ই কমার্স: শুরু করতে চাইলে

জাহাঙ্গীর আলম শোভন
আমাদের দেশে তরুন প্রজন্মের পাশাপাশি সব বয়সের মানুষ তথ্যপ্রযুক্তির প্রতি ঝুঁকছে। ফলে ই কমার্সেও সম্ভাবনা উজ্জলতর হচ্ছে। ইন্টারনেটের ব্যবহার, বিদ্যূৎ পরিস্থতির উন্নতি, স্মার্টফোন ইত্যাদি কারণে অনলাইন ব্যবসার অপার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। পাশাপাশি শিপিং সার্ভিস, পেমেন্ট জটিলতা, সাপ্লাই চেইন, পেশাদারিত্বসহ বেশকিছু সমস্যাও রয়েছে। ঠিক এই পর্যায়ে কেউ যদি ই কমার্সের কথা ভাবেন। তার জন্য নিচের বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ

এক: বিষয় সর্ম্পকিত জ্ঞানার্জন:

একটা কাজ যত কঠিন বা সহজ হোকনা কেন সে বিষয়ে কাজ করার জন্য সে বিষয়ে কিছু জ্ঞান থাকা চাই। যত বেশী জানা থাকবে ততবেশী সহজ মনে হবে। এবং ভুল সিদ্ধান্ত নেয়ার আশংকা থাকবেনা। যতবেশী তথ্য আপনার কাছে থাকবে ততবেশী রাস্তাও আপনার জানা থাকবে। তাই ই কমার্স কে সহজ মনে কওে হেলাফেলা করবেন না। একটা কাজ যতই সহজ হোক যখনি আপনি সিরিয়াস হবেন সে কাজ থেকে তত বেশী সুফল পাবেন। মোটামোটি যেসব বিষয় ধারণা রাখবেন।
১. কোন এলকায় শিক্ষিত লোক কেমন, জনসংখ্যা কেমন, কি পরিমাণ লোকইন্টারনেট ব্যবহার করে ইতাদি জানার চেষ্টা করবেন।
০২. ই কমার্স কি, কাকে বলে? কখন কিভাবে শুরু হয়? কিভাবে বিস্তার লাভ করে। যারা সফল হয়েছে তাদের কি পলিসি ছিলো আর যারা ব্যর্থ হয়েছে তাদের কি ভুল ছিলো ? যতটা সম্ভব জানার চেষ্টা করবেন।
০৩. দেশে কোন কোন পন্যের চাহিদা আছে কিন্তু চাহিবা মাত্র পাওয়া যায়না। তার একটা খোজখবর রাখুন।
০৪. দেশে যারা ই কমার্স করছে তারা কিভাবে কাজ করছে। তাদের ভালেমন্দ বিশ্লেষণ করুন। বাজারের উপর নজর রাখুন।
০৫. দেশে যে কয়টি শিপিং অপশন আছে সব কয়টির বি¯তারিত ধারণা নিন। তাদেও এরিয়া, খরচ, পলিসি, ডেলিভারী, টাইমিং, প্যাকিং ইত্যাদি জেনে রাখুন। প্রয়োজনে সরাসরি ফোন করুন এবং অফিস ভিজিট করুন। কাজের ধরন নিজের চোখে দেখে আসুন। কারণ ঘরে বসে ব্যবসা করা যায় কিন্তু ঘরে বসে ব্যবসা শেখা যায়না।
০৬. পন্য সরবরাহের জন্য সুপার স্টোর বা অন্যান্য কোম্পানী কি ধরনের পদক্ষেপ নিয়ে থাকে তা জেনে রাখুন। সরবরাহের জন্য আপনি কিভাবে নেটওয়ার্ক তৈরী করবেন। তা আপনি একটা ঘসড়া প্লান তৈরী করে নিন।
০৭. নিজে চোখে বিভিন্ন কোম্পানীর পন্য উৎপাদন, সাপ্লাই ম্যানেজমেন্ট, প্যাকিং, পরিবহন, ডেলিভারী ব্যাপার দেখুন। প্রয়োজনে ফ্যাকটরী ভিজিট করুন। মনে রাখবেন চাক্ষুস ও ব্যবহারিক জ্ঞান কাগুজে জ্ঞানের চেয়ে অনেক বেশী কার্যকর।
০৮. সরকারী কাগজপত্র, ট্রেড, টিন এসব সম্পর্কে একটি প্রাথমিক ধারণা রাখবেন।
০৯. টাকা পয়সা লেনদেনের ব্যাপারে দেশে যতগুলো পথ আছে এগুলো সম্পর্কে জেনে নেবেন। যেমন বিকাশ, মোবাইল ব্যাংক, এস এস পরিবহন, জননী পার্সেল, ট্রান্সপোর্ট, কুরিয়ার, অনলাইন ব্যাংকিং, টিটি, ডিডি, ব্যাংক চেক, পে অর্ডার, এলসি ও অন্যান্য। সব ধারণা থাকলে আপনি নিজেই বুঝবেন আপনার জন্য কোনটা পারফেক্ট।
১০. যাদের কাছ থেকে পন্য নেবেন তারা কিভাবে কোন শর্তে আপনাকে পন্য দেবে এ বিষয়ে খুটিনাটি বুঝে নেবেন।
১১. ইন্টারনেট সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞান রাখবেন। যেমন ডোমেইন, হোস্টিং, ওয়েবসাইট, ই কমার্স, ই মেইল, ওয়েব পোর্টাল, সার্চ ইঞ্জিন, নিউজ সাইট, ফেইসবুক ইত্যাদির ব্যবহার, পরিধি, কাযকারিতা, ব্যাপ্তি, সুবিধা এসব বিষয়ে কোনো ঘাটতি থাকলে জেনে নেবেন।
১২. সব সময় আপডেট থাকবেন, পত্রিকা বা অনলাইনে আইটি ও ব্যবসা সংক্রান্ত নিউজগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়বেন। সম্ভব হলে আ্জই একটি আইটি ম্যাগাজিন ও একটি ব্যবসা সংক্রান্ত ম্যাগাজিনের নিয়মিত গ্রাহক হয়ে যান।
১৩. আবারো বলছি, ঘরে বসে ব্যবসা করা যায়, কিন্তু ঘওে বসে ব্যবসা শেখা যায়না। যেখানে যে বিষয় সম্পর্কে ভালো ধারণা পাওয়া যাবে। সেখানে ভিজিট করুন।

দুই: নূনতম প্রস্তুতি:

ই কমার্স পুঁজি ছাড়া করা যায় এটা সত্য। কিন্তু আমি আপনাকে সেভাবে নিষেধ করবো। কারণ নূনতম পঁজি খরচ করলে এর জন্য আপনার একটা টান থাকবে। টাকার জন্য মায়া হবে এতে আপনি কিছুটা সিরিয়াস হবেন। কোনো পয়সা খরচ না হলে এমনটা নাও হতে পারে। তাই বাপনি অন্তত যেকাজ গুলো করবেন।
১. ওয়েবসাইট না খুললেও একটি ডোমেইন নিয়ে রাখতে পারেন।
২. ই কমার্স সাইট না থাকলেও অন্তত একটি ফেইসবুক পেইজ রাখবেন।
৩. টিন ভ্যাট না করলেও অন্তত একটি ট্রেড লাইসেন্স নিতে পারেন।
(যদি আপনি পরীক্ষামূলক ভাবে ব্যবসা করতে চান, সেক্ষেত্রে ভিন্ন কথা)
৪. প্রতিষ্ঠানের নামে না হলে নিজের নামেও একটি ব্যাংক একাউন্ট রাখতে পারেন।
৫. বয়স ১৮ না হলে স্টুডেন্ট একাউন্ট খুলতে পারেন। ব্যাংক থেকে।
৬. আর কিছু নাে হোক অন্তত একটি বিকাশ একাইন্ট খুলুন। (আমি ধরেনিয়েছি আপনার একটা স্মার্ট ফোন অথবা নেট কানেকশান আছে।)
৭. অফিস না থাকলে আপনার বাসার ঠিকানাটা ব্যবহার করতে পারেন।
তিন: ব্যবসা শেখা:
ব্যবসা শেখার ভালো পদ্ধতি হলো। আপনি যে ব্যবসা করতে চান সেরকম একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করা। কেউ যদি আগে টেইলারিং শপে চাকুরী করে তার জন্য মালিক হিসেবে একটি টেইলারিং শপ চালানো সহজ। তেমনি হোটেল সেলুন এমনকি ই কমার্স এর জন্যও এটি প্রয়োজ্য। তাই আপনি
প্রথমত: ব্যবসা শেখার জন্য অল্পকিছু লেখাপড়ার পাশাপাশি অন্যকোন ই কমার্স শপে একটি চাকুরী করতে পারেন।
দ্বিতীয়ত : সেটা যদি আপনার পক্ষে সম্ভব না হয় আপনি অন্যকোনে ই কমার্সেও সাথে যেকোন ভাবে একটি ব্যবসায়িক সম্পর্ক রাখতে পারেন। যেমন আপরি হয়তো তাদেও যেকোন একটি পন্যেও সাপ্লাই এর দায়িত্ব নিতে পারেন। আপনার লাভ কম হলেও ২/৪ মাস কওে আপনি শেখার চেস্টা করুন।
তৃতীয়ত: কয়েকজন বন্ধুবান্ধব মিলে অল্প পুঁজিতে শুরু করতে পারেন। বিশেষকওে তাদেরকে সাথে নেবেন যাদের সাথে আপনার মনের মিল আছে এবং যারা ব্যবসাটা একটু বোঝে। এতে করে ব্যবসা যদি সফল হয় তাতেও আপনি কিছু শিখবেন যা দিয়ে আপনি নিজে পরে ব্যবসা করতে পারবেন। আর এসময় খুব বেশী বিনিয়োগ করার ব্যাপাওে বুঝেশুনে করুন। আর যদি ব্যবসা পড়ে যায় তাহলে তা থেকে শিক্ষা নিয়ে আপনি নুতুন করে শুরু করুন।

চার: পরীক্ষামূলক ই কমার্স

আরেকটা ভালো বুদ্ধি হলো ব্যবসাটা শেখা, এর সুবিধা অসুবিধা জানা, বাজার সম্পর্কে ধারণা পাওয়া সর্বোপরি আপনি কতোটা যোগ্য তা যাচাই করার জন্য আপনি সর্ব প্রথম যেকোনো একটি পন্য নিয়ে ব্যবসাটা শুরু করতে পারেন।
যেমন ধরুন: আপনি বেচবেন একটি মাত্র পন্য, সুন্দরবনের মধু। এক্ষেত্রে আপনাকে যা করতে হবে।
১. সাপ্লাইয়ের জন্য খুলনা বা বাগেরহাটে একজন বিশ্বস্থ সাপ্লায়ার ঠিক করতে হবে।
২. বোতলজাত করার পর কিভাবে পার্সেল করলে সমস্যা হবেনাঅ তা ঠিক করতে হবে।
৩. কেনা কত পড়বে, শিপিং কস্ট কত, অন্যান্য খরচ কত, লাভ করবেন কত এগুলো ঠিক করে বাজারে অন্যদের দাম কত সব মিলিয়ে একটা দাম ঠিক করতে হবে।
৪. কোন এলাকায় কাদের মাঝে বিক্রি করতে চান সে অনুযায়ী বিজ্ঞাপন দিতে হবে।
৫. অনলাইনে অর্ডারের পাশাপাশি ফোনে অর্ডারের বা আপডেট জানার ব্যবসাথা রাখবেন।
৬. সুন্দর একটি নাম দিয়ে ফেইসবুক পেইজ খুলবেন। ফ্রি এড সাইটগুলোতে এড দিয়ে দেবেন।
৭. কুরিয়ার, পার্সেল, ট্রান্সপোর্ট এবং ডাক ভিাগের সাথে আগেই কথা বলে নেবেন। ওজন হিসেবে চার্জ কেমন তা হিসেব করে রাখবেন।
৮. পেমেন্ট এর জন্য অন্তত দুটো অপশন রাখবেন। ক. বিকাশ বা মোবাইল ট্রান্সফার, খ. ক্যাশ অন ডেলিভারী, কন্ডিশন ডেলিভারী। যা এস এ পরিবহন দিয়ে থাকে। অর্থাৎ আপনার গ্রাহক এস এ পরিবহন থেকে পন্য নেয়ার সময় দাম মিটিয়ে দেবে। এস এ পরিবহন দাম পরে আপনাকে পৌছে দেবে। তবে এক্ষেত্রে হোম ডেলিভারী হয় না।

পাঁচ: প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ

উপরের যে কয়টি পদ্ধতি আছে আপনি যদি তার চেয়ে ভালোভাবে শুরু করতে চান তাহলে আপনি কয়েকটি বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিতে পারেন। তারপর শুরু করুন যাকে বলে কোমর বেঁধে নাম। বিষয়গুলো- ইংরেজী জানা, ওয়েবসাইট মেকিং, সাপ্লাইচেইন ম্যানেজমেন্ট ও ই কমার্স।
এর মধ্যে ইংরেজী ও আইটির জন্য ট্রেনিং সেন্টারের অভাব নেই। ই কমার্স বিষয়ে ই-ক্যাবের পক্ষ থেকে ট্রেনিং চালু হবে। যোগাযোগ রাখুন। আর বাকী থাকলো সাপ্লাই চেইন। এ ব্যাপাওে আমি কিছু সোর্স দিচ্ছি:

সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা ‘পিজিডি ইন সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট’ কোর্স চালু করেছে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট (বিআইএইচআরএম)।
দেশে সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে আন্তর্জাতিক সনদ অর্জনের সুযোগ করে দিচ্ছে অ্যাডভান্স সাপ্লাই চেইন সলিউশন বাংলাদেশ লিমিটেড নামক একটি প্রতিষ্ঠান। যেটি যুক্তরাজ্যভিত্তিক চার্টার্ড ইনস্টিটিউট অব পারচেজিং অ্যান্ড সাপ্লাইয়ের (সিআইপিএস) অধীনে পরিচালিত হয়। সবচে কম খরচ, BiMS Dhaka কারণ এখানে মাত্র ১৫ হাজার টাকার বিনিময়ে একটি পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিপ্লোমা ইন সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট কোর্স করা যায়।

সূতরাং আপনি এখন খুব সহজে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। আপনি কোন লেভেল থেকে শুরু করতে পারেন। তবে ব্যবসার জন্য একাডেমিক ডিগ্রিই মোটেই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। তেমনি পুঁজিও কোনো বাঁধা হয়ে দাড়ায়নি।ব্যবসায়িক ডিগ্রি নিলেই যে আপনি ভালো ব্যবসায়ী হবেন তা নয়। আপনার একটা ব্যবসায়ীক মেজাজ ও মার্কেটসেন্স আপনাকে একজন ব্যবসায়ী হিসেবে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে। যদি আপনার মধ্যে থাকে আত্ববিশ্বাস, বাজার সম্পর্কে ধারণা, সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার যোগ্যতা, মানুষের সাথে মেশার সহজাত ক্ষমতা, সাহস ও গতি। সর্বোপরি আপনি যদি ব্যবসার ব্যাপাওে দৃঢ়চিত্ত ও অধ্যাবসায়ী হন। প্রতিটি বিষয়ে সফলতার জন্য পরিশ্রম করতে প্রস্তুত থাকেন। তাহলে আপনার ই-কমার্স যুদ্ধে নামার এখনই সময়।

9,783 total views, 2 views today

Comments

comments

Your email address will not be published.