ক্রিয়েটিভ মার্কেটিং

কিছু ধারণা বাস্তব থেকে আলাদা

জাহাঙ্গীর আলম শোভন

 

আমাদের দেশে সমাজে যেমন নানা কুসংস্কার থাকে। ব্যবসা ও পেশার ক্ষেত্রে নানা মিসকনসেপশন থাকে। ফলে তরুনরা অনেক সময় ভুল পথে পরিচালিত হয়। উদ্যোক্তাদের আমি আজ এমন কিছু জিনিস সম্পর্কে মিসকনসেপশনগুলো তুলে ধরব। যাতে তারা একই ভুল না করেন। আপনাদের মনে থাকতে পারে বছর বিশেক আগে কিছু কোম্পানী আইটি শিক্ষার নামে পুরো একটা জেনারেশনকে স্রেফ কম্পিউটার অপারেটিং এর কিছু কোর্স শিখিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। টাকার চেয়ে বড়ো ক্ষতি হয়েছে যেসব তরুন আইটি প্রশিক্ষণ মনে করে বা জীবন বদলে যাওয়ার কোর্স মনে করে ওয়ার্ড এক্সেল শিখেছে এবং তাদের প্রতিভা ও সম্ভাবনা থাকা সত্বেও আরো বেশী কিছু প্রোগ্রামিং বা উচ্চতর জ্ঞান থেকে বঞ্চিত হয়েছে তার দায় কি কেউ নেবে? আমি বলছিনা েএমএসওয়ার্ড, এক্সল, পাওয়ারপয়েন্ট এগুলোর প্রয়োজন নেই। আমি বলতে চাই এগুলো শিখে কি কারো জীবন পরিবর্তন করা সম্ভব। একজন কম্পিউটার অপারেটর নিশ্চই জীবন পরিবর্তনের পেশা নয়।

আজো এমন ভুল বার্তা তরুন সমাজকে দিয়ে তাদের ভুল পথে পরিচালিত করা হচ্ছে। নিচে দেখুন সেগুলো। এর মধ্যে অন্যতম হলো এফ-কমার্সকে বলা হচ্ছে ই-কমার্স। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমএলএম চালানো হচ্ছে ই-কমার্সের নামে। এ ধরনের প্রতারণা থেকে বাঁচতে ফ্যাক্টগুলো আজই জেনে নিন। আসুন আজ এমন কিছু ধারণা বদলে নিই, যেগুলো জীবনে চলার পথে সহায়ক হবে, যেকোনো স্খানে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে সাহায্য করবে সর্বোপরি জীবন ওজীবিকিা গঠন ভূমিকা রাখবে।

ব্যবসায় মানে শুধু বেচাকেনা নয়

শুধু চাকরী নয় ব্যবসার ক্ষেত্রে আমাদের দেশের তরুনরা ভুল ধারণা পোষন করেন। তারা মনে করেন ব্যবসা মানে হলো বেচা কেনা আর লাভ করা। এই ধারণা ভুল। ব্যবসায় মানে হলো অনবরত সেবা, স্থায়ী সম্পর্ক আর কাস্টমারের সমস্যার সমাধান।

দেখুন এর সাথে বেচাকেনার সম্পর্ক হলো একেবারে লাইনের শেষ মাথায়। মানে আপনি যে পন্য বা সেবা বিক্রি করেন সেটা কিন্তু মানুষের একদিন কিনলেই হয়ে যায়ণা সেটা ধারাবাহিকভাবে প্রয়োজন হয়। এমনকি আপনি যদি কাপনের কাপড়ও বিক্রি করেন। একটি পরিবারের সেটা কিন্তু একদিনের পন্য নয়। পরিবারের লোকেরা যতদিনে বংশ পরষ্পরায় বেঁচে থাকবে ততদিন মরতে থাকবে আর ততদিন পন্যটি লাগবে। তাহলে আজ কোনোমতে বেচে সঠিক পন্য সঠিকভাবে না দিয়ে শুধু লাভ পকেটে ঢুকালে কাল কি হবে সেটা বুঝতেই পারছেন।

এবার আপনাকে অবশ্যই স্খায়ী সম্পর্কের কথা ভাবতে হবে। যেটা ভাবলে আপনার ব্যবসায় ভবিষ্যতেও হবে। কারণ আজ ১ হাজার টাকার জায়গায় ২ হাজার টাকা লাভ করলে আপনার জীবন বদলে যাবে না। আপনাকেও ভবিষ্যতে কিছু বিক্রি করে খেতে হবে। তাই সম্পর্কটাই আসল। আর শুধু কম দামে ভালো পন্য দিলেই সম্পর্কটা খাসা হয়ে যাবে এমন মনে করা ঠিক নয়। বরং আপনার আচরণ, বিক্রয় পরবর্তী প্রতিক্রিয়া, কাস্টমারের ভালোমন্দ বোঝার মনোভাব যেমনটা একটা সম্পর্কের জন্য প্রয়োজন হয়, সেটা দরকার হবে।

মনে রাখবেন আপনি কোনো সেবা বা পন্য বিক্রি করছেন মানে আপনি প্রয়োজন মেটাচ্ছেন ও সমস্যা সমাধান করছেন। আসলে পন্য কিনে আনলেই কারো সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়না। একটা টুথব্রাশের মতো সিহজ পন্যও কিনে নেয়ার পর যথাযথ সন্তোসজনক পর্যায়ে ভোক্তার প্রয়োজন পূরণ কিংবা সমস্যার সমাধান করছে কিনা সেটা ভাবতে হবে।

 

চাকরী মানে ৯টা ৫টা অফিস নয়

বেশীরভাগ মানুষ মনে করেন। একটা চাকরী করবো সেখানে সকালে যাবো বিকেলে আসবো। এইটুকু ধারণা সবার কাছে আছে। যেটা আমরা অেনেকে ভাবি না। সেটা হলো এই ৯টা ৫টা সময়ে আমি অফিসে করবো টা কি? আমাকেতো একটা কাজ করতে হবে। তা না হলে মালিক বেতন দিবে কেন? আচ্চা ভালো কথা, আমিতো কম্পিউটার জানি, কম্পিউটারে যা কাজ দিবে তাই করবো।

পুরো ব্যাপারটা কেউ যদি এভাবে ভেবে থাকনে। তাহলে এখনি ভুলে যান। প্রথমত, আপনার একটা অফিস টাইম অবশ্যই থাকবে তারমানে এই নয়যে এটা মেপে কাজ করতে হবে। একটা কর্মক্ষেত্রে হয়তো কোনো সেবা বিক্রি করা হয় নয়তো পন্য সেটাকে ভোক্তাদের জন্য উপযোগী করার জন্য প্রয়োজনে সময়ের এই বেল্ট ঠিক থাকবেনা। মানে সময়টা বড়ো নয় কাজটা শেষ করাই আসল কথা।

দ্বিতীয়ত, কোনো একটা কাজ করবো, যেটা দিবে সেটা করবো। এটা ভাসা ভাসা ধারণা এই ধারণা আর কাজ দিয়ে ভেসে থাকে যাবে। কিন্তু গভীরে ডুব দেয়া যাবে না। আর সাফল্যের চাবিটিা যে, কাজলা দিঘীর গভীরে েএক বাক্সে লুকানো সেটাতো তাহলে পাওয়া যাবেনা। মোটকথা হলো যে কাজই করি না কেন সেটা দায়িত্ব নিয়ে করতে হবে। সেটার ভুল-শুদ্ভের দায়িত্ব, সে কাজের বেটার রেজাল্ট উপহার দেয়ার দায়িত্ব। তখন আপনি অন্যদের চেয়ে আলাদা হবে। দায়িত্ব নেয়ার মাধ্যমে যে নেতৃত্ব চর্চা করবেন সেটাই আপনাকে নিয়ে যাবে বহুদূর।

 

পেশা মানে একদিনের সেবা নয়

চাকরীর ও ব্যবসায় যেমন একদিনের নয়। কোনো পেশাও তাই হোক সেটা হাউজ টিউটর, হোক ডাক্তার প্রকৌশলী কিংবা আইনজীবি। মূলত নিজের কাস্টমার ধরে রাখার মাঝেই এসব পেশা টিকে থাকা ও সাফল্যের প্রশ্ন। আমরা যেমন ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট রাখি অথবা সরকারী চাকরী শেষে পেনশন পাই। তেমনি আমি যদি লয়াল কাস্টমার ব্যাংক গড়ে তুলতে পারি। কাস্টমার ব্যাংকের কাস্টমারদের সেবা দিয়েই আমি পেশাগত জীবনে উন্নতি করতে পারি।

 

ইংরেজী জানা মানে শুধু গ্রামার বা ভাষা নয়

পেশাগত কারণে অনেকে সামাজিক ও স্ট্যাটাসের জন্য কিংবা বিদেশ যাওয়ার জন্য েইংরেজী শিখেন। এটা ভালো দিক। কিন্তু বেশীরভাগ লোক ইংরেজী গ্রামার ঠিক করতে গিয়ে আর ভাষাটা শিখতে পারে না। মনে রাখা উচিত আমরা যেমন ভাষা আগে শিখেছি বাংলা ব্যাকরণের ধারণাটা পরে নিয়েছি। চাইলে আপনি ইংরেজীর ক্ষেত্রেও তাই করতে পারেন। তবে যেহেতু এটা বিদেশী ভাষা আর আমরা বড়ো হয়ে শিখছি সেজন্য কিছু প্রাথমিক নিয়ম অনুসরণ করে ভাষাটা আগে রফ্ত করে নিন। এর জটিল নিয়মগুলো না হয় পরেই জানবেন।

 

কম্পিউটার কোনো কাজের নাম নয়

চাকরীর ইন্টারভিউতে অসংখ্য প্রার্থীকে জিজ্ঘেস করেছিলোম। চাকরী পাওয়ার জন্য কি শিখেছেন। অফিসে কাজ করার জন্য আপনি কি জানেন? প্রায় সবাই বলে কম্পিউটার জানি।  মোর জালারে। কমপিউটারতো একটা যন্ত্রের নাম। তাহলে মোবাইল জানি, টেপ রেডিও জানি এসব বলিনা কেন?

ও আচ্চা এতে তারা বোঝাতে চেয়েছেন তারা কম্পিউটার অপারেট করতে জানেন। ভালো কথা। অফিসে কি বস বলবে, ওহে সুমন সাহেব জানতো আমরা জন্য কমপিউটার অপারেট করে নিয়ে আসেন।

তা নিশ্চয় নয়। কিছু কাজ দেবেন। মানে কি লেখার কাজ? তাহলে কি আপনি কমপিউটার অপারেটর হিসেবে চাকরী করতে চান?

না ঠিক তা নয়?

তাহলে।

মূল কথায় আসা যাক। আমাদেরকে যেকোনো একটা কাজ জানতে হবে। হতে পারে সেটা হিসাব রক্ষন, বিপনন, মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা কিংবা টেকনিক্যাল কিছু তাহলে সে কাজটা আমি কমপিউটার ব্যবহার করে করতে পারবো।

কমপিউটার কোনো কাজের নাম নয়। এটা কাজ করার টুলস মাত্র।

 

আইটি মানে কম্পিউটার অপারেটিং নয়

একসময় আমাদের পাশের দেশ ধেতে কিছু কোম্পানী এসে আইটি শিখানোর নামে আমাদেরকে শুধু কম্পিউটার অপারেটিং শিখিয়ে গেছে। লাখ লাখ তরুন অফিস এক্সল ওয়ার্ড এসব শিখে নিজেকে পূর্ন মনে করে বসে আছে। আর ক্ষতিটা হয়েছে সারা দেশের আজ দেশে দক্ষ জনশক্তির অভাবে এককোটি যুবক বেকার, অর্ধবেকার অথবা ছদ্মবেশী বেকার। আর পাশের দেশগুলো থেকে অর্ধকোটি লোক এসে নিয়ে যাচ্ছে দশগূণ বেশী রেমিট্যান্স।

তাই ভাবনাগুলো বদলানো দরকার। মোবাইল অপারেট করা মানে যেমন মোবাইল ইঞ্জিনিয়ার নয়। কম্পিউটার অপারেট করতে পারার নাম আইটি দক্ষতা নয়। প্রয়োজন সত্যিকারের দক্ষ লোক। তার আগে প্রয়োজন ধারণাটা বদলানো। এমনিভাবে টেকনোলজি মানে শুধু মেরামত নয়।

 

ফ্রিল্যান্সিং কোনো নির্দিষ্ট পেশার নাম নয়

বর্তমানে মারাত্মক ভুল ধারণা দিয়ে একটি ভাইরাস সমাজে কর্মক্ষেত্রে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। বলা হচ্ছে ফ্রি ল্যান্সিং শিখুন তাতে আপনার চারদিকে খালি টাকা উড়ে বেড়াবে আপনার জীবন বদলে যাবে। কিছুদিন আগে এমএলএম এর ক্ষেত্রে যেমনটা করা হয়েছিলো। তার ফল আজ জাতি ভোগ করছে।

আবার বলছি ফ্রি ল্যান্সিং কোনো পেশা নয়। ফ্রি ল্যান্সিং বিভিন্নপেশার একটা ফর্ম বা পদ্ধতি মাত্র। একসময় যেসব ফটোগ্রাফার কোনো পত্রিকায় বেতনভূক্ত চাকরী করতেন না। স্বাধীনভাবে ছবি তুলে পত্রিকা ও সংবাদ সংস্থার কাছে বেচতেন। তাদেরকে বলা হয় ফ্রি ল্যান্সার। কারণ তার ক্যামেরা বা ল্যান্স কারো কাছে বন্দী নয়। স্বাধীন।

সে থেকে ফ্রি ল্যান্সার কথাটা এসেছে। সে সাংবাদিক স্বাধীনভাবে লেখেন তিনি একজন ফ্রি ল্যান্সার। যে ডাক্তার অনকলে বাসায় যান তিনি একজন ফ্রি ল্যান্সার, যে প্রকৌশলী কারো চাকরী না করে স্বাধীনভাবে কাজ করেন তিনি একজন ফ্রি ল্যান্সার। যে কাজের বুয়া আজ এখানে কাল ওখানে মানে ছুটা বুয়া হিসেবে কাজ করে সেও একজন ফ্রি ল্যান্সার। যে হুজুর নির্দিষ্ট কোনো মসজিদ মাদ্রাসায় কাজ না করে। প্রতিদিন ভিন্ন্ ভিন্ন জায়গায় ওয়াজ মাহফিল করে পয়সা কামান তিনিও একজন ফ্রি ল্যান্সার, যে হকার রাস্তায় চিৎকার দিয়ে কেচুয়ার তেল বেচে তিনিও একজন ফ্রি ল্যান্সার।

বর্তমানে যারা ইন্টারনেট ব্যবহার করে অনলাইন ওপেস সোর্স বা ওয়ার্ক স্টেশনগুলো থেকে বিট করে কাজ নিয়ে বাসায় বসে ক্লায়েন্ট এর কাজের ডেলিভারী দেন। তাকে আমরা ফ্রি ল্যান্সিার বলছি।

আমি আবার বলছি। ফ্রি ল্যান্সার কোনো পেশা নয়। ফ্রি ল্যান্সার বিভিন্ন পেশার হতে পারে। আপনার বাসার হাউজ টিউটরও েএকজন ফ্রি ল্যান্সার টিচার। গ্যাসের চুলার মিস্ত্রি, ইলেকট্রিক মিস্ট্রি কলমিস্ট্রি এরা সবাই ফ্রি ল্যান্সার, প্লাম্বার, পেইন্টার সবাই যখন তারা স্বাধীনভাবে কাজ করে।

তাহলে মূলত আপনাকে ফ্রি ল্যান্সিংটা বুঝতে হবে। শিখতে হবে আসল কাজটা। যেমন আপনি যদি অনলাইনে ফ্রি ল্যান্সিং করেন। তাহলে আপনাকে কিছু কাজ জানতে হবে যেমন, ওয়েব ডিজাইন, সফটওয়ার কোডিং, গ্রাফিক্স, ভিডিও এডিটিং, এনিমেশন, ডাটা এন্ট্রি, ট্রান্সলেশান, রিসারচ ইত্যাদি। এগুলো জানা থাকলে আপনি নিজে যেমন এসব নিয়ে চাকরী করতে পারবেন, নিজে এসব নিয়ে ব্যবসায় করতে পারবেন আবার স্বাধীন পেশা হিসেবে অনলাইনে অফলাইনে কাজ করতে পারবেন।

অনলাইনে কাজ করার জন্য প্লাটফরম গুলোতে রেজিস্ট্রেশন পেমেন্ট পাওয়ার জন্য ইন্টারনেট কার্ড বা গেটওয়ে এসব জিনিস লাগবে। সেগেুলো জানা আজকাল কঠিন কিছু নয়। মনে রাখবেন অনলাইনে ফ্রি ল্যান্সিং যখন শুরু হয়েছে তাদেরকে কে বা কারা শিখিয়েছে যে, আজ কোচিং করে সেটা শিখতে হবে।

কোনো কিছুর জন্য মূল কাজটা শিখতে হবে। সেটাকে কাজে লাগানোর জন্য জানার আগ্রহ থাকতে হবে।

2,616 total views, 3 views today

Comments

comments