আবুল খায়ের
অনেক দিন পর লিখছি, তবে আজকের লেখার পিছনে বেশ কিছু কারন রয়েছে। লেখার শুরুতেই আগে একটা ছোট গল্প শোনাতে চাই।
গত কালকে ই-ক্যাব মেম্বার’স জেনারেল মিটিং এবং সার্টিফিকেট বিতরনী অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগ মূহুর্তে আমরা যখন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম ঠিক তখন ষাট উর্ধ একজন সিনিয়র সিটিজেন এসেছিলেন অডিটোরিয়ামে কি হচ্ছে তা জানার জন্য। কথায় কথায় তিনি আমাকে বিভিন্ন রকম প্রশ্ন করতে লাগলেন, ই-কমার্স কি? ই-ক্যাব কি? কেন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এমন ভাবে প্রশ্ন করতে লাগলেন যেন আমি বুঝতে না পারি যে তিনিও ই-কমার্স সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান রাখেন। আমার প্রশ্নের সব জবাব পাওয়ার পরমূহুর্তেই আফজাল ভাই সেখানে উপস্থিত হলেন, এবং তারপর বেশ লম্বা সময় ধরে আমাদের আলোচনা চলতে থাকে। কথায় কথায় ভদ্রলোক ই-কমার্স (অনলাইনে কেনাকাটার) ব্যাপারে তার কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতা আমাদের সঙ্গে শেয়ার করলেন, যেহেতু তিনি বুঝে উঠতে পেরেছিলেন এই ইন্ডাস্ট্রির উন্নয়নের জন্য ই-ক্যাব কাজ করছে।
তিনি আশির দশক থেকে আমেরিকা প্রবাসী, ইদানিং দেশেই থাকছেন। তবে তার মেয়ে এখনো আমেরিকা প্রবাসী এবং বাবা-জন্মদিন, বিবাহ বার্ষিকী, ফাদার্স ডে, মাদার্স ডে সহ বিভিন্ন রকমের বিশেষ দিবসে তিনি সুদূর আমেরিকা থেকে তাদের জন্য কেক, ফুল সহ বিভিন্ন রকমের উপহার পাঠান বাবা-মাকে খুশি করার জন্য।
২০০৫ সালের দিককার একটা ঘটনা তিনি আমাদের সঙ্গে শেয়ার করলেন, তার জন্মদিনে তার মেয়ে তাকে কিছু ফুল এবং কেক অর্ডার করে পাঠিয়েছেন কোনো এক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে, যারা কিনা যুক্তরাষ্ট্র এবং বাংলাদেশে তাদের ব্যাবসা পরিচালনা করতো। তো দুপুর আড়াইটার দিকে তার বাসায় উপহার পৌছানোর কথা ছিলো এবং ওই প্রতিষ্ঠান নির্ধারিত সময়ের এক ঘন্টা আগেই তার বাসায় উপহার পৌছে দেন। উপহার ছিলো ১২ টি তাঁজা গোলাপ এবং ১টি জন্মদিনের কেক। আমি আবারও বলছি ১২ টি তাঁজা গোলাপ এবং একটি জন্মদিনের কেক। তো ভদ্রলোক ডেলিভারি ম্যানের হাত থেকে উপহার নিয়েই জিজ্ঞাসা করলেন আমার উপহার কোথায়?
ডেলিভারি ম্যান ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে উত্তর দিলেন এই তো উপহার স্যার। প্রত্যুত্তরে তিনি জানালেন আমার মেয়ে তো তাঁজা গোলাপের অর্ডার করেছে গোরস্থানের গোলাপ নয়।
এর পর থেকে ভদ্রলোক অনেক বারই ঐ প্রতিষ্ঠান থেকে পন্য অর্ডার করে ধোঁকা খাওয়ার অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন। কিন্তু ওই কোম্পানীর ভুল গুলো খুব একটা বড় ছিলো না, সার্ভিস তারা ভালো দিতে পেরেছিলেন ঠিকই কিন্তু প্রোডাক্টের মান ভালো ছিলো না বলে আজও তিনি ওই কোম্পানীর পিছনে লেগে আছেন এবং আইনানুগ ব্যাবস্থা নিবেন বলেও আমাদেরকে জানিয়েছেন।
যাই হোক, অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতাই আমাদের সঙ্গে তিনি শেয়ার করেছেন যার সব এখানে বলা সম্ভবও নয়। এবার আসি একটু ভিন্ন চিত্রে। ই-কমার্স ক্ষাত নতুন না হলেও আমাদের দেশে এর নব জাগরন হয়েছে।
এই ক্ষাতে চলমান ইন্ডাস্ট্রির প্রতিটি ক্ষাতই জড়িত। পাশাপাশি আরো বেশি সেবা এই ক্ষাতে দিতে হয়। পন্য সাজানোর সার্ভিস আলাদা, অর্ডার করার মাধ্যম আলাদা পন্য পরিবহনের মাধ্যম আলাদা, লেনদেনের মাধ্যম আলাদা। সব কিছু একটি ইলেক্ট্রনিক প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন করতে হয় এবং অবশ্যই অপরিহার্য মাধ্যম হচ্ছে ইন্টারনেট। অনেকেই মনে করতে পারেন ই-কমার্স মানেই শুধু একটি অনলাইন শপ। এমন যদি ভেবে থাকেন, তাহলে আপনি ভুলের স্বর্গে বাস করছেন। ই-কমার্স একটি বৃহৎ ইন্ডাস্ট্রি, যা চলমান সকল ইন্ডাস্ট্রির মাদার ইন্ডাস্ট্রি।
এখানে বহুবিধ জিনিস সম্পৃক্ত। তো এই ইন্ডাস্ট্রিতে বিনা বিনিয়োগে ব্যাবসা করা সম্ভব আবার মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেও ব্যাবসা পরিচালনা করা সম্ভব।
এবার যারা ভাবছেন বিনা বিনিয়োগে রাতারাতি আলিবাবার মতো একটা প্রতিষ্ঠান দাঁড় করানো যায় এই ইন্ডাস্ট্রিতে এবং হুটহাট নেমে পড়ছেন তারা ঘোরের মধ্যেই আছেন বলে আমার মনে হয়। একবার আলিবাবা গ্রুপের দিকে তাকান, তাদের কর্মীর সংখ্যার দিকে তাকান, তাদের কোম্পানীর বাজার মূল্যের দিকে তাকান। সম্ভব হবে রাতারাতি এরকম কিছু করে ফেলা?
অবশ্যই না, এমন কিছু করতে গেলে দরকার অজস্র অভিজ্ঞতা, মেধা, জনবল, অর্থ, নেটওয়ার্ক, ক্রেতা সহ অনেক কিছু। যেটার হিসাব একটা মস্তিষ্কে ধারন করা দূসাধ্য ব্যাপার।
বেশ কিছু উদ্যোক্তা আমাকে ব্যক্তিগত ভাবেই জিজ্ঞাসা করেছেন, ভাই হতাশার মধ্যে আছি, ক্রেতা পাচ্ছি না অর্ডার পাচ্ছি না, সাড়া পাচ্ছি না ইত্যাদি ইত্যাদি।
আপনাদের উদ্দেশ্য বলি ভাই আপনারা এই প্রশ্নের আগে কিছু প্রশ্ন করতে ভুলেগেছেন বা সেই সব প্রশ্নের উত্তর না জেনেই নেমে পড়েছেন এবং ঝামেলার মধ্যে পড়ে গেছেন।
আপনি যখন বিনা বিনিয়োগেই ব্যাবসা শুরু করবেন তখন জগতের সব পন্য নিয়ে কাজ করার মত এত বড় একটা ভুল করছেন কেন?
এর দ্বারা আপনি যে কতবড় ভুল করছেন একটু ভেবে দেখুন। একার পক্ষে কখনো সম্ভব কি ১ হাজার পন্যের ব্যাবস্থাপনা করা? সম্ভব হাজার হাজার ক্রেতার প্রশ্নের উত্তর দেওয়া? সম্ভব তাদের শতভাগ পন্যের মান এবং সেবা নিশ্চিত করা?
যদি উত্তর না হয়, তাহলে একটু গভীর ভাবে ভাবুন, এবং আপনার ব্যাবসার কৌশল পুনঃর্বিবেচনায় আনুন। কিভাবে আনবেন?
খুবই সহজ একটা হিসাব।
সবার আগে আপনার নির্ধারন করতে হবে আপনি আপনার পন্য নিয়ে কতদূর নিশ্চয়তার সঙ্গে পৌছাতে পারবেন। অর্থাৎ যেখানে পন্য ডেলিভারি করছেন সেখানে নিরাপদে এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আপনার পন্য পৌছানো সম্ভব কিনা। যদি সম্ভব না হয়, তাহলে আগে হিসাব মেলান কোথায় কোথায় আপনার দেওয়া সম্ভব। যেখানে সেবার মান ৮০/১০০ ও থাকবে ওই স্থানে সেবা দেওয়ার প্রবনতা থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করুন। অহেতুক সারাদেশে সেবা দিতে পারবেন এরকম ঘোষনা বা প্রতিশ্রুতি দেওয়া থেকে দূরে থাকুন। সেবার মান বিভিন্ন দিক থেকে বিবেচনা করা হয়।
ব্যাবহার, সময়, উপস্থাপনা আরো অনেক বিষয়াবলি জড়িত এর সঙ্গে। কাজেই যেখানে শতভাগ মান সম্পন্ন সেবা নিশ্চিত করতে পারবেন ঐ সমস্ত জায়গাতেই আপনার সেবা বহাল রাখুন এটা আপনাকে সব চেয়ে বেশি এগিয়ে রাখবে।
এরপর আসুন পন্যের মানের দিকে। আপনি ঠিক কত ধরনের এবং কত গুলো পন্যের শতভাগ গুনগত মান নিশ্চিত করতে পারবেন ঠিক ততো গুলো পন্য নিয়েই কাজ করুন এর বেশি পন্য নিয়ে যখন কাজ করতে যাবেন, তখন দেখবেন, সুবিধার চাইতে অসুবিধায় বেশি পড়বেন মামলা-মোকদ্দমার শিকারও হয়ে যেতে পারেন।
একটা কথা জেনে রাখবেন মান সম্পন্ন পন্য এবং সেবাই হচ্ছে ব্যাবসাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রধান হাতিয়ার। কেউ দ্বিমত পোষন করে থাকলে আপতত তাকে সমর্থন জানাতে পারছি না।
ক্রেতার ভাষা বোঝার চেষ্টা করুন, তারা আসলে কি চায়, এবং কি চায়না সেটা উপলব্ধি করুন এবং সেভাবেই আপনার ব্যাবসার প্রতিটি জিনিসকে সুন্দরভাবে সাজান।
ক্রেতার আসলেই অভাব নেই। আপনি ভেবে দেখুন বেঁচে থাকার জন্য মানুষের অবশ্যই কিছু মৌলিক চাহিদা রয়েছে, চলার পথে রয়েছে হরেক রকমের চাহিদা এবং বিলাসিতা। কাজেই এসব মানুষ কিনেই গ্রুহন করে। এগুলো নিয়ে যদি কাজ করেন তাহলে সারা দেশে আপনার সাড়ে ষোল কোটি ক্রেতা। এতো ক্রেতা যদি একাই সামলাতে যান তাহলে, বিপদ নয়, মহা বিপদে পড়বেন। একটু ভিন্ন ভাবে ভাবুন, প্লান সেট করুন, প্রয়োজনে বেশি করে সময় নিন সব কিছুর হিসাব যখন শতভাগ নিশ্চিত করতে পারবেন, তখনই নামুন। হুজুগে আসলে নিজেই বেশি বিপদে পড়বেন, পাশাপাশি ইন্ডাস্ট্রিরও ক্ষতি এবং বদনাম হবে। একজনকে ভালো পন্য বা সেবা দিতে পারলে ওই একজনই আপনার ব্রান্ডকে আকাশে তুলে দেবে, বগুড়ার দই, টাঙ্গাইলের চমচম, শাড়ি, ঢাকার জামদানী, কিংবা কুমিল্লার রসমালাই এমনি এমনি মানুষের মুখে মুখে সুনাম পায়নি। শুধু এসব কারনেই পেয়েছে।
লেখাটাকে খুব বেশি দীর্ঘায়িত করতে চাই না। যারা ই-কমার্সে নেমেছেন বা নামার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তাদেরকে বলি, মার্কেটটা অনেক বড় এখনে যত বড় বড় কোম্পানীই আসুক না কেন, ছোট ছোট কোম্পানীও থাকবে এবং সুনামও কুড়াবে। কাজেই ভেবে চিন্তে নামুন ভালো দিন অপেক্ষা করছে সবার জন্যই। ভবিষ্যৎ এবং সম্ভাবনা সবই ই-কমার্সে রয়েছে। এক টাকার পন্য হলেও সেটার গুনগত মান ধরে রাখতে পারলে ওই এক টাকার পন্যের কোম্পানীটিই একদিন বিলিয়ন ডলারের কোম্পানী হয়ে যেতে পারে। জগত জুড়ে যেসব কোম্পানী দাপটের সঙ্গে ব্যাবসা করছে সবই কোনো এক সময় জিরো থেকেই শুরু হয়েছিলো। কাজেই নিজের মেধা, শ্রম, এবং অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে পারলে কে জানে আপনার কোম্পানীও একদিন অ্যাপল, মাইক্রোসফট বা আলিবাবার মত একটা কোম্পানিতে পরিনতে হয়ে যেতে পারে।
তো এলোপাথাড়ি না চলে হিসেব মত আগানোর চেষ্টা করি। সকলের ব্যাবসায়িক উন্নতি এবং সফলতা কামনা করছি।
লেখাটি অনেকের ইনবক্সের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সার্থে লেখা। ধৈর্য ধরে আমার সীমিত জ্ঞানের লেখাটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
7,679 total views, 2 views today