প্রাক স্ক্রো অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংক কতৃক অনলাইন লেনদেন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার বিশ্লেষণ

প্রাক স্ক্রো অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংক কতৃক অনলাইন লেনদেন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার বিশ্লেষণ

 

সাম্প্রতিক সময়ে কতিপয় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান কতৃক পন্যের অগ্রিম মূল্য আদায় ও প্রতিষ্ঠানগুলোর দায় এবং সম্পদের ভারসাম্যহীনতা নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে গত ২৪ জুন জরুরী বৈঠক আহবান করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বৈঠকে ই-ক্যাবের প্রস্তাব অনুযায়ী দ্রুত ডিজিটাল কমার্স নির্দেশিকা বা এসওপি এবং ESCROW সার্ভিস চালু করার সিদ্ধান্ত হয়। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রস্তাব অনুযায়ী ব্যাংকগুলোর কাছে নির্দেশনা পাঠানো হবে যে ক্রেতারা পেমেন্ট সিস্টেম ব্যবহার করে যখন পেমেন্ট করবে তা ক্রেতার কাছে পণ্য ডেলিভারি দেওয়ার পর ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান অর্থ ছাড় পাবে।

এই সিদ্ধান্ত সংবাদ মাধ্যম প্রকাশের পর মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ই-ক্যাবের পক্ষ থেকে বিগত ২৫ জুন একটি মত বিনিময় সভার আয়োজন করা হয়। ই-ক্যাবের সদস্য প্রতিষ্ঠানের মালিক ও প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে এই বিষয়ে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করে, কিছু সমস্যার কথা জানায় এবং কিছু সমাধানও আলোচনার মাধ্যমে উঠে আসে।

 

প্রশ্ন ও সমস্যাসমূহ

১। ক্রেতা ফরমায়েশকৃত পণ্য হাতে পাওয়ার পর যদি অনলাইন শপ অর্থ ছাড় পায়। তাহলে কোন প্রক্রিয়ায় নিশ্চিত করা হবে যে, ক্রেতা সঠিক পণ্যটি পেয়েছেন?  যদি ক্রেতার মেসেজ এর মাধ্যমে জানতে হয়, তাহলে এখানে একটা ঝুঁকি রয়েছে। কারণ অন্তত ৪০ শতাংশ ক্রেতা এই মেসেজ পাঠানোর দায়িত্ব নেবে না। তাছাড়া এখনো ২/৩% ক্ষেত্রে ক্যাশ ডেলিভারীতে দেখা যায় কিছু প্রতারক ক্রেতা সেজে পণ্য ছিনতাই, ডেলিভারীম্যানকে আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায়, পণ্যবদল, অর্থ না দেয় এ ধরনের ঝামেলা করে থাকেন। এতে করে একশ্রেনীর প্রতারক ক্রেতা সেজে এ ধরনের সুবিধা গ্রহণ করতে পারে। সেক্ষেত্রে সমাধান কি হবে? আবার সমাধান করতে গিয়ে মার্চেন্ট এর টাকার একটা বড় অংশ ব্যাংকে আটকে থাকতে পারে।

২। অনলাইন প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত কিছু কিছু ক্ষেত্রে পণ্য বিক্রি হওয়ার পর সরবরাহকারীকে মূল্য পরিশোধ করে থাকে। এখানে টাকা ব্যাংকের নিয়ন্ত্রনে থাকলে সাপ্লায়ারদের পণ্যমূল্য পেতে আরো দীর্ঘ-সূত্রিতা তৈরী হতে পারে।  অনেক ক্ষেত্রে ক্রেতার অর্থ দিয়ে কিছু অগ্রিম মূল্য পরিশোধ করে অনলাইন শপকে পণ্য ও সেবা ক্রয় করতে হয়। এক্ষেত্রে অনলাইন শপ পণ্য-সেবা ক্রয়ের ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়বে। কারণ সকল ক্ষেত্রে তারা ধারে পণ্য ক্রয় করতে পারে না।

৩। যে কারণে জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে এবং উক্ত সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়েছে। সেসব সমস্যা সব ধরনের প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে সৃষ্টি হয়নি। বিশেষ করে মুদি বা নিত্যপণ্য এবং তৈরী বা রেস্তোরার খাবার অনলাইন বিক্রি প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে এটা হয়না। কারণ তারা ফরমায়েশ পাওয়ার ক’ঘন্টার মধ্যে পণ্য ডেলিভারী দিয়ে থাকে।

৪। বর্তমানে ক্যাশ অন ডেলিভারীতে ক্ষেত্র বিশেষে ৪% পণ্য বিনা কারণে গ্রাহক গ্রহণ করার আগেই ফেরত পাঠায়। ঈদের সময় এটা কখনো কখনো ১০% এর উপরে চলে যায়। এ ধরনের সমস্যা বিহীন ফেরত বিশেষ করে ক্রেতার মতের পরিবর্তন এর কারণে যেসব ফেরত নিতে হয়। এ ধরনের ফেরতের পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে। এতে অনলাইন শপ লোকসানের মুখে পড়বে। কারণ তারা এই অনুপাতে লাভ করতে পারে না এবং সরবরাহকারীকে পণ্য ফেরত দিতে পারে না। আবার এতে করে ধারে পণ্য সরবরাহকারীও বিপদে পড়বে। কারণ পণ্যটি বিক্রি হয়নি- এই অযুহাতে সরবরাহকারীর অর্থ ছাড় দিবেনা অনলাইন প্রতিষ্ঠানগুলো। একসময় সরবরাহকারী অনলাইনে পণ্য দেয়া বন্ধ করে দিবে অথবা পন্যের দাম বাড়িয়ে দেবে।

 

পরামর্শসমূহ

১। পণ্যটি ডেলিভারী দেয়া হলো কিনা এই নিশ্চয়তা ক্রেতার পরিবর্তে বিক্রেতা থেকে গ্রহণ করা যেতে পারে। এতে করে প্রতিটি ভিন্ন অর্ডার বা লেনদেন ছাড় দেয়ার পরিবর্তে একসাথে কয়েক হাজার পণ্যমূল্য বা পেমেন্ট ছাড় দেয়া যাবে। এতে প্রক্রিয়াটি সহজ হবে। ক্রেতাদের ক্ষেত্রে কিছু ভুল তথ্য দেয়ার সম্ভাবনা আছে। সেক্ষেত্রে- প্রমানিত হলে জরিমানা বা দ্বিগুন টাকা বেশী সময়ের জন্য আটক রাখার শাস্তিমূলক ব্যবস্থা থাকতে পারে।

২। কিছু কিছু পন্যের ক্ষেত্রে আংশিক ছাড় দেয়া যেতে পারে। অথবা অনলাইন প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থলেনদেন এর জন্য কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠানের অনুরুপ সেটেলমেন্ট একাউন্ট চালু করা যেতে পারে। যার মাধ্যমে অনলাইন শপ  প্রয়োজনে সরাসরি সাপ্লায়ারকে অর্থ পরিশোধ করতে পারে।

৩। ক) এই ব্যবস্থা সেইসব প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রযোজ্য হতে পারে। যেসব প্রতিষ্ঠান অস্বাভাবিক অফার দিচ্ছে। এবং সময়মতো পণ্য দিচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে অথবা পন্যের পরিবর্তে পন্যের খূচরামূল্য নগদে প্রদান করছে। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে এই বাধ্যবাধকতার আওতা মুক্ত রাখা যেতে পারে।

খ) শীঘ্রই এসওপি বা ডিজিটাল কমার্স নির্দেশিকায় পণ্যমূল্য গ্রহণ, পণ্য ডেলিভারী সময়সীমা, রিফান্ড ও রিটার্ণ পলিসি, অস্বাভাবিক অফার এসব বিষয় অন্তভূক্ত করার মাধ্যমে নীতিমালা মেনে চলতে বাধ্য করে এই সমস্যার অনেকাংশে সমাধান করা যাবে।

খ) এছাড়া বর্তমানে অস্বাভাবিক অফার, লম্বা সময় নিয়ে পণ্য ডেলিভারী এই পক্রিয়াটি কতটা আইনসঙ্গত তা খতিয়ে দেখা দরকার। যদি এটা আইনসঙ্গত না হয় তাহলে জরুরী ভিত্তিতে এ ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা এবং জনস্বার্থে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা উচিত। যদি আইনসঙ্গত হয় তাহলে এটাকে ‘‘ডিল ই-কমার্স’’ নামে আলাদা ক্যাটাগরি হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান ও আলাদা লাইসেন্স এর ব্যবস্থা করা যেতে পারে যাতে এই ধরনের প্রতিষ্ঠানের উপর নজরধারী করা যায়। এছাড়া এধরনের প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বড় ধরনের জামানত নিয়েও লাইসেন্স দেয়া যেতে পারে।

৪) যদি কোনো ক্রেতা নিজে তথ্য গোপন করে, প্রতারণার চেষ্টা করে, মিথ্যা তথ্য দেয়, সময়মতো সাড়া না দেয়, বিনা কারণে পণ্য গ্রহণ করার পূর্বেই ফেরত পাঠায়, পণ্যটি গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়, পূর্নাঙ্গ ঠিকানা না দেয়, ভুল ঠিকানা দেয়, পণ্য ডেলিভারী দিতে গেলে কোনো অসাদুপায় অবলম্বন করে, উদেশ্যপ্রণোদিত ভাবে অভিযোগ করে সেক্ষেত্রে উক্ত ক্রেতার কাছ থেকে ‘‘সেবা প্রক্রিয়াকরণ ফি’’ বা সার্ভিস চার্জ বাবত কিছু অর্থ কর্তন করা যেতে পারে। অপরাধ বিবেচনায় পুরোমূল্য রেখে দেয়া কিংবা জরিমানাও করা যেতে পারে।

৫) ভিন্ন বিজনেস ক্যাটাগরি হিসেবে চিহ্নিত করে ভিন্ন নির্দেশিকা/নীতিমালা/এসওপি তৈরী করা ছাড়াও প্রতিষ্ঠানগুলোর অগ্রিম মূল্য গ্রহণের ক্ষেত্রে সীমা (ক্যাপিং) দেয়া যেতে পারে। প্রতিষ্ঠানগুলোর পেইডআপ ক্যাপিটেল, সম্পদের পরিমাণ ও ব্যাংকজমার উপর ভিত্তি করে তাদের পন্যের অগ্রিমমূল্য গ্রহণের সীমা নির্ধারণ করা যেতে পারে। এতে করে কোম্পানীগুলো নিজেদের সম্পদের অধিক দায় বহন করতে পারবেনা।

 

3,455 total views, 3 views today

Comments

comments