আজকের রবিনহুড:

আজকের রবিনহুড: অচেনা শহরে এক চেনা বন্ধুর গল্প

লেখা: জাহাঙ্গীর আলম শোভন

একপাশে গ্রাম একপাশে শহর। দুয়ের মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে এক পুরনো নদী। নদীর দু’তীরে কোলাহল সবসময় জানান দিয়ে যায় দু-পাশের লোকালয়ের জীবনযাপনের শব্দস্রোত। নদীর বুকে বয়ে যাওয়া জলেস্রোতে নিত্যদিন বয়ে চলে নগরবাসীর নানা আয়োজনের জলযানগুলো। সেগুলো শব্দতুলে হারিয়ে যায় দূর দিগন্তে। এভাবে শহরে বয়ে চলে প্রাণের হিল্লোল। দিনের শব্দ ও রাতের আলো জেগে থাকে জাগ্রত নগরবাসীর মতোই।

এই শহর হঠাৎ একদিন নিরব হয়ে। জাগ্রত নগর হয়ে যায় নিরব কোনো পল্লীর ন্যায়। মোটরগাড়ি হাঁকিয়ে কর্মব্যস্ত অফিসপাড়ার লোকেরা কাজে যায়না। শিশুরা বিদ্যালয়ের আঙীনা মাতিয়ে রাখেনা। রমনীরা সেজে বের হয়না রাস্তায়। পার্কের বেঞ্চিতে বাদামের খোসা ফেলে যায়না তরুন যুগল। প্রার্থণাঘরে সারিবদ্ধ দাড়ায়না শুভ্র প্রার্থণাকারীর দল। ব্যস্ত নগর যেন থমকে আছে সময়ের গায়ে হেলান দিয়ে।

বিপাকে পড়ে যায় মোহাম্মদপুরের রিকসাচালক রফিকুল্লাহ, সমস্যায় পড়ে যায় কাপড় সেলাই করে জীবিকা চালানো মিরপুরের নীলাবেগম, বিপদগ্রস্থ হয়ে পড়ে ফুটপাতে জুতা বিক্রেতা পল্টনের আলামিন, বাড্ডার রাশেদা বেগম মেসে রান্নার কাজ করতেন। মেস বন্ধ হয়ে গেলে বন্ধ হয়ে যায় তার কাজ। বন্ধ হয়ে গেছে ছাপাখানায় কাজ করা মোহাম্মদ আলীর রোজগার| সে গ্রামে চলে গিয়েছে। আর হোটেল কর্মচারী বাবুল মিয়া ডে লেবার হিসেবে কাজ করত। তার ঘরে চাল চড়ানোর ব্যবস্থা নেই।

এভাবে শহরে লাখো হতদরিদ্র ও অল্প আয়ের মানুষদের চোখে যেন শর্ষেফুল দেখা শুরু হয়। কারো ঘরে ছোট শিশু, কারো ঘরে বৃদ্ধ বাবা মা। রিকসাচালক রফিকুল্লাহ ছোট মেয়েটার জন্য খাবার নিয়ে আসতে পারে না। আলামীনের মায়ের জন্য ঔষধের প্রয়োজন। নিজের পকেটে কিছু টাকা আছে সেগুলো দিয়ে ঔষধ কিনলে আর চাল কেনা হয়না। বিভিন্ন জায়গায় কিছু ভাল মানুষ কিছু সাহায্য দেয়, আসে কিছু সরকারী ত্রাণ। রফিকুল্লারা দু-একজন পায়, বাকীরা পায়না। নীলাবেগমের মতো অনেকে আত্মসম্মানবোধের কারণে লাইনে দাড়াতে পারে না।

এই শহরে হঠাৎ নেমে এলো এক রবিনহুড। সে খোঁজ নিয়ে যায় নীলা আর বাবুল মিয়াদের। দু’দিন পরে একজন ফোন দিয়ে জানতে চাইল ঠিকানা ঠিক আছে কিনা। তারপরের দিন রিকসাওয়ালা রফিকুল্ল্যার ঘরের সামনে একটি পিকআপ ভ্যান এসে দাঁড়াল।

কি ব্যাপার, এখানেতো কখনো কোনো মাল গাড়ি এসে দাঁড়ায়না। কেন এই গাড়ি আসলো। রফিকুল্লার টংঘর থেকে বেরিয়ে এলো তার দুই শিশু সন্তান। কৌতুহল নিয়ে দেখছে তারা কাভার্ডভ্যানকে।

গাড়ি থেকে নেমে এল একজন। সে গাড়িতে ই-ক্যাব মানবসেবা এসব লোগো লাগানো আছে। রফিকুল্লার ১০ বছরের বড় মেয়ে শিউলি ক্লাস থ্রিতে পড়ে। সে বিড় বিড় করে নামগুলো পড়তে পড়তে গাড়ি থেকে আরো দু’জন মানুষ নেমে আসে। তাদের পুরো গা সাদাপোশাকে ঢাকা।

শিউলির স্কুল বন্ধ। স্কুল বন্ধ হওয়ার আগে স্কুলের স্যার বলেছে। দেশে একটা রোগ এসেছে নাম- করোনা। এই রোগ একজন মানুষ থেকে আরেকজন মানুষের হয়। এই রোগে বিভিন্নদেশে বহু মানুষ মারা যাচ্ছে। তাই জরুরী দরকার ছাড়া ঘর থেকে বের হওয়া নিষেধ। জরুরী প্রয়োজনে বের হতে হলে বিশেষ ধরনের জীবানুরোধক পোশাক পরে বের হতে হবে। শিউলি বুঝতে পারে এটা সে পোশাক। কিন্তু এই লোকগুলো এতবড় গাড়ী নিয়ে তাদের বাসার সামনে কেন থামলো সেটা বুঝতে পারে না শিউলি। ‍

একজন লোক জানতে চায়, ‘রফিক ভাই বাসায় আছে কিনা’? তাদের কথা শুনে শিউলি বুঝতে পারে এরা ভাল মানুষ। নিজের নাম শুনে বেরিয়ে আসেন রফিকুল্লা। চোখ কচলিয়ে লুঙ্গির গিঠ লাগাতে লাগাতে ছেড়া স্যান্ডোগেঞ্জি গায়ে গাড়ির সামনে এসে দাঁড়ান তিনি। এর মধ্যে বাকী দুজন লোক ধরাধরি করে গাড়ী থেকে একটি সাদা বস্তা বের করে। মনে হচ্ছে খুব ভারী। শিউলির ছোট দুই ভাই রবিন ফিস ফিস করে বড়বোনের কাছে জানতে চায়, বস্তার মধ্যে কি আছে। শিউলি ছোট ভাইকে চুপ থাকতে বলে বাবার পিছু পিছু এসে দাঁড়ায়।

তারপর একজন লোক রফিকুল্যার সাথে হাত মিলিয়ে বলে, ‘‘আমরা ই-ক্যাবের মানবসেবা ডট কম থেকে এসেছি আমরা বাংলার রবিনহুড। আমরা খবর পেয়েছি আপনার পরিবার সমস্যার মধ্যে রয়েছে। তাই আপনার জন্য উপহার। আপনি যদি কিছু মনে না করেন তাহলে এই উপহার গ্রহণ করুন। তারপর তারা শিউলির বাবার হাতে বড় বস্তাটি তুলে দেয়।

শিউলি বুঝতে পারে এরা হচ্ছে সে রবিনহুড যারা গরিব ও অভাবী মানুষদের বাসায় খাবার পৌঁছে দেয়। তাদের খালার বাসা কড়াইল। ছোট খালা গতকাল ফোন করে বলেছিল তাদের বাসাতেও গতকাল রবিনহুডেরা খাবার দিয়ে গেছে। তখন শিউলির মা বলেছিল- তাদের বাসায়ও যদি এরকম কেউ দিত।

রফিকুল্লার মুখে কোনো কথা আসে না। তার আজ ঘরে রান্না ছড়ানোর কোনো ব্যবস্থা ছিলনা। লোকগুলো চলে যায়। রফিকুল্লাহ বোবার মতো তাদের চলে যাওয়া দেখতে থাকে। দুই ভাইবোনের পেছনে ততক্ষনে তাদের মা পেয়ারী বেগম এসে দাঁড়ায়।

স্বামী স্ত্রী দুজন মিলে ধরে বস্তাটা বাসায় নিয়ে আসে। এটা খুলে তারা খুশি হয়। এতে তাদের একমাস চলার উপযোগী চাল, ডাল, তেল, লবণ, সেমাই, চিনি, আলু, পেয়াজ আরো সব জিনিস রয়েছে।

আজকের সকালটা এত সুন্দর হবে তারা ভাবতে পারেনি। গতকাল রাতেও শিউলির মা আর বাবা আলাপ করছিল। আজ যদি কোনো উপায় না হয় তাহলে কাল কি হবে? বস্তা থেকে কিছু চাল ডাল বের করে রান্নার প্রস্তুতি নিল পেয়ারী বেগম।

শিউলি সাত বছরের ছোট ভাইকে বলল, চল খেলি। ওরা খেলতে গেল। তখনো বিছানা গুটানো হয়নি সে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে হেলান দিয়ে বসে রফিকুল্লাহ। তার দুচোখ বেয়ে অশ্রু নেমে আসে। দুই বছরের ছোট মেয়ে চামেলীকে বুকে নিয়ে নিজের চোখের আনন্দ অশ্রুটা লুকিয়ে নেন তিনি। শিশুটি ঘুমাচ্ছে। নিষ্পাপ শিশুটির মুখের দিয়ে চেয়ে রফিকুল্লাহ মনে মনে বলে, ‘আহ পৃথিবী কতো সুন্দর। হয়তো সুন্দর মনের মানুষগুলো না থাকলে পৃথিবী এত সুন্দর হতো না। তারপর মনে মনে দোয়া করে সেসব মানুষদের জন্য যারা এই উপহারের জন্য অর্থ দিয়েছেন এবং যেসব রবিনহুডদের জন্য এটা তার বাসায় পৌঁছে দিয়েছে। রাতে টেনশনে ঘুম হয়নি তার। নিজের অজান্তে ঘুমের ঘোরে ঢলে পড়ে।

ঘুমের মধ্যেই রফিকুল্লা স্বপ্ন দেখে সব কিছু ঠিক হয়ে গেছে। শিউলির স্কুল খুলে গেছে। তার রিকসাও চলতে শুরু করেছে। মনে হলে একজন ডাকল, এই যে ভাই যাবেন না? ডাক শুনে জেগে যায়। জেগে দেখে তার স্ত্রী মা পেয়ারী বেগম বলছে, রান্না হয়ে গেছে খাবেন না?

– জাহাঙ্গীর আলম শোভন

 

1,571 total views, 3 views today

Comments

comments