এই সময়ের কয়েকটি বিপনন কৌশল
জাহাঙ্গীর আলম শোভন
লেখাটি অনলাইন শপ হোল্ডারদের উৎসাহ বৃদ্ধির জন্য। মূলত চলতি বছরের কয়েকটি কোম্পানীর মার্কেটিং কৌশল এর কয়েকটি ইভেন্ট আলোচনা করবো। যদিও এগুলো বেশীরভাগ মানুষেরই দেখা। তবুও একটি লেখা আকারে প্রকাশ করে উদ্যোক্তাদের চিন্তার খোরাক যোগাতে চাই।
একজন ই কমার্স উদ্যোক্তা প্রথমেই স্বপ্ন দেখেন একটি সুন্দর ওয়েব সাইটের। প্রথমত ধারণা হয়যে একটি সুন্দর ওয়েবসাইট বানাতে পারলেই বেচাকেনা শুরু হয়ে যাবে। ভালো একটি অনলাইন শপের জন্য একটি সুন্দর ও ইউজার ফ্রেন্ডলি ওয়েব সাইটের প্রয়োজন রয়েছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। ওয়েবসাইট হওয়ার পর উদ্যোক্তা অনুভব করেন সমস্যা আরো কয়েক জায়গায় রয়েছে এর মধ্যে রয়েছে ডেলিভারী দেয়া এবং পন্যের দাম গ্রহণ করা। তখন নানা খোজ খবর নিয়ে তিনি কুরিয়ার সার্ভিস সেবা নেন। এক হিসেবে দেখা গেছে শতকরা ৯৬ টি ডেলিভারী সঠিক ভাবে হয় চারটাতে নানা সমস্যা করে কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠানগুলো। সাথে আরো ৩-৪ টি সমস্যা হয়। এগুলো স্বয়ং ক্রেতাই করে থাকেন। হয়তো ফোন ধরেন না। নয়তো বলে দেন যে আমার পন্যটি লাগবেনা ফিরিয়ে নেন। ঠিক এ ধরনের কিছু সমস্যা হয় পেমেন্ট প্রসেসে টাকা পাঠায় বিকাশে এতে নাম্বার ভুল হয়, আবার টাকা না দেয় বলেন দিয়েছি আবার টাকা বাকী রাখার আব্দার করেন।
কিছুদিন পর উদ্যোক্তা বিষয়গুলো সামাল দিতে শিখে যান তখন এগুলো কিছু সমাধান হয়। এবং কিছু সমস্যা রয়ে যায়। কারণ এগুলো উদ্যোক্তার হাতে নেই। তৃতীয় পক্ষের হাতে তাই তিনি এসব সমস্যার মধ্যে ব্যবসা চালিয়ে যান। এক পর্যায়ে আবিষ্কার করেন যে আসল সমস্যা এগুলো নয় আসল সমস্যা মার্কেটিং বা বিপনন। অর্ডার এতো উঠানামা করে যে মার্কেটের গতি প্রকৃতি বোঝা মুষ্কিল হয়ে পড়ে। অনেকেই ফেইসবুকের পলিসি না বোঝার কারণে এবং এসএইও পলিসি আপেডেটেড না করার কারণে অনলাইন মার্কেটিং করে ভালো ফল পান না। আবার অনেকেই প্রথম দিকে ভালো ফল পেলেও সে ফল ধরে রাখা যায়না।
তাই এবার আপনাদের সাথে কিছু মার্কেটিং আইডিয়া শেয়ার করতে চাই। আসুন এরকম কিছ প্রচলিত বিপনন কৌশল আপনাদের মনে করিয়ে দেই।
এক: একই পন্য নতুনভাবে উপস্থাপন
এটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার আপনি যদি একটা এলাকায় প্রতিদিন একইভাবে একই পন্য একই দামে বেচতে চান তাহলে প্রতিদিন একই সেটা বিক্রি হওয়ার কোনো কারণ নেই। তাই আপনাকে মার্কেটিং পলিসিগুলো পরিবর্তন করতে হবে, কমিউিনিটি পরিবর্তন করে এড দিতে হবে, প্রেজেন্টেশান চেঞ্জ করতে হবে, নতুন নতুন প্যাকেজ অফার করতে হবে, মান ও দামে এমনকি সার্ভিসে ভিন্নতা আনতে হবে। দেখুন ইউনিলিভারের ফেয়ার এন্ড লাভলী, লাক্স, ক্লোজআপ শীর্ষে থাকার পরও তারা এগুলো কিছুদিন পর পর নতুনভাবে উপস্থাপন করে। এবার আপনি ভাবুন আপনার খুব সাধারণ পন্যগুলোকে কিভাবে নতুন করে উপস্থাপন করবেন। কিভাবে অন্যদের চেয়ে আলাদা বলে প্রেজেন্ট করবেন।
দুই: ছোট একটি মেসেজ দেয়া
প্রথম রমযানটা আমার ভারতে কাটে এবার। তার ঠিক দুইদিন আগে ভারতের বিখ্যাত ফ্লিপকার্ট একই দিনে সেদেশের প্রায় সব দৈনিক বড়ো এক পৃষ্ঠায় একটা এড দেয়। তাতে বড়ো করে লেখাছিলো , ‘‘ নাহি খারিদা?’’ একদম পৃষ্ঠার নিচে আবারো বড়ো করে লেখা ‘‘ আচ্চা কিয়া’’ বাংলা পত্রিকাও এভাবে আসে ‘‘ কেনোনি’’? ‘‘ আচ্চা কিয়া’’। যদিও এটা হওয়া উচিত ছিলো ‘‘কোনোনি? ’’ ‘‘ বেশ করেছো’’ হয়তো ভালো বাংলা তাতক্ষনিক খুজে পায়নি। যাই হোক মূল মেসেজটা হলো ‘‘ তুমি এখনি আমাদের শপ থেকে কিছু কেনোনি, খুব ভালো করেছো’’ এটা শুনে আমার কাছে মনে হয়েছে সাইটটা একবার দেখা দরকার হয়তো নতুনদের জন্য কোনো ভালো কিছু অফার করেছে? এই যে জিজ্ঞাসা বা কৌতুহল বা প্রশ্ন ক্রেতাকে টেনে নিতে পারে তার একটা উদাহরণ এই বিজ্ঞাপন। কিছুদিন আগে প্রাণ মসলার একটা বিজ্ঞাপন আপনার দৃষ্টি আর্কষণ করে থাকবে। তার মেসেজ ছিলো আমাদেও মসলা ভালো হতে পারে কিন্তু মায়ের ভালোবাসা ও আন্তরিকতার কাছে সেটা কিছুই না। এ ধরনের একটা এড দিয়ে কোম্পানী গ্রাহকদের মনে জায়গা করে নিতে পারে। এবার আপনিও এরকম কিছু ভাবতে পারেন।


তিন: পন্য ফ্রি বা স্যাম্পল দেয়া:
বিশেষ করে ঔষধ মার্কেটিং এর ক্ষেত্রে এটা পুরনো এবং প্রচলিত পদ্ধতি কোম্পানীর প্রতিনিধিগন ডাক্তারদেরকে তাদের ঔষধের নমূনা দিয়ে থাকেন। এতে করে ঔষধের বিক্রি বাড়ানো হয়। এই পদ্ধতি মেডিসিন জগতে এত কমন হয়ে গেছে এটাতে এখন তেমন কাজ হয়না তারা অন্য নানা কৌশল নিয়ে নামেন। কিন্তু অন্য অন্য ক্ষেত্রে এই কৌশলটা ভালো কাজ দিচ্ছে।
১. নতুন পন্য বাজারজাত করার ক্ষেত্রে: ফেয়ার এন্ড লাভলী ক্রিম এর সাথে রেক্সোনা ডিউটিউব ফ্রি দিয়ে এটার ব্যবহার শিখিয়েছিলো ইউনিভার। এখন এটি ভালোই বিক্রি হয়। অন্তত ফ্রি দিতে হয়না।
১. হামর্দদ এর রুহ আফজা শরবত রমযানে প্রচুর ফ্রি দেয়া হয়, কমপক্ষে ৫ হাজার লোক এটা পায়। আমিও প্রতিবছর এক লিটারের একটা শরবত পাই। কখনো ২টাও পাই। কেউ বেশীও পেতে পারে। বিশেষ করে মিডিয়ার লোকদের টার্গেট করে এটা দেয়া হয় যাতে তারা এ বিষয়ে লেখালেখি করে। এবং এই পলিসিতে রুহ আফজা আরো বেশী বিক্রি হয়।
৩. আল কোরআন একাডেমী পাবলিকেশন্স নামে একটি প্রকাশনা সংস্থা রয়েছে। তারা কোরআনসহ বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ প্রকাশ করে। বিগত কয়েকবছর ধরে তারা একটি এনজিও প্রতিষ্ঠা করে তার অধীনে ডোনেশান সংগ্রহ করে কোরআন ফ্রি দিচ্চে। অনেকের আশংকা ছিলো মানুষ ফ্রি যখন পাবে তখন আর কিনতে চাইবেনা। এই আশংকা মিথ্যে করে দিয়ে তাদের কোরআন বিক্রির হার চার থেকে পাঁচগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কারণ কেনার জন্য কোরআনটি যা মূলত কোরআনের সহজ সরল বাংলা অনুবাদ সর্বত্র পাওয়া গেলেও। ফ্রি পেতে অনেক প্রসিডিওর মেনটেন করতে হয়। এছাড়া অনেকে ফ্রি পেয়ে যখন বুঝতে পারে এটা একটা অসাধারণ অনুবাদ তখন তারা টাকা দিয়ে কিনে সংগ্রহ করে।
৪. রাধুনী ১০০ গ্রাম মসলার ২টি প্যাক হলুদ ও মরিচের সাথে ভিন্ন ভিন্ন সাইজের চারটি চামচ ফ্রি দিয়ে অফার দেয়া হয়েছিলো। যেহেতু জিনিসটি খুব কাজের। তাই এই অফার যতদিন ছিলো মানুষ অন্য ব্রান্ড না কিনে রাধুনীই কিনেছিলো। এরকম অসংখ্য ঘটনা আপনারা জানেন।
চার: ফ্যাশন শো
এবারের রমযানে ঈদেও শপিং সিজনে যমূনা ফিউচার পার্কে বেশ কিছু নতুন ব্রান্ড আসে। এর অন্যতম হলো ট্রাস্টমার্ট তারা অন্যান্য বিজ্ঞাপনের পাশাপাশি বেশ কয়েক দিন যমুনা ফিউচার পার্কের ভেতরে খোলা জায়গায় আ্কষনীয় মডেলদের দিয়ে ওপেন ফ্যাশন শো করেছিলো। প্রতিদিন ফ্যাশন শোতে প্রায় হাজারখানেক দর্শক হতো। ছোট উদ্যোক্তার ক্ষেত্রে এটা বয়বহুল। কিন্তু 50 জন মিলে করলে নিশ্চয় হালকা হালকা লাগবে।
পাঁচ: একই পন্যের দুইটি ভার্সন:
যাদের পন্য ভালো কিন্তু অন্যরা কমদামে একই ধরনের খারাপ পন্য বিক্রি করেন তাদের জন্য এটা কাজ দিতে পারে। তবে এটা নীতিগত সিদ্ধান্তের ব্যাপার আছে। আপনি এমনটা করবেন কিনা? কারণ কোনো ব্রান্ডশপ এর জন্য এটা খাটেনা। মুল উদাহরণটা আগে দিই। বাজারে কিছু নোটবই পাওয়া যায় বিভিন্ন প্রকাশনার। এগুলোর আবার হুবহু নকলও পাওয়া যায় কোয়ালিটি একটু দূর্বল, দামে কম। সমস্যা হলো নোট বই জিনিসটাই বৈধ নয় তাই প্রকাশকরা নকল কারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেন না। কিন্তু তার বই নকল হয়ে কমদামে বাজারে চলে আসার তার ব্যবসার ক্ষতি হয়। আমি নাম উল্লেখ করবোনা কয়েকজন প্রকাশক আছেন তারা তাদের বইয়ের মূল এবং নকল তারা নিজেরাই বের করেন। মূলটার দাম থাকে বেশী, নকলের দাম কম। এতে সুবিধা হলো প্রথমত কেউ নকল বের করতে উৎসাহ পায়না। দ্বিতীয়ত বাজারটা হাতছাড়া হয়না।
আরেকটা বিষয় হলো ঠিক এর উল্টো: আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাটা শেয়ার করি। আঙুর কিনতে বাজারে গেলাম। দোকানে বিভিন্ন ভাবে সাজানো। আমি জিজ্ঞেস করলাম আঙুর কোনগুলো কত? আমরা সকলেই জানি যে এসব ফল বিভিন্ন কোয়ালিটির থাকে, টক মিস্টিতো আছেই। দোকানী ডান দিকের গুলোর দাম হাকলো ২৫০ টাকা কেজী আর বাম পাশের গুলো ২৮০ টাকা কেজী। দেখতে একই রকম হওয়াতে আমি দুই পাশ থেকে দুটো আঙুর মুখে পুরে নিলাম। আমার কাছে একই মনে হলো। কথা না বাড়িয়ে ২৫০ টাকা কেজীর আঙুর দরদাম করে ২৪০ টাকা দরে কিনে নিলাম। ঠিক একই সময়ে আরেকজন ক্রেতা এসে জিজ্ঞেস করলেন ‘‘ আঙুর কি কি দামে আছে’’ দোকানী তাকে ২৫০ ও ২৮০ টাকা দাম বললেন। তিনিও দুটো মুুখে দিয়ে দেখলেন। কি ভেবে তিনি ২৮০ টাকা দরে এক কেজী আঙুর কিনলেন। আমার কৌতুহল হলো। আমি দাড়িয়ে রইলাম। সে ক্রেতা চলে যাওয়ার পর আমি দোকানীকে আন্তরিক ভাবে জিজ্ঞেস করলাম। আসলেই কি দুই ধরনের কোয়লিটির আঙুর এখানে আছে কিনা? দোকানী স্বীকার করলো যে, সবই একই, কিন্তু কিছু ক্রেতা আছে তাদেরকে আমি যদি বলি সব একই দও, তারা ভাববে আমি মনে হয় ভালো আঙুরগুলো রাখি নাই। সেগুলো অন্যত্র পাওয়া যায়। তখন আমি ক্রেতাই হারাবো।( কি বুঝলেন?)
ভাবছেন একই পন্য দুই দামে বেচা কি ঠিক হবে? সেক্ষেত্রে যারা অনলাইন ব্যবসা করেন তারা বেশী দামের প্যাকেজে ভালো প্যাকিং দিতে পারেন।
ছয়: এক বছরের ওয়ারেন্টি:
টিভি ফ্রিজ এর ওয়ারেন্টি গ্যারেন্টি আছে, মোবাইল ল্যাপটপেরও আছে। কিন্তু বৈদ্যুতিক বাল্বের ক্ষেত্রে এটা ছিলনা। ঠিক এই কৌশলে এনার্জি বালব্ কিভাবে বাজার দখল করে নিলো। ৩০০ টাকার একটি বাল্বে ৮০% বিদ্যুত সাশ্রয় হয়। কিন্তু ৬০ ওয়াটের একটি সাধারণ বৈদিূতিক বাতি সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত যদি জ্বলে তাতে ২৫ টাকার বাতি কত টাকার কারেন্ট খায় আমার জানা নেই। বিষয়টা আমার খাছে খটকা লাগে। তবে আইস ফ্রেন্ডলী বাল্বের বিষয়টা আলাদা। আর কিছু লোকতো আছে যারা ওয়ারেন্টি কার্ডডা হারিয়ে ফেলেন অথবা এনার্জি বাল্বটা ভেঙ্গে যায় তখন আবার নতুন কিনতে হয়। ২৮০ টাকা। হাহাহা।
আপনি কিন্তু আপনার পন্যে ওয়ারেন্টি দিতে পারেন। কাপড়ে রং এর গ্যারান্টি। শুটকিতে কোয়ালিটি গ্যারান্টি। মিস্টিতে বাসি না হওয়ায় প্রতিশ্রিুতি। হোকনা সেটা ১ বছরের কিংবা ৭ দিনের । আর সবাই যখন ৩-৪ বছরের গ্যারান্টি দিচ্ছে তখন ৭-১০ বছরের গ্যারন্টি দিয়ে ফ্রিজ টিভির বাজারটা কিভাবে দখল করলো কয়েকটা কোম্পানী। আরে ভাই আপনারা এসব আমার চেয়ে বেশী জানেন। আপনাদেরকে জ্ঞান দেয়া আমার একদম সাজে না।
সাত: নতুন বাজার নতুন ক্রেতা:
এই পয়েন্ট টা আগেও আলোচনা করেছি এখনো করছি। অনলাইনে বিজ্ঞাপন দিয়ে আপনি ভালো ফল পান বা না পান আপনি অফলাইনে এড দেয়ার কথা ভাবতে পারেন। বাংলাদেশে অনলাইনে কেনাকাটা এখনো যথেষ্ঠ পরিমানে শুরু হয়নি। ইতোমধ্যে যারা ভালো করেছে। তারা অনলাইন অফলাইন দুটোতেই প্রচার চালাচ্চে। এবং অনলাইনেইর পাশাপশি ফোনলাইনে অর্ডার নিচ্চে। যেমন রকমারী ফোনে অর্ডার দেয়া যায়? আপনিও একটি ফোনলাইনের কথা ভাবুন আর সে নাম্বারটাকে প্রমোট করুন।
আজ এ পর্যন্তই।
9,254 total views, 3 views today
