ফেইসবুক কমার্স হলো, মোবাইল কমার্স হলো, এখন আবার হাইপার-লোকাল ই-কমার্স, এটা কি?

হাইপার-লোকাল ই-কমার্স নিয়ে কিছু বলার আগে হাইপার-লোকাল (hyperlocal) সম্পর্কে কিছু বলে নেয়া দরকার। হাইপার-লোকাল কথাটি নতুন এসেছে। উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুসারে ১৯৯১ সালে স্থানীয় টেলিভিশন নিউজ কন্টেন্ট এর ক্ষেত্রে হাইপার-লোকাল শব্দটি প্রথম ব্যবহার করা হয়। যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক গবেষণা-প্রতিষ্ঠান নেস্টা (NESTA)  ২০১২ সালে “Here and Now UK hyperlocal media today” শীর্ষক এক রিপোর্টে হাইপার-লোকাল এর নিম্নোক্ত সংজ্ঞাটি প্রদান করা হয়-

“Online news or content services pertaining to a town, village, single postcode or other small, geographically defined community.”

এটা ছিল মিডিয়া-ভিত্তিক একটি রিপোর্ট তাই এখানে মিডিয়ার দৃষ্টিকোন থেকে সংজ্ঞাটি প্রদান করা হয়েছে।

একটা উদাহারণ দিলে আরো অনেক পরিস্কার হবে। আমি মোহাম্মদপুর থানায় বসবাস করি। আমার বাসার গলিতেই কয়েকটি মুদি দোকান আছে। এ দোকানগুলো থেকে এলাকার লোকজন পণ্য ক্রয় করে।

একটি গ্রামে একটি ছোট মুদি দোকান আছে যাদের মূল ক্রেতা হচ্ছেন উক্ত গ্রামের বাসিন্দারা; আর কেউ না।

এটাই হচ্ছে হাইপার-লোকাল এর উদাহারণ। যে কোন ব্যবসা বা সেবা যা একটি নির্দিষ্ট এলাকার লোকদের চাহিদা পূরণ করে।

hyper_local-100576243-primary.idge

Source: www.cio.com/article/2903932/online-marketing/is-the-time-finally-right-for-hyperlocal.html

এখন হাইপার-লোকাল ই-কমার্সের দিকে একটু তাকানো যাক। এখানেও একটা উদাহারণ দেই। আমি আগেই বলেছি যে আমি মোহাম্মদপুরে থাকি। মোহাম্মদপুরে হক কনফেকশনারি অ্যান্ড জেনারেল স্টোর খুবই পরিচিত একটি দোকান। মোহাম্মদপুরের বেশ কয়েকটি জায়গায় এ প্রতিষ্ঠানের দোকান আছে। প্রতিষ্ঠানটি ফাস্টফুড আইটেম, মিষ্টি, কেক সহ বিভিন্ন মুদি পণ্য বিক্রী করে থাকে। অনেকে তাদের কাছে থেকে কিনে থাকে কারণ তাদের পণ্য দামে কম এবং খেতেও মজা। ধরা যাক, বিকালে আমার বাসায় মেহমান আসল। আমি তাদেরকে আপ্যায়ন করাব। ঘরে সেরকম কিছু নেই। আমি চাচ্ছি হক এর দোকান থেকে সমুচা বা বার্গার নিয়ে আসতে। কিন্তু আমার অতিথিকে বসিয়ে রেখে যাব কিভাবে? এখন যদি এমন হতো যে অনলাইনে একটি ওয়েবসাইটে বা মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে আমি অর্ডার করলাম আর আমার বাসায় হক এর থেকে খাবারটা পৌঁছে দেয়া হলো। এটা হাইপার-লোকাল ই-কমার্সের একটি উদাহারণ।

হাইপার-লোকাল ই-কমার্স এর ক্ষেত্রে যেটা হয় যে, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানটি এলাকার স্থানীয় দোকানদার বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের থেকে পণ্য/সেবা অনলাইনে ক্রেতার কাছে বিক্রী করছে।

এখন কোটি টাকার প্রশ্ন হচ্ছে-এটাতে লাভটা কি? লাভ এখানেই যে হাইপার-লোকাল ই-কমার্স প্রক্রিয়ায় স্থানীয় দোকান বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কাছে থেকে পণ্য সংগ্রহ করে ক্রেতাকে কয়েক ঘন্টার মধ্যে ডেলিভারি দেয়া সম্ভব। অর্থাৎ ক্রেতা সত্যি সত্যি ঘরে বসে পণ্য/সেবা পাচ্ছে। এখানে আপনি প্রশ্ন করতে পারেন- ভাই আমার এলাকার দোকান থেকেই যদি পণ্য কিনতে হয় তাহলে তো এটা সমস্যা নয়। আমি নিজেই নিয়ে আসতে পারি। অনলাইনে আবার কেনার দরকার কি? কথা সত্য, দৈনিক ছোটখাট কেনাকাটা যেটা ঘরের পাশের দোকানে পাওয়া যায় সেটা আপনি নিজেই কিনে নিয়ে আসতে পারেন। কিন্তু প্রতিদিন কি ছোটখাট কেনাকাটা হয়? চাল-ডাল মাছ-মাংস সহ ইত্যাদি আরো অনেক জিনিসই আমরা সংসারের জন্যে ক্রয় করে থাকি এবং সেগুলো কিন্তু প্রতিদিন না করলেও যখন করি সেটা একসাথে বড় পরিমাণে করি। এ বিশাল বোঝা বয়ে নিয়ে যাওয়া যায় না। রিক্সায় করে নিয়ে আসতে হয়।

আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবারে এটা খুবই সাধারণ চিত্র। সারা সপ্তাহ দৌড়াদৌড়ি করে বৃহস্পতিবার রাতে একটু টিভি দেখে আরাম করে দেরিতে ঘুমাতে গিয়েছি কারণ জানি যে কাল ছুটি। কিন্তু নয়টা বাজতেই বউ নয়তো মা (যারা ব্যাচেলর) এসে বলতে লাগল ঘুম থেকে ওঠো বাজারে যেতে হবে। এরপরের চিত্র হলো নাস্তা খেয়ে বাজারে যাও আর জিনিসপত্র কিনে নিয়ে আস।যাবেন খালি ব্যাগ নিয়ে আরামে। আসার সময়ে সেটা প্রচণ্ড ভারি হয়ে উঠবে। প্রতি সপ্তাহেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। যদি গৃহিণীদের দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবা হয় তাহলে যেটা হয় যে সকালে বাচ্চাদের স্কুলে পৌঁছে দেবার পরে বাজার থেকে জিনিসপত্র কিনে নিয়ে বাসায় এসে রান্না করে আবার বাচ্চাকে স্কুলে আনতে যেতে হয়। এরপরে বাসায় ফিরে একদম ক্লান্ত হয়ে পড়েন।

16x9_HyperLocal

Source: www.possible.com/perspectives/you-are-not-alone 

হাইপার-লোকাল ই-কমার্স এখানে যেটা করতে পারে তা হলো এই যে একসাথে অনেক জিনিস কিনে বয়ে নিয়ে আসার ঝামেলা থেকে আপনাকে মুক্তি দিতে পারে। আপনি ঘরে বসেই আরামে আপনার নিকটস্থ দোকান/বাজার থেকে প্রয়োজনীয় পণ্য অনলাইনে কেনাকাটা করতে পারেন এবং কয়েক ঘন্টার মধ্যে ডেলিভারি পেতে পারেন।

এবার দ্বিতীয় কোটি টাকার প্রশ্ন- বুঝলাম হাইপার লোকাল ই-কমার্সে ক্রেতা আরামে পণ্য ক্রয় করতে পারে এবং ঘরের কাছের দোকান থেকে কেনার ফলে সত্যি সত্যি অল্প সময়ের মধ্যেই ক্রেতা অনলাইনে ক্রয়কৃত পণ্যের ডেলিভারি পাবে কিন্তু একজন ই-কমার্স ব্যবসায়ীর হাইপার-লোকাল ই-কমার্স করে লাভটা কি?

বাংলাদেশে ই-কমার্স একটি উদীয়মান সেক্টর। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ১%ও কিন্তু এখনো অনলাইনে কেনাকাটা করে না। এর প্রধান কারণ হচ্ছে অনেকে অনলাইনে কেনাকাটা করতে ভরসা পায় না। অনলাইনে ওয়েবসাইটে একটা পণ্য দেখলাম খুব সুন্দর ছবি। কিন্তু টাকা দেবার পরে দুশ্চিন্তায় থাকে যে আসলেই পণ্যটা পাব কিনা? বা যে পণ্যের ছবি দেয়া আছে আসল পণ্য সেরকম হবে কিনা? হাইপার লোকাল ই-কমার্স কিন্তু এরকম মানুষদের ই-কমার্সে অভ্যস্ত করে তুলতে পারে। ক্রেতার দিক থেকে ভাবুন, ক্রেতা জানেন যে তিনি অনলাইনে কিনছেন কিন্তু যে দোকান থেকে পণ্যটি তিনি পাচ্ছেন সে দোকানটি তিনি চেনেন। অতএব পণ্যের সমস্যা বা বিক্রয়োত্তর সেবার ক্ষেত্রে তিনি কিন্তু উক্ত দোকানের সাথে যোগাযোগ করতে পারবেন। অতএব পণ্য হাতে পাওয়া নিয়ে বা পণ্যের মান নিয়ে তাকে দুশ্চিন্তা করতে হচ্ছে না।

এবার আসা যাক, পণ্যের সোর্সিং। বাংলাদেশের ই-কমার্স ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর সিংহভাগই ক্ষুদ্র এবং মাঝারী প্রতিষ্ঠান। এধরণের প্রতিষ্ঠানের জন্যে পণ্য সোর্সিং এবং সংগ্রহ করা বিশাল চ্যালেঞ্জ। হাইপার-লোকাল ই-কমার্সের ক্ষেত্রে ই-কমার্স উদ্যোক্তা স্থানীয় দোকান সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে পার্টনারশীপে আসতে পারে যে তাদের পণ্য বা সেবা সে অনলাইনে বিক্রী করবে এবং আয় ভাগ করে নেয়া হবে। এতে করে দু-পক্ষের লাভ হবে। স্থানীয় দোকানের মালিক একসাথে অনেক লোকের কাছে পণ্য বিক্রী করতে পারবেন। তার ক্রেতা বাড়ানোর জন্যে চিন্তা করতে হবে না। অন্যদিকে ই-কমার্স ব্যবসায়ীকে পণ্যের সোর্সিং এবং পণ্য সংগ্রহ করে গুদামে রাখার চিন্তা করতে হবে না। ক্রেতা অনলাইনে অর্ডার ই-কমার্স ব্যবসায়ী সহজেই দোকান থেকে পণ্য নিয়ে আসতে পারেন। একে বলা হচ্ছে “অন-ডিমান্ড ডেলিভারি।”

বর্তমানে বাংলাদেশের ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের জন্যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে পণ্য ডেলিভারি। সময় মতো ডেলিভারি না করতে পারার ফলে অনেক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের সুনাম ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। এর ফলে অনলাইনে কেনাকাটায় অনেকে আস্থা হারাচ্ছেন। ফলশ্রুতিতে ই-কমার্সের বাজার বাড়ছে না। হাইপার-লোকাল ই-কমার্সের ক্ষেত্রে কিন্তু ডেলিভারি বড় সমস্যা নয়। ক্ষুদ্র ই-কমার্স ব্যবসায়ী কিন্তু চাইলে নিজে লোক রেখে এলাকায় পণ্য ডেলিভারি দিতে পারে।

এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন আর তা হচ্ছে- আমি অনলাইনে স্টোর খুলেছি কারণ অনলাইনে আমি সারাদেশের লোকের কাছে আমার পণ্য/সেবা বিক্রী করতে পারব। আমার অনলাইন স্টোরে এখন সারা বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের বাইরের লোক এসে অর্ডার দিচ্ছে। হাইপার-লোকাল ব্যবসায় আমার ব্যবসা একটি নির্দিষ্ট এলাকাতে সীমাবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। এতে করে আমার আয় কমে যাবে না? আমি কি এভাবে ব্যবসা চালাতে পারব?

প্রথমত, আপনি কিন্তু আপনার বাসার গলির দোকান থেকেই অনেক কিছু কিনছেন। আপনার পাড়া প্রতিবেশী অনেকেই কিন্তু ঐসব দোকান থেকে কিনছে। সে দোকানদার গুলোও ব্যবসা করছে। আগোরা বা মীনাবাজারের কারণে তাদের ব্যবসা নষ্ট হয়ে যায়নি। তারাও ব্যবসা করছে।

দ্বিতীয়ত, আপনি অনলাইনে স্টোর খুলেছেন কারণ আপনি সারা বাংলাদেশের লোকের কাছে পণ্য বিক্রী করতে চান। খুব ভাল কথা। বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের বেশিরভাগ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান কিন্তু ক্ষুদ্র ও মাঝারী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। আপনি যদি এমন একটি প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী হয়ে থাকেন আপনি ব্যাপারটা একটু ভেবে দেখুন- আপনার ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান অনলাইনে সারাদেশে পণ্য বিক্রী করছে? আসলেই কি তা হচ্ছে? আসলেই কি সারা বাংলাদেশ থেকে আপনার অনলাইন প্রতিষ্ঠানে প্রতিদিন হাজারে হাজারে অর্ডার আসছে? হ্যা, ঈদ, পূজা বা অন্যান্য উৎসবে অর্ডার হয়তো বেশি আসে কিন্তু বছরের ৩৬৫ দিনে একই হারে অর্ডার আসে কি? আপনি যদি খেয়াল করেন তাহলে আরো দেখবেন ঢাকার থেকেই বেশি অর্ডার আসে এবং ঢাকার বাইরে কয়েকটি অঞ্চল থেকে অর্ডার আসে। সব জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন থেকে সেভাবে অনলাইনে কেনাকাটা করে না অতএব চিত্রটা কি দাড়াল? সারা দেশে কিন্তু সেভাবে আপনার পণ্য বিক্রী হচ্ছে না। এটা আপনারও দোষ না।

আপনার মতো ক্ষুদ্র ও মাঝারী প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্যে হাইপার-লোকাল ই-কমার্স হতে পারে বিশাল শক্তি। কিভাবে তা হয়ে উঠতে পারে। তা নিয়ে আরেকটি পোস্টে লেখা দেব। লেখা যখন শুরু করেছিলাম তখন ভাবিনি যে পোস্টটা এত বড় হয়ে উঠবে। ধৈর্য ধরে পড়ার জন্যে ধন্যবাদ।

লেখকঃ

এস এম মেহদী হাসান

7,512 total views, 4 views today

Comments

comments