আজকে এ আর্টিকেলটি পড়ে খুবই ভাল লাগল।লেখাটা পড়েই মনে হয়েছে যে এটা ই-ক্যাবে সবার সাথে শেয়ার করার মতো একটা লেখা। আর্টিকেলটি ফিন্যান্সিয়াল টাইমস পত্রিকার ব্লগে প্রকাশিত হয়েছে। লেখক দুজন পিএইচডি ক্যাণ্ডিডেট। আর্টিকেলের মূল বিষয়বস্তু চীনে ই-কমার্স কিভাবে গ্রামের মানুষের জীবনকে বদলে দিচ্ছে।
চীন বর্তমানে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি গুলোর একটি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের জিডিপি র্যাঙ্কিং অনুসারে যুক্তরাষ্ট্রের পরেই চীনের অবস্থান। চীনের এ অর্থনৈতিক বৃদ্ধির পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রয়েছে দেশটির সাধারণ শ্রমজীবি মানুষ যারা দিনরাত খেটে পরিশ্রম করে বড় বড় কল-কারখানা, বাড়ী-ঘর বানিয়েছে। চীনের জনসংখ্যা বিশাল এবং স্বস্তা শ্রম দেশটির সবচেয়ে বড় শক্তি। চীনে কলকারখানা হবার আগে এটি ছিল কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি এবং গ্রাম ছিল এ অর্থনীতি মূল ভিত্তি। গ্রামে হাজার হাজার মানুষ কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত ছিল।
চীনে ৮০’র দশক থেকে যখন কল-কারখানা গড়ে ওঠা শুরু করে। তখন দেখা গেল যে চীনের গ্রামগুলো থেকে লক্ষ লক্ষ লোক শহরে যাচ্ছে এসব কল-কারখানায় কাজ করতে। এ স্বস্তা শ্রমের উপরে ভর করে চীনের অর্থনৈতিক উন্নতি হলো। কিন্তু প্রদীপের আলোর নীচে যেমন অন্ধকার ঠিক তেমনি এ উন্নতিরও একটি অন্ধকার দিক রয়েছে। লক্ষ লক্ষ পুরুষ ও নারী যখন গ্রাম ছেড়ে শহরে আসতে থাকে তখন চীনের গ্রামগুলো শূন্য হয়ে যায়। শুধুমাত্র বয়োঃবৃদ্ধ আর বাচ্চা ছাড়া গ্রামে কেউ থাকেনা। বছরে চার থেকে পাঁচদিন হয়তো তারা গ্রামে আসে বাবা-মায়ের সাথে থাকে আর বাকীটা সময়ে বাবা-মা একা একাই থাকেন। শুধু বাবা-মা নয়। এসব শ্রমিকরা তাদের স্ত্রী ও বাচ্চাদেরও গ্রামে ফেলে রেখে চলে যায়। ফলে যা হয় স্বামী-স্ত্রী ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। অনেক সময়ে দেখা যায়, সন্তানদের দেখার জন্যে তাদের বাবা-মা কেউ নেই। তারা দূরে কারখানায় কাজ করছেন। আছেন শুধু বুড়ো বুড়ো দাদা-দাদী/নানা-নানী। তারা নিজেরাও অসুস্থ। সব মিলিয়ে খুবই দুঃসহ অবস্থা। বৃদ্ধ বয়সের একাকীত্বের যন্ত্রণা ও ছেলেমেয়েরা কাছে না থাকার ফলে অনেক বয়োঃবৃদ্ধ আত্মহত্যাও করেন।
এই যে ছবিতে ফুটফুটে মেয়েটিকে দেখছেন এর নাম জিয়া-মেইলিং। মেয়েটির বয়স পাঁচ বছর। থাকে তার দাদীর কাছে। দাদীর বয়স ৬৪ বছর। মেয়েটির বাবা-মা গুয়াংঝু প্রদেশের একটি কাপড়ের কারখানায় চাকরি করে।দাদি স্যানিটেশন ওয়ার্কার। মেয়েটিও দাদির সাথে থাকে এবং কাজ করে।
জিয়া-মেইলিং এর মতো বাচ্চাদের বলা হয় “left-behind children” এবং এসব বয়োঃবৃদ্ধদের বলা হয় “left-behind elderly।” বর্তমানে চীনে ৬কোটি ১০ লক্ষ “left-behind children” এবং ৪ কোটি “left-behind elderly” আছেন। এসব বাচ্চাদের ৭৯% তাদের দাদা-দাদী বা নানা-নানীর কাছে থাকে এবং এদের পড়ালেখা বা যত্ন করার কেউ নেই।আর তাই এসব বাচ্চারা পড়াশুনায় ভাল করে না।
এভাবে চীনের গ্রামীণ সমাজ ভীষণ ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।
এখন দেখা যাক ই-কমার্স কিভাবে গ্রামের মানুষের জীবনকে বদলে দিচ্ছে। চীনের ই-কমার্স বাজার বিশ্বের বৃহত্তম। ৩০ কোটির বেশি অনলাইন ক্রেতা আছে দেশটিতে। আলিবাবার তাওবাও.কম এবং টিমল.কম চীনের অন্যতম জনপ্রিয় অনলাইন মার্কেটপ্লেস। ২০১৩ এর তথ্যমতে, এ মার্কেটপ্লেস দুটিতে ৮০ লক্ষ স্টোর রয়েছে যার মধ্যে ২০ লক্ষ চীনের বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে অবস্থিত। অর্থাৎ গ্রাম থেকে অনলাইনে স্টোর খুলে মানুষ এখানে পণ্য বিক্রী করছে।
চীনে অনেক গ্রাম আছে যেখানকার অধিবাসীদের নূন্যতম ১০% তাওবাও.কম এ স্টোর খুলে তাদের গ্রামের উৎপাদিত পণ্য বিক্রী করে। এসব গ্রামকে বলা হয় তাওবাও গ্রাম বা “Taobao village.”
চীনা পত্রিকা জিনহুয়া এর সূত্র মতে ২০১২ সালের শেষ পর্যন্ত ১.৬৩ মিলিয়ন তাওবাও স্টোর ছিল যেগুলো বিভিন্ন গ্রাম থেকে সেট-আপ করা হয় এবং তাদের সমন্বিত আয়ের পরিমাণ ছিল ৫ বিলিয়ন ইউয়ান। ২০১৪ সালের শুরুতে চীনে মাত্র ২০টি তাওবাও গ্রাম ছিল যাদের সমন্বিত আয়ের পরিমাণ ছিল ১০ মিলিয়ন রেইনমিনবি। বর্তমানে এরকম গ্রামের সংখ্যা ২১১।
গ্রামের লোকজন এভাবে অনলাইনে পণ্য বিক্রী করার ফলে অনেক গ্রামের তরুণ-তরুণীরা এখন আর শহরে যায় না। তারা গ্রামে তাদের পরিবারের সাথে থেকেই কাজ করে আয় করে। চীনের জিয়াংশু প্রদেশের পূর্বের একটি গ্রাম দংফেং। গ্রামে ১২০০ লোকের বসবাস। মাত্র দশবছর আগেও এ গ্রামের বেশিরভাগ লোক শহরে কাজ করত। তখন এমন অবস্থা ছিল যে গ্রামে একজন বুড়ো লোক মারা গেলে তার কফিনটি বইবার মত লোকও পাওয়া যেত না। কিন্তু এখনকার চিত্র ভিন্ন।
এখন এ গ্রামের মানুষ তাওবাও.কমে অনলাইন স্টোর খুলে ফার্নিচার বিক্রী করে। এর ফলে গ্রামের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। গ্রামের তরুণ-তরুণীরাও এখন আর শহরে যায় না। উল্টো অনেক তরুণ-তরুণী উচ্চশিক্ষা শেষ করে গ্রামে ফিরে কাজ করছে। শুধু তাই নয় গ্রামের বয়স্ক লোকেরাও তাদের ছেলেমেয়েদের ব্যবসায় নানা ভাবে সাহায্য করছে।
আরেকটি গ্রাম ওয়ানতু। এখানকার লোকেরা অনলাইনে ঝুড়ি বিক্রী করে। গ্রামে এখন ডিভোর্স হয় না, কোন বাচ্চা নেই যাদের বাবা-মা তাদেরকে রেখে অন্য প্রদেশে কাজ করে, কোন অসুখী বৃদ্ধ-বৃদ্ধা নেই।
চীনের গ্রামে ই-কমার্স জনপ্রিয় হবার মূলে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। প্রথমত, ই-কমার্সের কারণে গ্রামের মানুষ তার পরিবার পরিজন ছেড়ে শহরে আসছে না। গ্রামে বসেই তারা সারা চীনে তাদের পণ্য বিক্রী করতে পারছে। দ্বিতীয়ত, প্রথাগত ব্যবসার তুলনায় ই-কমার্স ব্যবসা শুরু করা সহজ এবং মূলধনও কম লাগে। গ্রামে ই-কমার্সের বিস্তারের ফলে গ্রামের লোকদের মধ্যে কম্পিউটার ইন্টারনেট শেখার আগ্রহ উত্তরোত্তর বাড়ছে। তাওবাও গ্রাম গুলোতে স্কুলের বাচ্চা থেকে শুরু করে ৭৫ বছর বয়সের বৃদ্ধ লোকরাও কম্পিউটার ইন্টারনেট শিখছে। এতে মানবসম্পদ উন্নয়ন হচ্ছে এবং একই সাথে গ্রামের আর্থিক উন্নয়নও হচ্ছে।
লেখাটি পড়েই আমার বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থার কথা মনে হয়েছে। আমাদের দেশের অর্ধেকের বেশি লোক গ্রামে বাস করে। কিন্তু গ্রামে কোন কাজ না থাকায় লক্ষ লক্ষ তরুণ-তরুণী গ্রাম ছেড়ে শহরে পাড়ি দিচ্ছে। আমাদের রাজধানী ঢাকার কথাই ভাবুন। এটুকু একটা শহরে কত লোক বসবাস করে। অনেকে আসে শুধু কাজের আসায়। দুটো টাকা আয় করার আশায়। ঈদের সময়ে এ অবস্থাটা স্পষ্ট হয় ওঠে। লক্ষ লক্ষ লোক ঢাকা ছেড়ে গ্রামে ছুটে যায় তাদের আত্মীয়-পরিজনদের কাছে।
আর ঢাকা শহরের সামান্য একটু জায়গায় এত লোক বসবাস করে আমাদের বড় শহরগুলোকে বসবাসের অযোগ্য করে ফেলেছে। ই-কমার্স গ্রামে ছড়িয়ে দিতে পারলে। এসব মানুষগুলোর অনেকের আর শহরে জীবিকা অর্জনের জন্যে আসতে হতো না। গ্রামে তাদের পরিবার-পরিজনের সাথে থেকে কাজ করে তারা তাদের জীবন গড়ে নিতে পারত।
সূত্রঃ
8,420 total views, 6 views today
