বর্তমানে বাংলাদেশের বেশিরভাগ ই-কমার্স ব্যবসা মাঝারী ও ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পর্যায়ে আছে। এসব প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের মধ্যে একটা বিশাল আশংকা কাজ করে আর তা হচ্ছে- বাংলাদেশে যদি বিদেশী ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ব্যবসা করতে আসে তাহলে তাদের দাপটের সামনে এসব প্রতিষ্ঠানের অনেক গুলোই ঝরে পড়বে।
এ আশংকাটা সত্যি। অনেক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানই ঝরে পড়বে। কিন্তু এর মানে কি এই যে এসব বিদেশী ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের দাপটে স্থানীয় ছোট ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো আর ব্যবসাই করতে পারবে না? আপনি যদি বাংলাদেশের প্রিন্ট মিডিয়ার দিকে দেখেন তাহলে দেখবেন যে প্রথম আলো, কালের কন্ঠ এর মতো প্রথম সারির পত্রিকা গুলো দাপটে আছে কিন্তু তাই বলে অনেক স্থানীয় পত্র-পত্রিকা এবং ওয়েবসাইট আছে যেগুলো নিয়মিত সংবাদ প্রকাশ করে যাচ্ছে। এ ধরণের পত্রিকা বা ওয়েবসাইট গুলোর টিকে থাকার অন্যতম কারণ হলো তারা তাদের স্থানীয় খবর গুলো যতটা যত্ন করে ছাপবে প্রথম আলো বা কালের কন্ঠের মতো পত্রিকা সেভাবে ছাপবে না। ধরা যাক নোয়াখালী জেলার একটি ইউনিয়নের খবর যেটি দৈনিক নোয়াখালী পত্রিকার প্রথম পাতায় ছাপা হলো। এরকম খবর কালের কন্ঠ বা প্রথম আলোতে আঞ্চলিক খবরে খুব ছোট করে ছাপা হবে অথবা ছাপাই হবে না বা হলেও কয়েকদিন পরে হবে যখন খবরটির আর কোন গুরুত্বই থাকবে না। বাংলাদেশের প্রতিটি ইউনিয়ন, প্রতিটি উপজেলায় প্রতিদিন কিছু না কিছু ঘটছে কিন্তু সব খবর সব পত্রিকা সমান গুরুত্বের সাথে ছাপবে না।
Source: http://techcrunch.com/2015/06/04/zopper/
ঠিক একই ভাবে, বড় বড় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান একসাথে অনেক ক্রেতা নিয়ে কাজ করবে। তাদের ভাল অফিস, লোকবল থাকবে, অনলাইনে এবং অফলাইনে মার্কেটিং এর পিছনে তারা কোটি কোটি টাকা খরচ করতে পারবে, উন্নত ডেলিভারি সিস্টেম থাকবে এবং ক্রেতাদের আকর্ষণ করতে তারা প্রথম ব্যবসায় লস দিয়ে হলেও ডিসকাউন্ট দেবে। কিন্তু দিনের শেষে চরম সত্যিটি হচ্ছে তারা সব ক্রেতার প্রতি সমান মনযোগ দিবে না। ক্রেতা কল করার সাথে সাথে তাকে রেসপন্স করা হচ্ছে না। হয়তো একদিন বা দুইদিন পরে ক্রেতাকে রেসপন্স করা হচ্ছে। ক্রেতা হয়তো এমন পণ্য/সেবা অনলাইনে চাচ্ছেন বা খুঁজছেন যেটি বড় বড় প্রতিষ্ঠান সচরাচর বিক্রী করে না ইংরেজীতে যাকে “Niche Market” বলে।
এসব ক্ষেত্রে হাইপার-লোকাল ই-কমার্স ক্ষুদ্র ও মাঝারী ই-কমার্স উদ্যোক্তাদের সাহায্য করতে পারে। উদাহারণ দেই, ধরা যাক, এক্সওয়াইজেড ডট কম একটি উঠতি ই-কমার্স ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী রুবেল দুই বছর চাকরি করার পরে ব্যবসা শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং তার ই-কমার্স ওয়েবসাইট চালু করেছে। এ ওয়েবসাইটে সে ছেলে ও মেয়েদের পোশাক বিক্রী করে। মিরপুরে একটি ছোট অফিসে প্রতিষ্ঠানটি ব্যবসা করছে। আর দশটা ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের মতোই সে ব্যবসা করছে। ঢাকার মধ্যে অর্ডার আসলে সে নিজে বা তার একজন লোক ডেলিভারি দেয় এবং ঢাকার বাইরে এস এ পরিবহন বা অন্য কোন পরিবহনে পণ্য পৌঁছে দেয়। সবই ঠিক আছে। একদিন হঠাৎ রুবেলের মনে হলো আমার মিরপুরে অফিস। এ এলাকার অনেকেই তো পণ্য কিনে আমি এ এলাকার লোকদেরই নির্দিষ্ট ভাবে টার্গেট করি না কেন? কাছাকাছি হওয়াতে আমি সহজেই এলাকার লোকদের কাছে পণ্য কয়েক ঘন্টার মধ্যে পণ্য পৌঁছে দিতে পারব। একবার তাদের বিশ্বাস অর্জন করতে পারলে অনলাইনেও তারা টাকা দিতে দ্বিধা করবে না। শুধু তাই নয়, আমি কাস্টমারের সাথে মুখোমুখি কথা বলতে পারব এবং এলাকার ভিতরে বিভিন্ন উৎসবে অনলাইনের পাশাপাশি সীমিত ভাবে অফলাইনেও প্রচার চালাতে পারব। এভাবে আমি চাইলে আমার ওয়েবসাইটের কিছু লয়াল কাস্টমার তৈরি করে ফেলতে পারব যারা বার বার আমার কাছ থেকে পণ্য ক্রয় করতে পারবে।
আপনিও চাইলে এ কাজটি করতে পারেন। জরুরি না যে স্থানীয় দোকানদার বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পণ্যই আপনাকে বিক্রী করতে হবে। আপনি নিজেই পণ্য সোর্স করে অনলাইনে বিক্রী করলেন। এভাবে কিন্তু আপনি কিছু লয়াল কাস্টমার পাবেন। বড় কম্পানি চলে আসার পরেও কিন্তু দেখবেন আপনার লয়াল কাস্টমার আপনার থেকে কিনছে কারণ উক্ত কাস্টমার আপনাকে ফোন করলে সাথে সাথে আপনি রেসপন্স করছেন অথবা সমস্যা হলেও সে সাথে সাথে আপনার কাছে আসতে পারছে। হাইপার লোকাল ই-কমার্স মডেলে এভাবে একজন ছোট ই-কমার্স উদ্যোক্তা কিন্তু তার নিজস্ব কাস্টমার বেইস গড়ে তুলতে পারে। কাস্টমারদের সাথে নিয়মিত কথা বলার কারণে আপনি জানতে পারবেন যে আপনার কাস্টমার আসলে কি চায় বা কি এক্সপেক্ট করছে আপনার থেকে এবং আপনি সেই জিনিসটি তাকে দিতে পারবেন। বড় বড় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষে এতোটা মাইক্রো-লেভেলে গিয়ে কাজ করা সম্ভব না।
আপনাদের সাথে আমি আরো একটি মজার তথ্য শেয়ার করি। আমি ই-ক্যাব নিউজেও লিখে থাকি। অ্যামাজন ডট কম নিয়ে লিখতে গিয়ে একটি মজার তথ্য পেয়েছিলাম আর তা হচ্ছে। অ্যামাজন বিশ্বের তো বটেই যুক্তরাষ্ট্রেও এখন বাজার দরে সবচেয়ে বড় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান কিন্তু ২০১৪ সালে দেশটির মোট রিটেইলের ৩% শেয়ার ছিল অ্যামাজন ডট কম এর। অর্থাৎ ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে অনলাইন অফলাইন মিলিয়ে মোট বিক্রীর মাত্র ৩% করেছে অ্যামাজন ডট কম। ২০১৮ সাল নাগাদ এ শেয়ার বেড়ে ৬.৯% হবে। অ্যামাজন বিলিয়ন ডলারের প্রতিষ্ঠান কিন্তু নিজের দেশেই তারা সর্বেসর্বা নয়।
তাই ই-কমার্স উদ্যোক্তারা যারা মনে করছেন বড় বড় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আসলে আপনারা কেউ আর ব্যবসাই করতে পারবেন না অবস্থা ততটা খারাপ হবে না। এখন আপনারা যদি কাস্টমারদের ঠিক মতো সেবা দিতে পারেন তাহলেও আপনারা টিকে যেতে পারবেন। হাইপার-লোকাল বিজনেস মডেলে আপনি আপনার সীমিত সম্পদ দিয়েও কিন্তু লয়াল কাস্টমার তৈরি করতে পারবেন। এরাই যদি আপনার কাছ থেকে বারবার পণ্য ক্রয় করে এটাই আপনার বিশাল শক্তি।
হাইপার লোকাল ই–কমার্সের সীমাবদ্ধতাঃ
এতক্ষণ তো বললাম হাইপার-লোকাল ই-কমার্স বিজনেস মডেলের শক্তির কথা বললাম কিন্তু এর সীমাবদ্ধতাও আছে। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সব জায়গায় কিন্তু হাইপার-লোকাল বিজনেস মডেল কাজ করবে না। উদাহারণ স্বরূপ কক্সবাজার এর কথাই ধরলাম। কক্সবাজারের শুটকি অনলাইনে সারা দেশে বিক্রী হচ্ছে কিন্তু কক্সবাজারের স্থানীয় কয়জন লোক অনলাইনে শুটকি কিনবে? এটা বড় সমস্যা। ঢাকা, চট্টগ্রাম বা বড় বড় বিভাগীয় শহর গুলোতে লোকে কম্পিউটার, ইন্টারনেট, স্মার্টফোন ব্যবহার করে এবং অনলাইনে তারা পণ্য কিনে থাকে কিন্তু সব জায়গায় লোকে অনলাইনে কিনবে না । আবার দেশের সব জায়গায় উন্নত ইন্টারনেট নেই। অনেক অঞ্চলে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা খুবই কম বা নেই এবং সেখানে অনলাইনে লোকে কেনাকাটাও করে না। তাই বাংলাদেশের সব জায়গায় হাইপার-লোকাল ই-কমার্স কাজ করবে না।
সূত্রঃ
লেখকঃ
এস এম মেহদি হাসান
7,059 total views, 3 views today