ই কমার্স চ্যালেঞ্জ
জাহাঙ্গীর আলম শোভন

প্রতিনিয়ত দেশে ই কমার্স ব্যবসা প্রসারিত হচ্ছে। তরুনরা এখানে এসে ভিড় করছে। একদিকে অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা, বেকারত্ব অন্যদিকে সহজে উদ্যোগ ও পরিচালনার কারণে ই কমার্স ব্যবসায় দ্রুত প্রসারিত হচ্ছে।
কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে অনেক উদ্যোক্তা এখনো অনিশ্চয়তা থেকে বের হতে পারেননি। এর কারণ বহুবিধ। তবে মোটা কথায় বিশ্লেষণ করলে কয়েকটা হাতেগোনা সমস্যাই বার বার বেরিয়ে আসবে।

১. ব্যবসায়িক জ্ঞান, অভিজ্ঞতার অভাব ও বাজারের গতি প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা না থাকা
২. পন্য সূত্র বা প্রোডাক্টস সোর্স ও পন্য সংগ্রহ ও সমাবেশ ঘটানোর জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য স্বল্পতা
৩. ডেলিভারী, পেমেন্ট ইত্যাদি সার্ভিসের প্রত্যন্ত অঞ্ছলে বিস্তৃতি না থাকা।
৪. ভোক্তা সাধারনের মুড বুঝে প্রচারণা বা সঠিক ও কার্যকর উপায়ে মার্কেটিং করতে না পারা।
৫. সুনাম তৈরী করার আগে ব্যবসায়ে লাভ করার জন্য অস্থিরতা।

সবচে বড় কথা হলো আমরা কেবল বলছি ই কমার্সে এই সমস্যা সেই সমস্যা। আসলে এগুলো ই কমার্সের একার কোনো সমস্যা নয় এগুলো আমাদের পুরো বাজার ব্যবস্থার সমস্যা। এগুলো আমাদের আর্থসমাজিক অবস্থার বাস্তবতা। পেমেন্ট এবং ডেলিভারী এই দুটো সমস্যা হয়তো ই কমার্সের জন্য আলাদা করা যেতে পারে। কিন্তু এটা ভুলে গেলে চলবেনা যারা প্রথাগত নিয়মে ব্যবসা করেন তারাও এই সেবাগুলো গ্রহণ করেন। আর গ্রহণ করে বলে এগুলোর জন্ম হয়েছে। তা না হলে ই কমার্স শুরুর আগে এগুলোর অস্তিত্ব থাকতো না। এখন এসব ক্ষেত্রে যেসব সীমাব্ধতা জনিত সমস্যা রয়েছে। এগুলো যে শুধু ই কমার্স উদ্যোক্তা মোকাবিলা করছেন তা নয়। এগুলো প্রথাগত ব্যবসায়িরাও এসব ঝামেলায় রয়েছেন যশোরের একজন নকশীকাথা প্রস্তুতকারক কিন্তু খুব সহজে চট্টগ্রামে তার পাইকারকে স্যাম্পল পাঠাতে পারছেন না। আরো বেশী সমস্যা সেই কৃষকের যিনি নোয়াখালীতে বসে ‘‘নোয়াখালী গোল্ড’’ ব্রান্ডের বিশ্বের সবচে সুস্বাদু চিংড়ি মাছ উৎপাদন করে থাকেন।

তাহলে প্রচলিত ব্যবসায় কি বন্ধ হয়ে গেছে? না হয়নি। হয়তো অনেক ব্যবসা বিকশিত হয়নি। যেমন নোয়াখালী গোল্ড ব্যান্ডের চিংড়ি। কিন্তু যশোরের নকশীকাথা কিন্তু ঠিকই ঢাকায় চাহিবামাত্র পাওেয়া যায় এমনকি ফুটপাতে পর্যন্ত। তাহলে মানুষ নিজেদের প্রয়োজনে রাস্তা বের করে নিয়েছে এবং প্রয়োজনীয় জিনিসের বেচাকেনা বা ব্যবসা কোনেটাই থেমে নেই।

সূতরাং আমরা বলতে পারি প্রচলিত ব্যবস্থার মধ্যেও আমরা ই কর্মাস করতে পারবো বা করার সুযোগ রয়েছে। এর পরিসর আস্তে আস্তে বিস্তৃত হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে দুনিয়াতে যখনি কোন ভালো কিছু প্রথমবার হয়েছে তা অবশ্যই অল্প পরিসরে শুরু হয়েছে। পরে চাহিদা যোগান ও জনপ্রিয়তার কারনে তা বিকশিত হয়েছে।

এখন যদি সমাধানের কথা বলি

তাহলে ব্যবসায়িক জ্ঞান এর জন্য বাজারে বই রয়েছে। আছে বিভিন্ন ট্রেনিং। হ্যাঁ বই পড়ে আর শিখে কি ব্যবসা হয়। তা যদি না হয় যিনি যে পন্য নিয়ে ব্যবসা করবেন তিনি সেটা সরেজমিনে দেখে শুনে শিখে শুরু করতে পারেন। রয়েছে ব্লগে নানা আর্টিকেল। বাকীটা ব্যবসা করতে করতে আয়ত্বে এসে যাবে। ব্যবসায়িক কমিউনিটির সাথে যোগাযোগ রেখেও আপনি ব্যবসাকে জানতে পারেন। ব্যবসায় জগতের সর্বশেষ আপডেট ব্যবসায়িক পত্রিকা ম্যাগাজিন পড়লেও আপনার ধারণা জন্মাবে।
পন্যসূত্র প্রোডাক্ট সংগ্রহ কেউ যদি সিরিয়াস ব্যবসায়ী হন এবং এজন্য পরিশ্রম করতে রাজি হন। তাহলে তিনি এ সমস্যা অনেকাংশে লাঘব করতে পারবেন। আপনি কোন পন্য বেচবেন তা ঠিক করার পর সে পন্য সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন। তার উৎপাদন থেকে ভোক্তার কাছে পৌছনো পর্যন্ত প্রসেসটাও জেনে নিন। জেনে নিন সে পন্যটির লাভ লোকসোরে গোপন খবর। জানুন তার সুবিধা অসুবিধা । জানার চেস্টা করুন যারা এই ব্যবসা করছে তাদের হাল হাকিকত।

ডেলিভারী এবং পেমেন্ট এর ক্ষেত্রে সার্ভিস ক্যাটাগরি ও এলাকাভিত্তিক সীমাবদ্ধতা থাকলেও বর্তমানে দেশে প্রচলিত, ডাক, রেল, পরিবহন, কুরিয়ার, পার্সেল, ক্যাশ অন ডেলিভারী, কন্ডিশন ডেলিভারী, মোবাইল ব্যাংকিং, চেক, টিটি, ডিডি, পেমেন্ট গেটওয়ে এগুলোর প্রচলিত ব্যবস্থার মধ্যে বেশভালো ভাবে ব্যবসা করা সম্ভব। তাহলে এটাও এখন সমস্যা নয়। আপনি ই কমার্স ব্যবসা করবেন বা করছেন এ অবস্থায় আরো যারা ই কমার্স করছে তাদের সাথেই আপনার প্রতিযোগিতা। আপনি খেয়াল করুন যে বাজারে যেসব ব্যবস্থা রয়েছে পেমেন্ট বা ডেলিভারীর এগুলো কিন্তু সবার জন্য সমান। এখানে চাইলে কেউ বেশী সুবিধা বা সার্ভিস দিতে পারছেনা। সূতরাং এটা নিয়ে অযথা টেনশন না করে প্রচলিত ব্যবস্থার মধ্যে থেকে কিভাবে ভালো সার্ভিস পন্য ও মান নিশ্চিত করে বেশী বিক্রি করা যায়, সেকথাই ভাবুন।

সমস্যাটা জটিল হলো মার্কেটিং এর ক্ষেত্রে। কোন পক্রিয়ায় কিভাবে বিপনন করলে বেশী লোকে জানবে? কিভাবে জানালে পরে লোকেরা পন্য সম্পকের্ব আগ্রহী হব্ ে? কতটা আগ্রহী হলে পরে ক্রেতারা পন্যটি কিনবে বা কিনতে চাইবে? এ ব্যাপারে নবীন ই কমার্স উদ্যোক্তাগণ অন্ধাকারে হাবুডুবু খাচ্ছেন।

এর জন্য সহজ বুদ্ধি হলো। মার্কেটিং পলিসি বা ওয়ে ঠিক করার সময় আপনি ভুলে যান যে আপনি একজন উদ্যোক্তা। আপনি মনে করুন যে আপনি আর দশজন মানুষের মতই একজন ক্রেতা। এখন আপনি ঠিক করুন আপনি কোন পন্যটি কিনবেন এবং কিভাবে কিনবেন। আপনি নিজেই নিজের কার্যপ্রক্রিয়া খেয়াল করে দেখুন আপনার যদি সে পন্যটি দরকার হয় তাহলে আপনি সেটি কোথায় সার্চ দিয়ে খুজবেন। এবার আপনি নিজেকে প্রশ্ন করুন এটি আপনি অনলাইনে কিনবেন কিনা এবং কিনলে কি দামে কিনবেন। ঠিক এভাবে কাস্টমারের রুচি ও চিন্তা বুঝে আপনাকে মার্কেটিং করতে হবে।

আপনি যাদের উদ্দেশ্যে বিপনন বা প্রচার চালাবেন। তারা বেশী কোথায় যাতায়াত করে? কোন ধরনের গণমাধ্যম থেকে তারা দুনিয়ার খবর পেতে পছন্দ করে? তাদের বিনোদন মাধ্যম কি? তাদের আর্থিক সঙ্গতি কতটুকু? কিভাবে বিজ্ঞাপন্ দিলে তারা আকৃষ্ট হবে? এড কনটেন্ট কি হবে? কি হবে বিজ্ঞাপনের ভাষা? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুজে নিয়ে তবেই আপনি পরিকল্পনা করুন সুন্দর ও কার্যকর মার্কেটিং কিভাবে করবেন?
সর্বশেষ যে কথাটি বলতে চাই সেটা হলো আমরা বজারে সুনাম তৈরী করার আগেই লাভবান হতে চ্ইা। ফলে শেষ পর্যন্ত আমরা সুনামও পাইনা লাভওনা। তবে কমদামে পন্য বিক্রয় করতে এতটাই কম দামে বিক্রয় করবেন না, যাতে বাজারে এর বিরুপ প্রভাব না পড়ে।

সর্বশেষ কথা হলো। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত ও চীনের বাজার বিশ্লেষণ করে দেখা যায় গত ২/৪ বছরে ই কমার্স সেথখানে অভূতপূর্ব সাফল্য পেয়েছে। স্বভাবতই এর পরবর্তী দেশ বাংলাদেশ। বাংলাদেশে ই কমার্স বাজার ভালোভাবে চলে উঠবে। এখন কথা হচ্ছে সেই বাজারে আপনি আমি শামিল হতে পারছি কিনা?

7,671 total views, 8 views today

Comments

comments