e-commerce red
জাহাঙ্গীর আলম শোভন

আপাতত বাংলাদেশের এক ঝাঁক তরুন অনলাইনে ব্যবসায় করার জন্য বুদ্ধি পরামর্শ সাহায্য সহযোগিতা ও নানা সেবার পিছে ছুটছে। এতে দেখা গেল শুধু ব্যবসায়িক জ্ঞান নয় বরং অনেকেরই ভালো রকম যোগ্যতা, সৃজনশীল আইডিয়া, গঠনমূলক চিন্তা, উদ্ভাবনী ব্যবসায়িক পরিকল্পনা থাকলেও ¯্রফে টাকার জন্য শুরু করতে পারছেন না। ¯্রফে টাকা। একদিকে ব্যাংকলোন পাওয়ার উপায় নেই, অন্যদিকে সরকারী কোনো প্রটেকশান বা হেল্প নেই। তবুও যে কিছু আশার আলো আছে। কোথায়ও একটু সম্ভাবনা আছে, সেটা তুলে ধরার জন্য এই পরামর্শমূলক রচনা। সবসময় শুরুতে মূল কথায় চলে গেলেও আজকে একটু ভূমিকা দিয়ে লিখলাম। আমিও যে এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ তা নয়. তবে যদি নিজের জানার ও ভাবার বিষয়টা শেয়ার করে কারো উপকার করতে পারি সে ভরসায় লিখা।
আজকের এ বিষয়ে লেখাটাকে আমরা দুটো ভাগে ভাগ করে নিই:প্রথম ভাগ: বিনিয়োগকারী আপনার কাছে কি চাইবে? দ্বিতীয়ভাগ আপনি কিভাবে বিনিয়োগকারীকে বোঝাতে সক্ষম হবেন?

প্রথম ভাগ: বিনিয়োগকারী আপনার কাছে কি চাইবে?

প্রথমত: বিনিয়োগকারী চাইবে লাভসহ তার টাকা ফেরত পাওয়ার নিশ্চয়তা। এটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার জেনেশুনে কেউ লস খাতে হাত দেবে না। আপনি আপনার কথায় কাজে কাগজপত্রে এবং বাস্তবতায় সেটা বোঝাতে হবে।

দ্বিতীয়ত: উদ্যোক্তার যোগ্যতা ও সততা: আমি বলি সততা, যোগ্যতা বা সামর্থ, আন্তরিকতা, দক্ষতা ও পরিশ্রম এই পাঁচটি মিলিয়ে মূলত যোগ্যতা। পাঁচ আঙুলে এক হাত। একজন মানুষ সৎ কিন্তু কাজটি করার যোগ্যতা নেই। তাহলে তিনি সফল হওয়ার কোন কারণ নেই। আবার সৎ ও যোগ্য হয়েও তিনি অলস অথবা আন্তরিক নন তাতেও তিনি ব্যর্থ হবেন। আর যদি দক্ষতার অভাব থাকে তাহলে কাংখিত সাফল্য পাওয়া কঠিন হবে। একজন বিনিয়োগকারী কিন্তু আপনার এই বিষয়গুলো খেয়াল করবেন। কঠিন বিনিয়োগকারীরা একহাত দেখেনা দুইহাতই দেখে অর্থাৎ আরো পাঁচটি গুন দেখে শিক্ষা, ভবিষ্যত, ব্যবসায়িক পলিসি, অতীত ইতিহাস, সামাজিক অবস্থান। অর্থ্যাৎ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আপনি কতটা শিক্ষিত, ব্যবসার ভবিষ্যৎ কি হবে? আপনার ব্যবসায়িক নীতি শুভদিনের ইঙ্গিত করছে কিনা? অতীতে আপনি কেমন লস দিয়েছেন বা লাভ করেছেন? আপনার আর্থ সামাজিক অবস্থা কেমন? এখন আপনার কাজ হলো এ বিষয়ে তাকে নিশ্চিন্ত করা।

তৃতীয়ত: একেবারেই আইনগত বা প্রথাগত কিছু জিনিস বিনিয়োগকারী দেখবে
০১. আপনার ব্যবসাটি বৈধ ও দেশের আইন সঙ্গত কিনা?
০২. আপনি প্রয়োজনীয় রেজিস্ট্রেশান ও কাগজ পত্র নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছেন কিনা?
০৩. আপনার ব্যবসায়িক ইতিহাস কেমন? আপনার ব্যক্তিগত কোন সম্পত্তি আছে কিনা?
০৪. আপনার ভোটার আইডিসহ ব্যক্তিগত কাগজপত্র, নাগরিকত্ব, স্থায়ী ঠিকানা এসব ঠিক আছে কিনা?
০৫. অন্যকারো সাথে আপনার কোন ঋণআছে কিনা? থাকলে তা কি পরিমাণ এবং কতদিনের? এর আগে আপনার কোন ব্যাডলোন বা খেলাপী হিস্ট্রি আছে কিনা?

চতুর্থত: একেবারেই ফোকাল পয়েন্ট, ব্যবসা করতে গেলে অথবা ইকমার্স এর ক্ষেত্রে আপনার বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ নয় কিন্তু ঋণ বা বিনিয়োগ পাওয়ার জন্য অতি দরকারী
০১. ট্রেড লাইসেন্স, ট্রেড লাইসেন্স এর ধরণ ও বয়স, টিন, ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন ও কোম্পনী রেজিস্ট্রেশন।
০২. ব্যাংক একাউন্ট, ব্যাংক একাউন্টের বয়স ও লেনদেনের পরিমান।
০৩. ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও তার দলিলপত্র। জমি, ফ্লাট, সঞ্চয়পত্র, বীমা, ব্যাংকজমা।
০৪. অফিসের ঠিকানা, অফিসের আকার আকৃতি ও বয়স ও অফিস ভাড়ার চুক্তিপ্রত্র।
০৫. কোম্পানীর ফোন, মোবাইল, ই মেইল, স্কাইপি।
০৬. ওয়েবসাইটের মান ও বয়স।
০৭. কর্মীসংখ্যা, তাদের বেতনকাঠামো।
০৮, ব্যবসার ধরণ কি পরিমাণ লেনদেন এবং লাভ হয়।
০৯. উপরের তথ্য সমূহের সত্যতা প্রমানের জন্য তারা আরো কিছু তথ্য ও ডকুমেন্টস চায়
১০. প্রতিটি ব্যবসায়ের ধরণ ও বিনিয়োগকারীর পলিসি অনুযায়ী আরো কিছু জিনিস চাইতে পারে।

পঞ্চমত: কিছু কিছু বিনিয়োগকারী এ ধরনের শর্ত দিয়ে থাকে। যেমন
০১. উচ্চ হার সূদ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে চক্রবৃদ্ধিহারে।
০২. অনেকসময় বিনিয়োগকারীরা একসাথে বিনিয়োগ না করে ধাপে ধাপে করে থাকে।
০৩. কখনো কখনো বিনিয়োগকারীরা নগদ অর্থ না দিয়ে নিজেরা জিনিসপত্র কিনে দিয়ে থাকে।
০৪. কখনো বা বিনিয়োগকৃত অর্থ একেবারে ফেরত না নিয়ে কিস্তিতে নিয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে সুদের হার কিন্তু বেশী হয়।
০৫. বেশীরভাগ ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীরা চান যে বেশীরভাগ লগ্নী যেন উদ্যোক্তার থাকে, তাহলে বিনিয়োগকারীরা ভরসা পায়।
০৬. কোনো বিনিয়োগ লাভ লোকসানের ভিত্তিতে হয়, কেউ আবার শুধু লাভ নিতে চায়, লোকসান নিতে চায়না।
০৭. কোনো বিনিয়োগকারী নিজেদের প্রতিনিধি নিয়োগ দিতে চায় ।

আপনি কিভাবে বিনিয়োগকারীকে বোঝাতে সক্ষম হবেন: আশাকরি অনেকটাই বোঝা গেছে যে কি কি বিষয় বিনিয়োগ পাওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

প্রথমত: উপস্থাপন
০১. বিনিয়োগকারী যে বিষয়গুলো জানতে চায় সেগুলো পরিস্কার ভাষায় যতটা সম্ভব বিস্তারিত তুলে ধরুন। এর মধ্যে কোনো অস্¦চ্চতা বা ভাসা ভাসা ধারণা যেন না থাকে।
০২. যুক্তি ও তথ্যের আলোকে আপনার ব্যবসার ভবিষ্যত যে ভালো সে ব্যাপারে তুলে ধরুন। নেহায়েত লোকসানে পড়লে সেটা রিকভার করার কি পলিসি রয়েছে সেটাও বিস্তারিত তুলে আনুন।
০৩. আপনি এবং আপনার টিম সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা তৈরী করুন।
০৪. বিনিয়োগকারীর শর্তের প্রতি সম্মান দেখান, কোনোটা মানতে আপনি অসমর্থ হলে বুঝিয়ে বলুন।
০৫. বিভিন্ন কনসালটেন্সি ফার্ম বিনিয়োগ পেতে সাহায্য করে তাদের হেল্প নিতে পারেন।
০৬. প্রয়োজনীয় কাগজপত্র গুলোর একটা কপি সমসময় হাতের কাছে রাখুন। যেন তৈরী করতে বেশী সময় না লাগে।
০৭. ধাপে ধাপে নেয়া এবং কিস্তিতে পরিশোধ এসব শর্ত আপনার জন্যও ভালো হতে পারে।
০৮. ফার্ম বড়ো হলে বিনিয়োগকারীর একজন কনসালটেন্ট আপনি প্রতিনিধি হিসেবে রাখতেই পারেন।
০৯. সুদের শর্তগুলো ভালোভাবে বুঝে নেবেন যাতে কোনো মারপ্যাঁচ না থাকে।
১০. সব ধরনের তথ্য দিয়ে আপনার প্রতিষ্ঠানের একটি প্রোফাইল বানিয়ে রাখুন, কাজে লাগবে।

দ্বিতীয়ত:  বিনিয়োগের সোর্স:
০১. প্রথম প্রথম ব্যবসা বাণিজ্য করতে চাইলে আপনি আপনার পরিচিত বন্ধু বান্ধব আত্মীয় স্বজনের কথাই ভাবুন।
০২. সেটা সম্ভব না হলে বা আপনার ইচ্ছে না হলে ব্যবসায়ের অংশীদার হিসেবে কাউকে রাখুন যিনি বিনিয়োগে সক্ষম।
০৩. বর্তমানে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে লাভ লোকসানের ভিত্তিতে বিনিয়োগ করে থাকে তাদের কথা ভাবুন। খোজ খবর নিন, আলাপ আলোচনা করুন। শর্তাবলী দেখুন্ । যারা এ ধরনের সার্ভিস নিয়েছে তাদের অভিজ্ঞতা জানুন।
০৪. আশা, ব্রাক, টিএমএসএস, এসএমই ফাউন্ডেশন ক্ষুদ্র ও মাঝারী ্্ঋণ দিয়ে থাকে। খোজ খবর নিন। সম্ভাবনা যাচাই করুন।
০৫. স্থানীয় বিভিন্ন সমিতি ও এনজিও আজকাল লোন দেয় আছে সমবায় সমিতিও, তাদের কথাও ভাবুন।
০৬. ব্যাংক ই কমার্সে লোন দেয়না কথাটা সত্য কিন্তু এর অর্থ এই নয়যে আপনার ব্যাংক লোন পাওয়ার রাস্তা বন্ধ। আপনি আপনার পন্যের জন্য একটা শোরুম নিয়ে ব্যাংকে ঋণের জন্য আবেদন করুন। আপনি ই কমার্স ব্যবসায়ী হলেওতো আপনার একটা আউটলেট থাকতেই পারে। অথবা আপনি একজন শোরুমের মালিক হয়েওতো অনলাইনে মার্কেটিং টাকে বেছে নিতে পারেন। সূতরাং ব্যাংকলোনের রাস্তা কিন্তু আপনার জন্য বন্ধ নয়। আপনি একটু বদ্ধি খাটালে ব্যাংক লোন পেতে পারেন।
০৭. শুধু তাই নয় আপনি সহজ শর্তে একেবারেই স্বল্প সুদে কৃষি লোন বা কৃষি ব্যাংক থেকে লোন পেতে পারেন যদি আপনার ব্যবসাটা কৃষিভিত্তিক হয়।
০৮. পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন পিকেএসএফ মর্বন্মিন ৩% সূদে টাকা দেয়। শর্ত হলো আপনার প্রকল্পটি হতে হবে উদ্ভাবনী যা ইতিপূর্বে হয়নি। ভাবুনতো একবার কিছু করা যায় কিনা? একবার গিয়ে আলাপটাই সেরে আসুন না শেরে বাংলা নগরে।
০৯. প্রতিটি ব্যাংকের এসএমই লোন শাখা আছে।  আপনার যদি ফিজিক্যাল একটা শোরুম থাকে। ব্যাংকের অন্যান্য শর্ত মানলে পেতেও পারেন লোন ৫০ হাজার থেকে ৫০ লাখ।
১০. মহিলা উদ্যোক্তাদের জন্য সব ব্যাংকের তুলনামূলক কম সূদে একটি প্রকল্প আছে। নিজেরা একটা দোকান নিয়ে চেষ্টা করুন লোনটা পেতে। আপনার বেচাকেনাটা না হয় অনলাইনেই বেশী হবে। যেহেতু তারা দোকান বা পন্য দেখা ছাড়া লোন দেবেনা সূতরাং কি আর করা। আপনি মেয়ে হলেতো কথাই নেই। তা না হলে মা, বোন, অথবা স্ত্রীর সাহায্য নিতে পারেন। এক্ষেত্রে মালিকানাটা একজন মহিলার নামেই হবে । তাহলে গ্রামীন ব্যাংককেও আপনি পাশে পেতে পারেন। বলাতো যায়না।

তৃতীয়ত: বিনিয়োগ পাওয়ার প্রস্তুতি:
০১. আগে খোজখবর নিন কোন সংস্থার কি শর্ত
০২. তারপর আপনি আপনার দোকান ও কাগজপত্র সেভাবে সাজান
০৩. যে প্রতিষ্ঠান থেকে নেবেন, তাদের সাথে সম্পর্ক তৈরী করুন।
০৪. প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আপডেট রাখুন।
০৫. কিভাবে টাকাটা খরচ করবেন, তার একটা ভালো প্লান করুন।

চতুর্থত: বিনিয়োগকৃত অর্থের সর্বোত্তম ব্যবহার
০১. পুরোটা ঋণ নেবেন না, বড়ো একটা অংশ নিজে বিনিয়োগ করুন।
০২. বিনিয়োগকৃত অর্থ ব্যয়ে মিতব্যয়ী হোন, উৎপদনশীলখাতে ব্যয় করুন।
০৩. এমন পন্য বাছাই করুন যেটাতে বিনিয়োগ করলে সর্বোচ্চ ৪-৬ মাসের মধ্যে লগ্নিকৃত অর্থ ফেরত আসবে। তাহলে আপনি বছরে ২/৩ বার টাকাকে রান করাতে পারবেন। আর যদি ২/১ মাসের টার্গেট হয় তাহলেতো আরো ভালো।
০৪. আস্তে আস্তে অগ্রসর হোন প্রথম থেকেই অনেক পন্য আর বহু কর্মী নিয়োগ করবেন না। যেহেতু টাকাটা আপনি ধার নিয়েছেণ।
০৫. হিসাব, ক্রয় বিক্রয় খরচ এসব ব্যাপারে সতর্ক থাকুন।
০৬. প্রতি সপ্তাহে বা মাসে একটা মনিটরিং করুন। ব্যবসা কোনদিকে গড়াচ্ছে বোঝার চেস্টা করুন। যদি লসের দিকে যায় কারণ অনুসন্ধান করুন। দ্রুত সমস্যার সমাধান করুন। যেন অর্থবছরের মধ্যে আপনি লাভ তুলে টাকাটা ফেরত দিতে পারেন।
০৭. পারলে প্রতি মাসে কিছু সঞ্চয় করুন। অথবা একটা ঝুঁকি ফান্ড করে প্রতিদিনর লেনদেন থেকে একটা অংশ তুলে রাখুন। বিপদের সময় কাজে দেবে।

পঞ্চমত: লাভজনক প্রতিষ্ঠান ধারণা:
০১. যেহেতু আপনি অন্যের সাহায্য নিয়ে ব্যবসা করছেন। বাড়তি সর্তক থাকুন। কারণ একবার ব্যর্থ বা খেলাপী হলে ভবিষ্যতে আপনি আর লোন পাবেন না।
০২. আমাকে সফল হতেই হবে। এই প্রতিজ্ঞা নিয়ে কাজ করুন।
০৩. প্রতিটি ধাপে বিবেচনার পরিচয় দিন।
০৪. আগেই চিন্তাভাবনা করে কাজ হাত দিন।
০৫. ব্যবসায়ের নৈতিকতা মেনে চলুন।

আসলে যদি এই লেখাটিতে এ ধরনের তথ্য থাকতো যে কোন সংস্থা কোন শর্তে কাকে কত টাকা লোন দিয়ে থাকে। তাহলে ্এটি পরিপূর্ণ হতো। কিন্তু এ ব্যাপারে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব পলিসি  আবার সেটা প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের জন্য এক একটি বড় লেখা হবে। ভবিষ্যতে সেগুলো দেয়ার চেস্টা করবো। মনে রাখবেন সেগুলো কিন্তু পরিবর্তণশীল। সেজন্য ভালো হবে- ঋনদাতা এবং বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে সরাসরি ভিজিট করে জেনে নেয়া। একবারে প্রাথমিক জ্ঞানের জন্য তাদের ওয়েবসাই ভিজিট করতে পারেন। ধন্যবাদ।

10,545 total views, 4 views today

Comments

comments

Your email address will not be published.