ই কমার্স: সংকট পেরিয়ে পথচলা: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

জাহাঙ্গীর আলম শোভন:

শুরু থেকেই সকলে বাংলাদেশের নানা সমস্যা নিয়ে কথা বলে আসছেন। আর ই ক্যাবের পক্ষ থেকে ভরসা, পরামর্শ ও সাহস যোগানো হচ্ছে। সাধারণত কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরা অনেক সময় নেতিবাচক চিন্তা করি অহেতুক হতাশ হয়ে পড়ি, কিন্তু ই কমার্সে নতুন উদ্যোক্তারা যেসব সংকটের কথা বলছে তাও কিন্তু অমূলক নয়। এসব সমস্যা বাংলাদেশে পুরোমাত্রায় বিদ্যমান। তারপরও সমস্যার গায়ে হেলান দিয়ে ই ক্যাবের সংগঠকরা যে আশার বাণী শোনাচ্ছেন এবং শুভদিনের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন তাও কিন্তু পুরোপুরি বাস্তব সম্মত। আসুন পুরো ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করা যাক-
পেছনের কথা:
একটু পেছন থেকে শুরু করা যাক। দেশ যখন স্বাধীন হয় আপনারা জানেন যে, এদেশেকে তুলোবিহীন ঝুড়ির দেশ বলা হয়েছে। সাতকোটি মানুষের দেশ প্রয়োজনীয় উৎপাদন এখানে নেই। নেই বিদেশী মূদ্রা আহরণের পথ। ফলে বর্হিবিশ্বে ধারণা করেছিলো দারিদ্রের যাঁতাকলে পিষ্ঠ হবে এই দেশ। কিন্তু তা হয়নি। পৃথিবীর সবচে জনবহুল দেশ জনশক্তি রফতাণী করে পুরুষদের কাজে লাগোলো, গার্মেন্টস শিল্পের মাধমে মেয়েদের শ্রমকেও কাজে লাগালো। এভাবে উঠে এলো দেশের অর্থনীতি। এটা কিন্তু ১৯৭১ সালে কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি।
সমস্যাই সুযোগ:
আমরা বলছি যে যে এদেশে ব্যবসাতে হাজারো সমস্যা, ই কমার্সে সমস্যা আরো বেশী। আমরাতো এটাও বলি যে এদেশে মানসম্পন্ন চিকিৎসা নেই অথচ এদেশে সে নেইটাই সবচে বেশীদামে বিক্রি হচ্ছে। আমাদের দেশে যে চিকিৎসা সেবা প্রাইভেট হাসপাতাল গুলো দেয় উন্নয়ত বিশ্বের সাথে তুলনা করলেও আমরা পরিশোধিত মূল্যের পাঁচ ভাগের একভাগ সেবাও পাইনা। বিষয়টা কি দাড়ালো? ‘‘যাহা নাই নাই করিয়া শোরগোল উঠিয়াছে তাই কেহ আছে বলিয়া আমাদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।’’ অন্যকথায় বলতে গেলে সেটাই ব্যবসার নিশ্চিত লাভজনক উপায় হয়ে দাড়িয়েছে। আরেকটি খাত শিক্ষা, আমরাতো জানি আমাদের এখানে মানসম্পন্ন শিক্ষা নাই। আর নাই বলে আমরা সেটা খুজছি, আর খুজছি বলে সেটা র্দূমূল্য হয়ে গেছে আর তাই তার বেচা বিক্রি ভালো। এবং সেজন্যই দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নামে শত শত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। প্রাইভেট টিউশন থেকে শুরু করে স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়, কোচিং, ভাষা শিক্ষা, ইংলিশ কোচিং, কম্পিউটার ও অন্যান্য ট্রেনিং প্রতিষ্ঠান সবই। একদিকে আমরা বলি এটা আসলে বাজে ব্যাপার যে শিক্ষা পন্য। একথাও সত্য এর মধ্যে দিয়ে লক্ষ লক্ষ লোকের রুটি রুজির ফায়সালা হয়েছে।

সমস্যাটা সামাজিক:
আবারো বলছি, প্রতারণা চলছে, ভালো সাপোর্ট নেই, সহায়ক শিল্প ও ব্যবসা নেই, ভালো প্লাটফরম নেই, অভিজ্ঞ জনশক্তি নেই। এগুলো কিন্তু ই কমার্সের একার সমস্যা নয়। এগুলো আমাদের গোটা দেশের সমস্যা সমগ্র আর্থ সামাজিক অবস্থার চিত্র। আজকের গার্মেন্টস ব্যবসা একদিনে এ অবস্থায় আসেনি। তাছাড়া আমাদের দেশে প্রতারণা কোথায় নেই। জমি কিনে মানুষ ঠকছেনা?, আইনগত সেবা নিতে গিয়ে বিভ্রান্তি হচ্ছেনা? হাসপাতালে গিয়ে ভুল বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে না? ইঞ্জিনিয়ারের কাছে ভুল সেবা পাচ্ছেনা? পত্রিকা টিভিতে ভুল তথ্য নিয়ে সংবাদ দেখছেনা? সূতরাং আলাদাভাবে ই কমার্সের ক্ষেত্রে কেউ যদি সমস্যা ও প্রতারণার কথা বলেন। তা ইনসাফ হবেনা।
সমস্যা দিয়েই শুরু করুন:

সূতরাং সমস্যা দিয়েই শুরু করুন।

০১. নানা রকম প্রতারণা:
আমরা বলছি যে, ই কমার্স এ নানা রকম প্রতারণা হয়, মানুষ কিভাবে বিশ্বাস করবে? ই কমার্সে বাংলাদেশে এখনো যে প্রতারণা হয় তা খুব নগন্য। তারচেয়ে বেশী প্রতারণা হয় প্রতিদিন পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে। আপনি জানেন কি? বিভিন্ন পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয় তার একটা অংশ ভূয়া। এসব তোম্পানীতে আবেদন করলেই নিয়োগপত্র পাঠায় তারপর প্রশিক্ষণ এর নামে ২/৩ হাজার টাকা নিয়ে তারপর আর তারা নেই। প্রতিদিন শত শত পাত্র-পাত্রী বিজ্ঞাপন দেয়া হয় তার বেশীরভাগই ¯্রফে ধান্দা। আপনি আজই একটাতে ফোন করে দেখুন। ওরা বলবে আাগে আপনি ১ হাজার বা ২ হাজার টাকা দিয়ে আমাদের সদস্য হোন। তারপরের গল্প আরো বেশী ধোকার। তারপরও বলছি যারা মনে করেন ই কমার্সে প্রতারণার কারণে ব্যবসা করা যাবেনা। তাদের বলবো এটাই আপনার সুযোগ, সবাই যদি প্রতারণা করে আর আপনি যদি সততার সাথে ব্যবসা করেন তাহলে গ্রাহকতো সব একদিন আপনার কাছেই আসবে। খোলা মসলায় প্রতারণার কারণেই রাধূনি মসলার এত জনপ্রিয়তা। খোলা বাজারে জাল মধু বেচে বলে প্রশিকার মধু কিনতে হয়।

০২. পদে পদে দূর্নীতি:
হতাশার আরেক কারণ আমাদের দেশের দূর্নীতি। পদে পদে ঘুষ দিতে হয়। টাকা ছাড়া কোন কাজ হয়না। প্রথমত: সার্বিকভাবে দূর্নীতি বাড়লেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে উন্নতি হয়েছে , যেমন ধরুন বিদ্যূৎ এর ভুতুড়ে বিল এখন কম শোনা যায়। টেলিফোন লাইন এখন ৩ দিনে নেয়া যায় ইত্যাদি। দ্বিতীয়ত : সরকারী খাতে দূর্নীতির কারনেই বেসরকারী খাতের ব্যবসার সুযোগ বেড়েছে। সরকারী ব্যাংেকের সেবার মানহীনতার কারণে প্রাইভেট ব্যাংকের ব্যবসা জমজমাট। তৃতীয়ত: কোনো অবস্থায় বসে থাকার সুযোগ নেই। আমি জানি আপনি বলবেন, ব্যবসার শুরুতেই ট্রেড লাইসেন্স নিতে ঘুষ দিতে হয়। নীতি রেখে ব্যবসা কিভাবে করবো। আমি বলবো আপনি সঠিকভাবে করার চেষ্টা করুন, তবে বসে থাকবে ন না। আর দূর্নীতির জন্যও কিছু কিছু কাজ করুন। আর কিছু না পারলে আপনি আপনার ব্যবসাটাকে অন্তত নীতি নৈতিকতার মধ্যে রাখুন। এভাবে প্রতিটা মানুষ তার নিজের গ-িটা ভালো রাখলেইতো হয়ে যায় অর্ধেক কাজ।

০৩. সহায়ক ব্যবসা শিল্পের অভাব:
হ্যাঁ বাংলাদেশে যাতায়াত ব্যবস্থা ভালো না, গ্রামে ইন্টারনেট নেই, ঠিকমতো কারেন্ট থাকেনা, ভালো কোনো পেমেন্ট মুড নেই, ডেলিভারি সার্ভিস গুলোও যা তা, সিকিউরিটি নিশ্চিত করে ই কমার্স সাইট বানাতে ভরসা মেলে না, ব্যাংক থেকে লোনও পাওয়া যায়না। এসব প্রতিটি সমস্যাই এক একটা সুযোগ। ভালো পেমেন্ট গেটওয়ে না থাকা মানে এখানে ভালো পেমেন্ট কোম্পানী খোলার সুযোগ আছে। ভালো পার্সেল সার্ভিস না থাকা মানে এখানেও আরেকটি ব্যবসা করার জায়গা হলো। ব্যাংক লোন ইেন মানে দেশে আরো একটা আর্থিক প্রতিষ্ঠান বানাবার উপায় জানা গেলো। ভালো ডোমেইন হোস্টিং কে যদি নাই মনে করুন তাহলে কথাই নেই কাজটি আপনি নেজেই শুরু করুন। ভালো সাপ্লাই পার্টি না থাকা মানে আপনিই হতে পারেন সাপ্লাই কোম্পানীর মালিক। যেমন করে দক্ষ জনশক্তি নেই বলে ট্রেনিং সেন্টারগুলো গড়ে উঠেছে।

০৪. সরকারী সহযোগিতা ও নীতিমালা নেই:
আমি জানি এটা থাকলে ভালো হতো। কিন্তু নাই সেজন্য বসে থাকার সুযোগ নেই। কাল যদি সরকার বেকার ১০০০ যুবককে ই কমার্স এর জন্য ৫ লক্ষ টাকা হারে লাভ লোকসানের ভিত্তিতে লোন দেয় তাহলে ১০০০ টি ই কমার্স সাইট হবে। আর আপনাকে ১০০০ লোকের সাথে প্রতিযোগিতা করতে হবে। আপনার যদি অন্যান্য সামর্থ থাকে তাহলে এটা আপনার জন্য সুবিধা যে আপনি প্রতিকূল পরিবেশে একটা সার্ভিস দিচ্ছেন এবং কঠিন বলেই সেটার আলাদা একটা চাহিদা থাকবে।

০৫. রাজনৈতিক অস্থিরতা:
এটা সত্যি একটা বাজে ব্যাপার. আমরা ক্ষমতায় থাকার জন্য এবং ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য যেভাবে বলপ্রয়োগ করছি আর দেশের ক্ষতি করছি তাতে লজ্জায় কেবল মাথা হেট হয়ে আসে। তবে আমি আপনাদের আশ্বস্থ করছি যে এজন্য যে গত ৫০ টি বছর আমরা এই পক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এগিয়েছি। এসব অনেক কারণে আমরা জাতি হিসেবে আমাদের রির্সোস এর তুলনায় যতটা আগানোর কথা ছিলো ততটা আগাতে পারিনি। আবার এটাও ভেবে দেখুন সন্ত্রাস, দূর্নীতি, অপরাজনীতি, আর শত শত দিন হরতাল সত্বেও আমরা টিকে আছি। বছরে এতগুলো নেতিবাচক ঘটনার পরও আমাদের অর্থনীতি ঘুরে দাড়িয়েছে। ব্যবসা বাণিজ্য মুখ তুলে চেয়েছে। রেমিটেন্স প্রবাহে গতি এসেছে। গার্মেন্টস শিল্প মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। সূতরাং হতাশ হওয়ার কিছু নেই। কুয়াশার মেঘ কেটে আলো বেরিয়ে আসবে। দেশের পরিস্থিতি যতদিন এমন থাকে তার ফাঁকে আসুন আমরা তথ্য জেনে, আড্ডা দিয়ে, সার্ভিস সেন্টারে কল করে, প্রশিক্ষণ নিয়ে, বাজারে পর্যবেক্ষণ চালিয়ে প্রস্তুতি নিয়ে নিই। যেন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে নেমে পড়তে পারি। আর ক. পরিচিতদের মাঝে সম্প্রীতির জন্য জনমত তৈরী করি। খ. ভবিষ্যত বংশধরদের ইতিবাচক রাজণীতিতে উদ্বূদ্ধ করি, গ. সবাইকে ছাড় দেয়ার আহবাণ জানাই, ঘ. ব্যবসায়ীদের বলি কিছু একটা করতে। ঙ. সবাইকে বলি আমাদের কথাও একটু ভাবতে। সবাইকে আজকের মতো ধন্যবাদ। আবার কথা হবে পরের লেখায়।

6,124 total views, 2 views today

Comments

comments

Your email address will not be published.