ব্যবসায়ের  লাভ লোকসান প্রসঙ্গ
জাহাঙ্গীর আলম শোভন

লাভ এবং লোকসান দুটোই ব্যবসায়ের অংশ। তবু কেউ লোকসান দিতে চায়না। সবাই লাভ করতে চায়। অথচ কখনো সবাই লাভ করতে পারে না। কাউকে না কাউকে লোকসান গুনতে হয়। কিন্ত আসলে বেশীরভাগ মানুষের লাভ করার সুযোগ রয়েছে প্রকৃত পক্ষে ঘটেও তা। আবার ফিরে যাই সেই নৈমিত্তিক উদাহরণে। আমরা প্রতিনিয়ত যে লেনদেন করি যেমন সকালে চাল ডাল কেনা, ফেরিওয়ালার কাছ থেকে সবজি কেনা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা কেনা, হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা কেনা। এগুলো কি লাভজনক লেনদেন? এগুলো লাভ জনক না হয় তাহলে আমরা এগুলো করি কেন? আর কোন উপায় নেই তাই?

আচ্ছা আমরা ৫ টাকা দিয়ে একটা বলপেন কিনে কি মনে করি আমরা নিশ্চয় ভাবি যে আমরা প্রকৃত অর্থে ৫ টাকার একটা পন্য বা সেবা খরিদ করেছি এবং সত্যি কথা তাই ঘটেছে। এখন ৫ টাকার কলমটাতে এর উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানও কিন্তু লাভ করেছে। লাভ করেছে পাইকার এবং খুচরা বিক্রেতাও। প্রশ্ন হচ্ছে এত লাভ কোত্থেকে আসলো। ব্যবসা আসলে খেলা নয় যে এখানে এক পক্ষ লাভবান হলে আরেক পক্ষকে ক্ষতিগ্রস্থ হতে হবে? এখানে ক্রেতা বিক্রেতা উভয়ের লাভ করার সুযোগ আছে।  ব্যবসাতো ব্যবসা। তাহলে ব্যবসার  লাভটা কোত্থকে আসে।

প্রথমত: লাভটা আসে প্রকৃতি থেকে। আমরা যত রকমের পন্য ব্যবহার করিনা কেন এসবের মৌলিক উপাদান পাই আমরা প্রকৃতি থেকে। একজন কৃষক যে পরিমাণ শ্রমঘাম দিয়ে ফসল ফলায় বিধাতা যদি তাকে ঠিক সেই পরিমাণ ফল বা শক্তি দিতো তাহলে কি হতো। কৃষক অন্যান্য কাজ করার এনার্জি পেতোনা। অথচ কৃষকের যদি পর্যাপ্ত জমি থাকে তাহলে ফসল ফলিয়ে নিজের খেয়ে আবার বাইরে বিক্রি করতে পারে বলে আমরা যারা কৃষক নয় তারাও চাল ডাল খেতে পারি।

দ্বিতীয়ত হলো মুদ্রা: মুদ্রার প্রচলনের কারণে আমাদের সম্পদ কিন্তু দ্বিগুন হয়ে হয়ে গেছে। যদি মুদ্রা না থাকতো তাহলে ঐ পরিমাণ সোনার জন্য আমাকে হয়তো সেই বাজারমূল্যের সমপরিধান শষ্য দিয়ে সোনার বিনিময় করতে হতো। এখন সেটা করতে হচ্ছেনা। আমরা যখন এক লক্ষ টাকার সোনা লেনদেন করি তখন এক লক্ষ টাকাও লেনদেন হয় মানে দুই লক্ষ টাকা লেনদেন হচ্ছে। কিন্তু মুদ্রা সরাসরি আমাদের কোন কাজে লাগেনা, আবার সব কাজেই লাগে।  মুদ্রা বেলন্ডিং করে শরবত বানানো যায়না, টাকা গেঁথে জামা সেলাইকরা যায়না, এমনকি টাকার পিলার দিয়ে ঘর তোলা যায়না। আবার এইসবগুলো কাজই টাকা দিয়ে করা যায়।

তৃতীয়ত অর্থ প্রবাহ: অর্থপ্রবাহই আধুনিক সভ্যতার উন্নয়নের চালিকাশক্তি। টাকা বাড়িওয়ালার কাছ থেকে ডেভলপারএর হাতে যায় এই ফাঁকে একটা বাড়ি তৈরী হয়ে যায়। টাকা মলিকের কাছ থেকে শ্রমিকের কাছে যায় এই সময়ে ৫ লাখ পিস শার্ট তৈরী হয়ে যায়। অর্থের প্রবাহ যেমন উন্নয়ন নিশ্চিত করে তেমনি লেনদেনের ক্ষেত্রে লাভের জন্য অর্থপ্রবাহের একটা ভূমিকা থাকে।

তাহলে আমরা এটকুকু বুঝলাম যে একটা ব্যবসা বা লেনদেনে সকলের বা উভয় পক্ষের বা সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের লাভ করার সুযোগ রয়েছে।

আমরা আরো জেনে নেই, কিভাবে ব্যবসায় করলে লোকসানের ঝুকি কম থাকবে?

10-033-FEAC-Chefs_F

১. জেনেবুঝে শুরু করা:

অবশ্যই যা করবেন তার সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে নেবেন। না জেনে যেমন ইবাদাত বন্দেগী প্রার্থনাও করা যায়না। ব্যবসাও তাই। অনেকেই ব্যবসাকে পূজা বা প্রার্থণা বা ইবাদাত মনে করে থাকেন। ইসলামের দৃষ্টিতে কেউ যখন হালাল ভাবে সহিত নিয়তে ব্যবসা করে সেটা ইবাদাত বলে গন্য হয়। হিন্দুরা ব্যবসার আলাদা পূজা পার্বণ করে থাকেন। তাই না জেনে শুরু করা ঠিক নয়।
২. সঠিক পরিকল্পনা

আপনার ব্যবসার জন্য চাই সঠিক পরিকল্পনা। পরিকল্পনা যেন এমন না হয় যে ‘‘পরীরা’’ উড়ে যায় আর ‘‘কল্পনা’’ পড়ে থাকে। ব্যবসায়ের সংশ্লিষ্ট প্রতিটি কাজ কিভাবে, কোনধাপে করবেন সেটা আগে থেকে নির্ধারণ করা চ্ইা। এর অর্থ এই ন্য়ে যে যেভাবে নির্ধারণ করবেন সব সময় তার উপর অটল থাকবেন। প্রয়োজন মোতাবেক আপনি পরিস্থিতি অনুযায়ী কিছু পরিবর্তন করতেই পারেন তবে পূর্ব পরিকল্পনার বিকল্প নেই।

৪. মার্কেট এনালাইসিস:

ব্যবসার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আপনি যে পন্য নিয়ে নামতে চান তার চাহিদা যোগান ভবিষ্যত ও প্রয়োজনীয় নাড়ি নক্ষত্র। এবং পন্যটির ব্যাপারে পাবলিকের সেন্টিমেন্ট জানতেও ভুলবেন ন॥

৫.ছোট ভাগে ভাগ করা

আধুনিক মালয়েশিয়ার রুপকার মাহথির মোহাম্মদ বলেন যে, ‘‘স্বপ্ন দেখতে হয় অনেক বড়ো করে কিন্তু সেটাকে এচিভ করতে হয় অল্প অল্প করে’’। আপনার বেলাও একই কথা প্রযোজ্য। আপনি অবশ্যই বড়ো কিছু করার কথা ভাববেন। তবে বাস্তবায়ন করার জন্য কাজটাকে সময়ের ফ্রেমে ছোট ছোট করে ভাগ করে নেবেন। আপনি দেখুন ঢাকার রাস্তায় কতো বিশাল ফ্লাইওভার সরকারের উন্নয়নের দৃষ্টান্ত হয়ে জল জল করছে। অথচ সেটা ছোট ছোট ভাগে ভাগ করা এবং বানানো হয়েছে সেরকম ভাবেই। ফলে এতে কোন একটি অংশ যদি ক্ষতিগ্রস্থ হয় পুরো পক্রিয়ায় তার প্রভাব পড়বেনা।

৬.ব্যক্তিগত যোগ্যতার

ব্যক্তিগত কিছু যোগ্যতার কথা না বললেই নয়। ব্যবসায়িক জ্ঞান ব্যবসায়ের জন্য জরুরী সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। আপনার পরিশ্রম করার মানসিকতা না থাকলেই নয়। থাকতে হবে সে কাজটি করছেন তার প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা এতটুকু না থাকলে আমি অন্তত আপনাকে কাজটা করতে নিষেধ করবো। একনিষ্ঠতা আত্মবিশ্বাস, ধৈর্য আর সততাও প্রতিটি ব্যবসায়ীর জন্য একান্ত অপরিহার্য। আমি অবশ্য সবসময়ের মত এখনো বলবো আপনার দেশপ্রেম ও সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধও থাকা চাই।

৭. ব্যালেন্সডও ম্যাচিউরড:

আমি সবসময় বলি যে সমাজে একজন সুষম পরিপূর্ণ মানুষের প্রয়োজন রয়েছে। তিনি হয়তো খুব প্রতিভাবান বা অনেক মেধাবী নন, তিনি হয়তো মহাপুরষদের মতো মহান নন, তিনি হয়তো অনেককিছু জানেন না। কিন্তু তিনি ব্যালেন্সড। তিনি অতি বোকা বা অতি রাগী নন, তিনি সহজে খুশি বা সহজে হতাশ হয়ে যান না। তিনি অল্প কথায় হেসে কটিকুটি হন না, অথবা একেবারে রাশভারীও নন। একজন ব্যবসায়ীর মনে হয় ব্যালেন্সড হওয়াাটা জরূরী। তিনি এমন হবেন যে প্রয়োজনে তিনি এক যোগ্য শিশুর আনুগত্য করতে পারেন। আবার সময়মত তিনি হাজারো লোকের নেৃতৃত্ব নিতে পারেন। নেতৃত্ব  ও আনুগত্যের এই দ্বৈত যোগ্যতা মানুষকে তার সমাজে শক্ত আসন গাড়তে সাহায্য করে। এজন্য আমি হয়তো আপনাকে হয়তো একটা কাজ নিজে করতে জানতে হবে অথবা কাউকে দিয়ে করাতে জানতে হবে। আর যদি এ দুটোর একটাও না জানেন আপনার নিজের কোন কাজের উদ্যোাগ নেয়ার প্রয়োজন নেই।
 
এবার আসি ব্যবসায়ে লাভ করতে হলে কি করা যায়?

ঝুকিমুক্ত:
ব্যবসায়ের প্রথমদিকে অবশ্যই তুলনামুলক ঝুকিমুক্ত খাত বেচে নিবেন। একজন অনভিজ্ঞ লোকের জন্য ঝুকি ডাবল বিপদ নিয়ে আসতে পারে। এক্ষেত্রে বিনিয়োগের পরিমাণও প্রথম দিকে কম করবেন এবং ধাপে ধাপে করবেন।

কিনতেই লাভ:
অনেকে বলে থাকেন যে ব্যবসায়ে আসলে বিক্রি করার সময় লাভ হয়না। কারণ প্রতিটি পন্যের একটা মার্কেট ভ্যালু থাকে। আপনি যদি কিনতেই লাভ করতে পারেন তবেই আপনার লাভ। এক্ষেত্রে  আপনাকে ব্যবসায়িক কাজের প্রতি ক্ষেত্রে খরচের ব্যাপারে সর্তক থাকতে হবে। কোথাও যেন বাড়তি কোন খরচ না যায়। সম্ভব হলে আপনি অবশ্যই চেস্টা করবেন স্বাভাবিকের চেয়ে একটু হলেও কম খরচ করতে।

ঝুকি তহবিল
ব্যবসায়ের ঝকি মানে লোকসানের আশংকা। লোকসানের ঝুকি যেহেতু রয়েছে। আপনি ব্যবসায়ের শুরুতে কিছু টাকা ঝুকি তহবিলে রেখে দিতে পারেন। সেটা ১০% হতে পারে আবার ২০% হতে পারে। যেকোন সময় এ তহবিল থেকে আপনি সাহায্য পেতে পারেন। আবার অল্পকিছু লোকসান হলে সেটা তহবিল থেকে পূরন করলেও করতে পারেন।

লাভের হিসাব
মনে রাখবেন লাভের হিসেবের ব্যাপারে আপনাকে কিন্তৃ পাক্কা হতে হবে। যেমন আপনি মনে রাখবেন যে আপনার টাকা যতবেশী রুলিং করবে তত আপনার লাভ আসেব। উদাহরণ দিয়ে বলা যাক। আপনি যদি ১ লক্ষ টাকা নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। তাহলে আপনার টাকা যদি প্রতিমাসে ২ বার রুলিং হয় তাতে আপনি যদি ৫% লাভ করে থাকেন তাহলে আপনার বার্ষিক লাভ দাড়াবে। ৫গুণণ ২৪ মানে ১২০% আর যদি আপনার ৫০% লাভও হয় সেটাকা যদি বছরে একবার রোল করে তাহলে আপনার লাভ হবে ৫০%ই। সূতরাং বিষয়টি মাথায় রেখে লাভ লোকসানের হিসাব করুন।

উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা
উৎপদনের সাথে আমরা পরিচিত। কিন্তু উৎপদনশীলতা শব্দটা অনেকের কাছে নতুন মনে হতে পারে। গত একযুগ ধরে আমাদেও দেশে কর্পোরেট লেভেলে শব্দটার ব্যবহার বেড়েছে। উৎপদনা আমরা হয়তো বুঝি কোনিকিছু তৈরী বা উৎপাদন করা কিন্তু উৎপদনশীলতা কি?
একটি নির্দিস্ট পন্য উৎপাদনের উপকরন সমূহ প্রত্যাশিত পন্য ও সেবা উৎপাদনে কতটা কার্যকরভাবে ব্যবহার করা হয়েছে তার পরিমাপকই হল উৎপাদনশীলতা। উৎপাদনের উপকরন ব্যবহারের দক্ষতা বা কার্যকারিতাকেও উৎপাদনশীলতা বলতে পারি। একই পরিমান পুজি, শ্রম ও অন্যান্য উপকরন ব্যবহার করে অধিক পরিমান উৎপাদন পাওয়া গেলে বলা হয় উৎপাদনশীলতা বাড়ে। অন্যকথায় উৎপাদনশীলতা হলো কম সম্পদ প্রয়োগে বেশি উৎপাদন বা কম সম্পদের মাধ্যমে একই পরিমান পন্য বা সেবার উৎপাদন।
উৎপাদনশীলতা সব সময় উন্নয়নের গতি নির্দেশ করে। প্রত্যাশিত মান সম্পন্ন পণ্য কত দ্রুত তৈরি হয় সেটাকে উৎপাদনশীলতা হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এই উৎপাদনশীলতার তত্ব আমরা ব্যবসায়ে ব্যবহার করতে পারি। তাহলে এটা আমাদেও লাভ লোকসানের ক্ষেত্রে একটি ইতিবাচক ফল বয়ে আনতে পারে।

ব্যয়বন্টন ও সুষম বাজেট তৈরী
কোন পন্য সংগ্রহ বা উৎপাদনের খরচের বাইরেও ব্যবসায় আমাদের কিছু খরচ থাকে। যেমন অফিসিয়াল খরচ, মার্কেটিং কস্ট, ভ্যাট, এডমিনিস্টেটিভ কস্ট, আর পন্যমূল্যবৃদ্ধিজনিত খরচ। আমাদেরকে পরিকল্পনা প্রণয়ন, বাজের তৈরী এ্বং লাভ লোকসানের কাংখিত চিত্র তৈরী করতে এ বিষয়গুলো দেকতে হয়। কখনো এমন হয়নাযে অনুৎপাদনশীল খাতে খুব বেশী বিনিয়োগ বা খরচ হয়ে গেছ। কারণ পন্যের উৎপদনমূল্যের সাথে কত শতাংশ আনুসাঙ্গিক খরচ হতে পারে তার একটা প্রচলিত মার্কেট রেওয়াজ আছে সেটা যদি সীমা অত্রিকম করে তাহলে তা লাভ লোকসানকে প্রভাবিত করবে এটাই স্বাভাবিক। সূতরাং এ ব্যাপারে যতœশীল হতে হবে।

ব্যবসায়ের সুনাম ব্যবসায়ের সম্পদ
যারা ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে পড়েছেন তাদেরকে এটা নতুন করে শেখানোর কিছু নেই। ব্যবসায়ের সুনাম ব্যবসায়ের সম্পদ। কাল যদি পেপসি কোম্পানী শুধু তাদের নামটা বিক্রি করতে চায়, তাও মিলিয়ন ডলার দাম পাবে। ভেবে দেখুন একজন ক্রেতা মিলিয়ন ডলার দেবে অথচ একটা বোতলও পাবেনা পাবে শুধু পেপসি শব্দটা ব্যবহারের অনুমতি। তাহলে আপনি যদি একটি ইকমার্স শপ খোলেন। বছরে আপনি যা লাভ লোকসান করুন আপনি যদি এর একটি ইতিবাচক ব্রান্ডিং করতে পারেন। আপনার যদি কয়েক হাজার কাস্টমারের একটি কাস্টমার ব্রান্ড থাকে অথবা লাখো মানুষের কাছে এর পরিচিতি তাকে তাহলে হয়তো কেউ আপনার ২০ হাজার টাকা দিয়ে বানানো ডোমেইন হোস্টিংসহ নামটা ২ লক্ষ টাকা দিয়ে কিনতে রাজি হবে। আপনার যদি এরকম একটা ব্যান্ডি বা সুনাম থাকবে আপনি সুনামের মূল্য দিয়েই লোকসানের একটা বড় অংশ রিকার করতে পারবেন।

13,210 total views, 4 views today

Comments

comments