এ পর্বে আমি পার্সোনাল ব্লগিং নিয়ে আলোচনা করতে চাই। পার্সোনাল ডায়েরীর সঙ্গে পার্সোনাল ব্লগিং এর মিল আছে অনেক আর কিছুটা পার্থক্যও আছে। ডায়েরিতে মূলত আমারা প্রতিদিনের ঘটনা লিখে থাকি। পার্সোনাল ব্লগিং এর ব্যাপ্তি আরও অনেক বেশি।

পার্সোনাল ব্লগিং এর সংজ্ঞা গুগোলে যেমনটি পেলামঃ অনলাইনে এক বা একাধিক ব্যক্তি তাদের প্রাত্যহিক জীবনের ঘটনা অথবা বিভিন্ন বিষয়ের উপর তাদের মতামত তুলে ধরেন এ ধরনের ব্লগে। ইতিহাসের দিকে তাকালে প্রায় দেড় দুই হাজার বছর ধরে বিভিন্ন বিখ্যাত লোকের ডাইরির কথা আমরা জানতে পারি। এগুলোর ঐতিহাসিক মুল্য অনেক। তবে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই সাধারণ মানুষের রক্ষিত ডায়েরী হারিয়ে গেছে কালের মহাকালে। তাই আমরা পলাশীর যুদ্ধ নিয়ে সাধারণ মানুষ কি ভাবতো সেসময় তা জানিনা এবং হয়তো কোনদিনই জানতে পারবো না।

পার্সোনাল ডায়েরীর সামাজিক ইতিহাস রচনায় মূল্য অনেক। আজ থেকে ১০ বছর আগের বাংলাদেশের কথা চিন্তা করুন যেখানে ব্লগ বলতে কিছু ছিলনা। তাই মিডিয়া (সংবাদপত্র, রেডিও এবং টেলিভিশন) যা বলত এর বাইরে কোন কিছু জানার খুব কি উপায় ছিল? ব্লগ এল এবং আমি আপনি কি ভাবছি তা সহজেই ব্লগে প্রকাশ করতে পারি।

ডায়েরী ছাড়াও আরও পার্সোনাল ব্লগে অন্য কয়েক ধরনের বিষয় থাকতে পারে। যেমন কেউ হয়তো তার চিন্তা ভাবনা নিয়ে লেখে। অনেক ফ্রিল্যান্স লেখক অনুশীলনের জন্য এ ধরনের ব্লগ বেছে নেন যেখানে প্রতিদিন ৫০০-১০০০ শব্দ লেখার চেষ্টা করেন বা যেসব লেখা ছাপা হয়না সেগুলো দেন। কেউবা রাজনীতি নিয়ে লিখেন বা খেলা নিয়ে বা বিনোদন। অনেকটা শখের বশেই লেখেন। মাঝে মধ্যে এধরনের দু একটা ব্লগ বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠে এবং হাজার হাজার লোক প্রতিদিন পড়েন। তখন এ ধরনের ব্লগ আর শখের বা পার্সোনাল থাকেনা বরং হয়ে উঠে পুরোপুরি টাকা কামানোর যন্ত্র। এতে আমি অবশ্য দোষের কিছু পাইনা। লোকে আপনার লেখা পছন্দ করে তবে তা আপনার দোষ নয় বরং গুণ।

পার্সোনাল ব্লগের দুটি উদাহরণ এখন দিচ্ছি।

Matt Cutts: http://www.mattcutts.com/blog/ ম্যাট কাটস গুগলের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। এটি তার ব্যাক্তিগত ব্লগ এবং এখানে কোন বিজ্ঞাপন নেই। এমনকি ব্লগিং প্লাটফর্ম হিসেবে তিনি ওয়ার্ডপ্রেস ব্যাবহার করেছেন, গুগলের ব্লগার নয়। তিনি এ ব্লগে গুগল, সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন এর মত পাশাপাশি প্রিয় বই, ৩০ দিনে অভ্যাস বদলানো, ম্যারাথনে দৌড়ানো ইত্যাদি বিষয় নিয়ে লিখে থাকেন। তার কোন কোন পোস্টে ৩০০-৪০০ এর মত কমেন্ট আসে। ম্যাট কাটস এ ব্লগে ২০০৫ সাল থেকে লিখছেন।

Jessica Quirk: http://whatiwore.tumblr.com/ জেসিকা কুইরক সেই ২০০৮ সাল থেকে তার What I Wore ব্লগে (মেয়েদের) পোশাক নিয়ে লিখে চলেছেন। প্রথম প্রথম হয়তো কিছুটা শখের বশেই কিন্তু এখন এটাই তার ফুলটাইম ব্যবসা। প্রতি মাসে ১ মিলিয়নের কিছু বেশি পেইজভিউ আসে। তিনি ঘরে, পার্টিতে, অফিসে, ভ্রমণে কি ধরনের পোশাক পড়া উচিত সে বিষয়ে নিয়মিত লিখে থাকেন। প্রচুর ছবি রয়েছে (বেশিরভাগই তার স্বামীর তোলা) এবং রয়েছে অনেক টিপস। সবচেয়ে বড় কথা হল অনেক অল্প খরচে কিভাবে পোশাক আপনাকে সুন্দর ও স্মার্ট করতে পারে তা দেখানই তার মূল লক্ষ্য। জেসিকার ব্লগ এত জনপ্রিয় যে ইউরোপ আমেরিকার সেরা মিডিয়া গুলো তাকে নিয়ে খবর পরিবেশন করেছে, বড় বড় কোম্পানিগুলো তার ব্লগের সঙ্গে মিলে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে, বিভিন্ন কনফারেন্সে জেসিকা বক্তৃতা দিয়ে থাকেন। সর্বোপরি তার একটি বই বের হয় ২০১১ সালে।

বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে পার্সোনাল ব্লগ খুব কম লোকেই পড়ে। কিন্তু তারপরও অনেকে লিখে বেশ আনন্দ পান। এতে হয়তো ব্লগাররা তাদের মনের ভাব প্রকাশ করতে পারেন বা লেখালেখি প্র্যাকটিস করতে পারেন এবং সামান্য কয়েকজন যে পাঠক রয়েছে তাদের জন্য লেখাও বেশ আনন্দ বয়ে আনে। আর যেসব ব্লগার তাদের শখ বা হবি নিয়ে লেখেন সেগুলো থেকে অনেক কিছু জানা যায়। নিজের কথাই বলি। খেতে আমি খুব ভালবাসি এবং অনেক দারুন রেসিপি আমি বিভিন্ন ব্লগ থেকে নিয়ে আমার দু বোনকে দেই। এভাবে বার্গার, পিজা, কাচ্চি বিরিয়ানি, রসমালাই, সন্দেশ, জালি কাবাব- অর্থাৎ যেসব খাবার আগে ঘরে বানানো যায় চিন্তাও করতে পারতাম না সেগুলো এখন ঘরেই মনের আনন্দে খাই।

তবে ব্লগে ব্যক্তিগত তথ্য দেবার ব্যাপারে কিছু সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। প্রথমত খুব বেশি ব্যক্তিগত তথ্য না দেয়াই ভাল। ছবি দেবার ক্ষেত্রেও সতর্ক থাকা ভাল। অফিসের বা কোম্পানির কোন নেতিবাচক তথ্য নিয়ে লেখার আগে এক বার নয় ১ কোটি বার চিন্তা করবেন দয়া করে। আমেরিকাতে প্রায় প্রতিদিনই কেউ না কেউ চাকুরি হারান বা ঝামেলায় পড়েন। সেই সঙ্গে থাকে মামলা ও আইনগত হয়রানির আশঙ্কা। মনে রাখবেন যে ইন্টারনেটে এ যুগে গোপনীয় বলে কিছু নেই আর মুছে ফেললেও কোন কিছুই হারায় না। সামু ব্লগে অনেক লিংকে ক্লিক করে দেখবেন যে পোস্টটি কর্তৃপক্ষ বা ব্লগার মুছে দিয়েছেন বা এমনকি ব্লগটি বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু একটু কষ্ট করে এই ঠিকানায় গেলে https://archive.org/web/ অনেক কিছুই পাবেন যা হয়তো হারিয়ে গেছে বলে মনে করতেন। তাই আবারো বলছি- ব্লগে যে কোন ধরনের ব্যক্তিগত তথ্য দেবার আগে ভাববেন।

বর্তমানে ২০ কোটির বেশি ব্লগ রয়েছে সারা বিশ্বে এবং আমার মনে হয় এর প্রায় ৯৯% হল পার্সোনাল ব্লগ। তবে বেশিরভাগ ব্লগই নিয়মিত আপডেট করা হয়না। নিজের শখ নিয়ে যদি কেউ নিয়মিত লিখেন তবে সে ধরনের ব্লগে কিছু না কিছু পাঠক পাবেন। বাংলাদেশে অনেকের শখ বাগান আর ফুল নিয়ে। কিন্তু এ বিষয়ের উপর তেমন কোন ভাল বাংলা ব্লগের কথা মনে করতে পারছি না। আর আপনি যে বিষয়ের উপর চাকুরি করেন সে বিষয়ের উপর লিখতে পারেন। তাহলে এক সময় এ দিকে আপনাকে এক্সপার্ট হিসেবে গন্য করা হবে।

পরবর্তী পর্বে ব্লগ নেটওয়ার্ক নিয়ে লেখার আশা রাখি।

এমনিতে আমি ব্যক্তিগত জীবনে কথোপকথনে যতটা সম্ভব ইংরেজি শব্দ সচেতন ভাবেই এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি। তবে ব্লগিং একটি নতুন ক্ষেত্র এবং এ দিকে বাংলা শব্দ আসতে কিছুটা সময় লাগবে। তাই ইংরেজি শব্দের ব্যাবহারে আশা করি পাঠকরা বিরক্ত হবেন না।

8,521 total views, 8 views today

Comments

comments

Your email address will not be published.