুবই শক্তিশালী দালালচক্রের মাধ্যমে ্ই পক্রিয়া হাজার বছর ধরে চলেছিলো। কঠিন যোগাযোগ ব্যবস্থা বনবাসি মানুষের কঠিন প্রতিরোধ সবকিছু পেরিয়ে এ ব্যবস্থা হাজার বছর টিকেছিলো।

সেদিনের সে স্থাপনা যেমন মিশরের পিরামিড তৈরীর জন্য পক্রিয়া অনুসরণ করে দক্ষ কারিগর এবং উপাদান সংগ্রহ করা হয়েছিলো। নিকট অতীতের আগ্রার তাজমহল যে মূল্যবান পাথর দিয়ে তৈরী হয়েছিলো সেহুলো সে কঠিন যোগাযোগ ব্যবস্থার যুগে দক্ষতার সহিত সংগ্রহ করা হয়েছিলো। প্রাচীন কৌটিল্যের অর্থশা¦াস্ত্রে এ ধরনের তথ্য পাওয়া যায়। এমনকি আমাদের এখানকার আজকের উয়ারি বটেশ্বরে খননকাজ চালানোর পর এমনকিছু উপাদান পাওয়া গেছে। যা এখানে থাকার কথা নয়। গবেষকদের ধারণা সূদূর রোম থেকে এসব উপাদান এখানে এসেছে। হাজার বছর আগে রোম স¤্রাজ্য থেকে সূদূর প্রাচ্যে আসা এসব উপাদান নিশ্চই একটা পক্রিয়া মেনেই এখানে এসেছে।

সাপ্লাই চেইনের আরেকটা ক্ষুদ্র ভার্সণ হচ্ছে পারিবারিক ব্যবস্থার সাথে সর্ম্পকিত। আমাদের দেশে একটা মধ্যবিত্ত পরিবার স্বাভাবিক জীবন যাপনের জন্য কমবেশী ৬শ পন্য ক্রয় করে থাকে। এসব ক্রয় করার জন্য তারা ১৫০ – ২৫০টি ঠিকানা বা দোকানে গমন করে। তারা তাদের প্রাত্যহিক জীবনের জন্য এই কাজটা করে থাকে। এটা নেহায়েত সহজ, পক্রিয়া মনে হলেও আপনি যদি আলাদাভাবে ভাবেন যে আপনি আপনার ব্যবসার জন্য ৬শ বিভিন্ন ধরনের পন্য সংগ্রহ করবেন তাহলে আসলেই কঠিন মনে হবে।

একজন গৃহকর্তা বা গ্রহকত্রী এসব কাজের জন্য কোন প্রশিক্ষণ কিংবা একাডেমিক ডিগ্রি নেননি। বরং তিনি তার পূর্বসুরীদের কাছ থেকে জেনেছেন। বাকীটা তিনি তার অভিজ্ঞতা থেকে অর্জন করেছেন। ততদিনে তিনি জেনে গেছেন কোন চাল ভালো, এবং সেটা কোন দোকানে পাওয়া যায়, কোন লবনে বালি আছে, কোন লবনে নেই। গরুর মাংশ কেনার জন্য কিভাবে দরদাম করতে হয়। মাছ বাজার থেকে ভালো মাছটি কিভাবে আনতে হয়।

তাহলে আমরা কয়েকটা বিষয় পরিস্কার হলাম যে সাপ্লাই চেইন আসলে মানুষের আদি পেশা, প্রতিটি পরিবার একটি জটিল সাপ্লাই চেইন সহজভাবে পরিচালনা করে। এবং পরিবারের মানুষগুলো বা কর্তামশায় সেটা পরামর্শ ও অভিজ্ঞতার আলোকে আয়ত্ত করেছেন।

এখন এই পক্রিয়ার মাধ্যমে একজন পন্য ব্যবসায়ী কিভাবে তার সাপ্লাই চেইন দাড় করাবে এবং সেটা জানার জন্য তার কি কি জানা প্রয়োজন। আমি বলি প্রতিটি আইডিয়া বা ধারণা কমপক্ষে ৩-৫টি ধারনার সমন্বয়। যেমন একজন উদ্যোক্তা ভাবলেন যে তিনি মালয়েশিয়া থেকে ফার্নিচার আমদানী করবেন। তাহলে তিনি জেনেছেন যে মালয়েশিয়ায় ভালো ফার্নিচার মেলে, বাংলাদেশে সে ফার্নিচারের চাহিদা রয়েছে এবং সেটা বাংলাদেশে আনার সুযোগ রয়েছে। এতিনটি তথ্য জানা না থাকলে নিশ্চই এই পরিকল্পনা করা সম্ভব ছিলনা।

আসুন কি কি ধরনের পুরনো সাপ্লাই চেইন ছিলো। এটা আমাদেও প্রাকটিক্যালি খুব কাজে না লাগলেও পন্য সাপ্লাই নিয়ে যারা খুব টেনশনে আছেন তাদেও জন্য কিছুটা উৎসাহব্যঞ্জক হবে।
১. পারিবারিক সাপ্লাই চেইন: এটা পৃথিবার সবচে বহুল প্রচলিত এবং পুরনো সাপ্লাই চেইন। আজ অবধি ঠিক একই শক্তিতে টিকে রয়েছে। একটি পরিবার তার নিত্য প্রয়োজনীয়, নতুন প্রয়োজনীয় এবং একদা প্রয়োজনীয় পন্যগুলো এপক্রিয়ায় সংগ্রহ করে। এর একটা অংশ নির্ধারিত এবং পরিকল্পিত এবং কিছু অংশ প্রয়োজন অনুসারে সাজানো। প্রথমটি হচ্ছে একটি পরিবারের নিত্যপ্রয়োজনীয় চালডাল সংগ্রহ পক্রিয়া। দ্বিতীয়টি হলো একটি পরিবারের হঠাৎ একটি বাইসাইকেল প্রয়োজন হলো। তখন পরিবারের লোকেরা খোজ খবর নিয়ে পরামর্শ করে যথাযথ সন্ধান নিয়ে দেখেশুনে জিনিসটি ক্রয় বা সংগ্রহ করলো।
২. রাজকীয় সাপ্লাই চেইন: আগরেদিনে রাজা বাদশাহরা তাদের প্রয়োজনে বিভিন্ন বিলাসী দ্রব্য সংগ্রহ করতো। এজন্য অন্যদেশের রাজার সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে একটা পক্রিয়া ঠিক করে আর্থিক লেনদেন বা বিনিময় ঠিক করে পন্য আদান পদান করতো।
৩. দালাল বা ফড়িয়া চক্রের সাপ্লাইচেইন: সত্যি বলতে দালালি বা ফড়িয়াচক্রের উৎপত্তি পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন ব্যাপার স্যাপার। এতে একটা ফড়িয়া চক্র অবৈধভাবে মূল্যবান জিনিসপ্রত্র সংগ্রহ করে তা বাজারে নিয়ে আসতো বা ভোক্তার সামনে পেশ করতো।
৪. দাদন সাপ্লাই চেইন: বিনিময় প্রথার পরপর যখন মূদ্রা প্রথার বিকাশ ঘটে তখন এই পক্রিয়া শুরু হয় এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের পর পন্য একস্থান থেকে অন্যস্থানে স্থানান্তর শুরু হলে এ ব্যবসা বিকশিত হয়। এতে পুজিপতিরা আগেই পন্যের জন্য অর্থদান কওে, পরে কমমূল্য সে পন্য সংগ্রহ করে। আমাদের দেশে সমুদ্র মাছধরাসহ বেশকয়েকটি খাতে এই দাদন ব্যবসা এখনো খুব শক্তভাবে টিকে আছে। এটাকে ঋণভিত্তিক চেইন বলা যেতে পারে।
৫. দস্যুভিত্তিক সাপ্লাইচেইন: গত কয়েক শতাব্দীতে সমূদ্রবাণিজ্য বিকশিত হলে এধরনের পেশা বিশ্বজুড়ে পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে। সমুদ্রজাহাজ লুটেরা গোষ্ঠি নানা ব্যবসায়িক পন্য সংগ্রহ করতে ¯্রফে দস্যুবৃত্তির মাধ্যমে, দস্যুপনায় দক্ষব্যক্তিরা তাদের ব্যবসায়িক দক্ষতাও তাদের ছিলো, তারা বিভিন্ন চ্যানেল সম্পর্কে জানতো, কোন চ্যানেলে কোন পন্য চালান হয় তা তারা জানতো এবং লুটকৃত পন্য বিপননেও তারা দক্ষ ছিলো।
৬. কৃষিভিত্তিক সাপ্লাই চেইন: প্রাচীন যুগে কৃষিজ পন্যের ধান, যব, গম, জলপাই ইত্যাদি পন্যের সংগ্রহ, গুদামজাতকরণ ও অন্যান্য পক্রিয়ার মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠিত সাপ্লাইচেইন ছিলো।
৭. বন্দর ও বাজারভিত্তিক সাপ্লাইচেইন: আগেরদিনে নদীভিত্তিক যোগাযোগ ও বাজার ব্যবস্থার একটা দিক ছিলো নদী বন্দরের মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকার পন্যসামগ্রী এসে জড়ো হতো, সেখান থেকে আবার বণিকচক্রের মাধ্যমে সেসব পন্য একই পক্রিয়ায় ছড়িয়ে পড়তো। এটা একটা সমৃদ্ধ ও অভিজাত সাপ্লাই ব্যবস্থাপনা ছিলো।
৮. গোষ্ঠিকেন্দ্রিক সাপ্লাইচেইন: প্রাচীণ সমাজে গোষ্টি ও শ্রেণীভিত্তিক একটা চেইন প্রথা প্রচলিত ছিলো। গোষ্টিভুক্ত লোকজন পরস্পরের সহযোগিতার ভিত্তিতে তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী সংগ্রহ ও সরবরাহ করে থাকে।
৯. বর্ন ও শ্রেণীভিত্তিক চেইন: বিশেষকরে প্রাচীন ভারতে বর্ণ ও শ্রেণীভিত্তিক একটি শক্তিশালি চাহিদা পন্য ও সেবার উপর কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো এবং কমবেশী ৩হাজার বছর পর্যন্ত তা বহাল ছিলো। এবং এখনো তার প্রচলন রয়েছে। এর মূল ভিত্তি ছিলো ধর্ম। হিন্দুসমাজে যে পেশা বা শ্রেনীভিত্তিক বর্নপ্রথা প্রচলিত হয়েছে তার কথাই বলছি। সমাজে কামার কুমোর জেলে তাতি এসব নানা পেশার লোকদের সমন্বয় ও পেশা কিংবা দায়িত্ববন্টনে সম্পন্œ হয়েছিলো। এতে সমাজের এক এক শ্রেনীর লোকদের বংশ পরম্পরায় এক এক পেশা বা সেবার যোগানের দায়িত্ব ছিলো।
১০. স্বনির্ভর সরবরাহ ব্যবস্থা: আগেকার দিনে প্রতিটি পরিবার তাদেও প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো নিজেরা সংগ্রহ ও উৎপাদন করতো। আমাদেও দেশে এখনো উপজাতি সম্প্রদায় লবন ও কেরোসিন বাদে নিত্যপ্রয়োজনীয় পন্য নিজেরাই তৈরী করে।
এসব ব্যবস্থাকে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকেও বিভাজন করা যায়, যেমন, সামাজিক, রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক। আবার বিস্তৃত এলাকাজুড়ে এবং স্বল্পদূরত্বব্যাপী। আবার ব্যক্তিগত ও সমষ্ঠিগত।

এভাবে প্রাচীণ এবং মধ্যযুগে বিভিন্ন জটিল পরিস্থিতিতে ব্যবসায় রাজকীয় আয়োজন এবং দৈনিন্দিন প্রয়োজনে মানুষকে নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী পন্য সরবরাহ ব্যবস্থাপনার উপর নির্ভর করতে হয়েছে। এছাড়া আরো অনেক পক্রিয়ার মাধ্যমে যুগে যুগে মানুষ তাদের নিজেদের প্রয়োজনকে পূরণ করে নিয়েছে।

9,927 total views, 2 views today

Comments

comments

Your email address will not be published.