স্যোসাল মিডিয়াকে কাজে লাগান
জাহাঙ্গীর আলম শোভন
সারাবিশ্বে ইন্টারনেট সার্চে গুগল নাম্বার ওয়ান। আর বাংলাদেশে নাম্বার ওয়ান ফেসবুক। মানে আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটিকে সামাজিক যোগাযোগ ছাড়াও ব্যবসায়, রাজনীতি, খবরা-খবর, ক্যারিয়ার, গসিপিং, প্রেম ভালোবাসা ইত্যকার নানাকাজে ব্যবহার করছি। অবশ্য সে সুযোগ ফেসবুক আমাদেরকে দিয়েছে। এই বহুমুখী কাজে ব্যবহার করতে গিয়ে। আমরা আমাদের ব্যক্তিগত একাউন্টকে জগাখিচুড়ি বানিয়ে ফেলছি।
এখন ব্যবসায়, সামাজিকতা, সামাজিক কাজ, জ্ঞানচর্চা,বন্ধুত্ব চর্চা, ধর্মচচা যা কিছুই আমরা ফেসবুকে করিনা কেন সেগুলো আমরা যদি সঠিকভাবে করি এবং আবোল তাবোল কাজ না করে সঠিক কাজটি করি তাহলে ফেসবুক থেকেও আমরা উপকৃত হতে পারি। আমি বলছিনা যে ১০টি টিপস আছে এগুলো মেনে চললে কালই আপনার জীবন বদলে যাবে অথবা আপনি ফেসবুক থেকে ডলার কামাতে পারবেন।
আমি কেবল এটাই বলতে চাই যে, আপনি যে সময়টা ফেসবুকে কাটান, সেটা যদি গসিপিং, অপ্রযোজনীয় লাইক কমেন্ট, আর সিনেমা তারকাদের খোঁজ খবর না নিয়ে শেখার জন্য, জানার জন্য এবং আপনার কাজে লাগবে এমন লোকদের সাথে নেটওয়ার্ক তৈরী করার জন্য ব্যবহার করেন তাহলে ফেসবুকও আপনার কাজে লাগতে পারে। আসুন বিষয়গুলো একটু খোলাসা করা যাক।
এক: লক্ষ্যের সাথে সমন্বয় করুন।
আপনি অবশ্যই আপনার জীবনের লক্ষ্য ঠিক করেছেন বা ভাবছেন বা করবেন। সেটা একটা হতে পারে আবার একাধিক হতে পারে। তাই আপনি আপনার লক্ষ্য ঠিক করুন এবং সেই লক্ষ্যের সাথে সমন্বয় করে ফেসবুক ব্যবহার করুন। আপনি যদি একজন ভালোমানুষ হতে চান। তাহলে আপনার ফেসবুক এর সবকিছুতে তার একটা ছাপ থাকা চাই। অথবা আপনি যদি একজন বক্তা হতে চান। তাহলে ফেবসুকে পাবলিক স্পিকার এবং প্রেজেন্টেশান বিষয়গুলোর সাথে যুক্ত হোন সেগুলো সার্চ দিন। প্রয়োজনে গুগল থেকে সার্চ দিয়ে বের করে ফেসবুকে শেয়ার দিন।
দুই: রুচি ও ব্যক্তিত্বের পরিচয় দেন
প্রতিটি মানুষ নিজের সম্পর্কে উন্নত ও ভালো ধারণা পোষন করে। আপনি নিজেকে কি ভাবেন? তিন মিনিট চোখ বন্ধ করে ভেবে বের করুন এবং তা নোট বইতে লিখুন। আবার ৩০,৪০,৫০,৬০ এই ভিন্ন ভিন্ন বয়সে নিজেকে কি ভাবতে চান এবং সে সময় নিজেকে কোথায় দেখতে চান তাও আলাদা পৃষ্ঠায় লিখুন। এবার আপনি যা হতে চান তার গুণ বা সে ধরনের একজন মানুষের কি কি গুণ ও যোগ্যতা থাকে সেগুলো প্রত্যেক পেজে লিখুন। তা আপনার আছে কিনা নিজেকে যাচাই করুন। সেরকম একজন মানুষের ফেসবুক পেজের পোস্ট, ছবি কমেন্ট কেমন হবে চোখ বন্ধ করে আরেকবার ভাবুন এবং নিজের রুচি ও ব্যক্তিত্বের সাথে সমন্বয় করে কাজ করুন।
তিন: লাইক ও কমেন্ট এ সাবধান হোন
আপনি লাইক বেশী দিচ্ছেন বা কম দিচ্ছেন এটা নিয়ে কোনো সমস্যা নয়। প্রশ্ন হচ্ছে আপনি লাইক কিসে বা কি ধরনের পোস্টে দিচ্ছেন। কারণ ফেসবুক কিন্তু আপনাকে রিড করছে। আপনি যে ধরনের বিষয়তে লাইক দিচ্ছেন আপনাকে সে বিষয়গুলো শুধু ফেসবুক শো করবে। এমনি অনেক বিষয় আপনার চোখের আড়ালে চলে যাবে। তাই আপনার অতি উৎসাহ, ছোকরা মনকে শান্ত করে আপনার প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোকে বেশী করে লাইক করুন এবং ইতিবাচক মন্তব্য লিখুন।
চার: বন্ধু নির্বাচনে বিবেচনার পরিচয় দিন
কখনো বন্ধু সংখ্যার উপর গুরুত্ব দিবেন না। তাহলে আপনি শুরুতেই ভুল পথে চলে গেলেন। তাই পরিচিত গন্ডির বাইরে বন্ধু বানানোর সময় কিছু বিষয়ে গুরুত্ব দিন। তাঁর কর্মক্ষেত্র, শখের জায়গা, ব্যবসায়, চাকরী, প্রফেশনাল ডিগ্রি, সভা সমিতির সভ্য ইত্যাদির সাথে মিল রেখে বন্ধু বানান। তাই সে মানুষগুলোকে বন্ধু বানান যাদের কাছ থেকে শিখতে পারবেন যারা ভবিষ্যতে আপনার কাজে লাগবে। অথবা যে লোকটির টাইমলাইনে আপনি আপনার গ্রামের খবরের আপডেট পান। আপনি যদি অপ্রয়োজনীয় বন্ধু বাড়ান তখন প্রয়োজনীয় বন্ধুদের সাথে দূরত্ব তৈরী হতে পারে।
পাঁচ: রিলেটেড গ্রুপ ও পেজে সংযুক্ত হোন
আপনার প্রয়োজন একদিকে আরেকদিকে ইন্টারেস্ট আরেকদিকে আপনার কাজ। এই তিনটাই তিনরকম হতে পারে বিশেষ করে বাংলাদেশে। যেমন আপনি লেখাপড়া করেছেন ফিজিক্সে এখন আপনি চাকরী করেন ব্যাংকে, কিন্তু আপনার আবার আগ্রহ ছিলো ইতিহাসে, আপনি চাকরী করতে চেয়েছেন কোনো টিভি চ্যানেলে, তবে আপনার শখ হলো বইপড়া আর ঘুরে বেড়ানো, এছাড়া আপনি কিছু সামাজিক কাজ করেন। আপনারও নিশ্চয় এরকম ভিন্ন পছন্দ থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে এই বিষয়গুলো সম্পর্কে জানতে এবং যারা এগুলো এখনো প্রাকটিস করে তাদের সাথে পরিচয় হতে আপনি এইসব পেজে বা গ্রুপের সাথে সম্পর্ক রাখতে পারেন এ ধরনের পেজ বা পোস্টে লাইকও দিতে পারেন। এ ধরনের গ্রুপের মেম্বার হলে আপনার আগ্রহের জায়গায় আপনি থাকতে পারলেন।
ছয়: শেয়ার করতে সাবধানী হোন
আপনি কি শেয়ার করছেন? আপনার শেয়ারকৃত মেটার সবাই দেখছে। এখন আপনার এই মেটারের উপর লোকেরা জাজ করবে। আপনি কেমন মানুষ বোঝার চেষ্টা করবে। তাই আপনি যা শেয়ার করবেন তা যেন আপনার সাথে যায় সেটা খেয়াল রাখুন। কোনো আবেগ বা বিবেকের বশবতী হয়ে যেকোনো পোস্ট বা নিউজ শেয়ার করা ঠিক নয়। কখনো কখনো আপনার ব্যবসায়িক পার্টনার বা অফিস কলিগ আপনার শেয়ার মেটার বা মতটা দিয়েই আপনাকে মাফতে চেষ্টা করবে। হয়তোবা আপনিও অন্যদেরকে সেভাবে বোঝার চেষ্টা করে থাকেন।
সাত: সঠিক নেটওয়ার্কে নিজেকে যুক্ত করুন
অনেকে বিষয়টাকে গুরুত্ব দেন না। ফলে দেখা যায় ভালগার, নোংরা বিভিন্ন পেজে বা পোস্টে লাইক দিয়ে বসে আছেন। এতে করে সেরকমের জিনিসগুলোই বার বার সামনে আসবে। এভাবে অনেকে মজা করার জন্য বিভিন্ন গ্রুপে যুক্ত হন। মজা, ফান বা বিনোদন একেবারেই নিষিদ্ব সেটা বলছিনা। কিন্ত মেনে রাখতে হবে আমরা সাময়িক বিনোদিত হলেও এখান থেকে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে আমরা কোনো ফায়দা তুলতে পারি না। তাই এগুলো যেন আমাদের মূল ফোকাস না হয়। আমাদের মূল ফোকাস যেন আমাদের দরকারের এবং কাজের জিনিস হয়। এটা মাথায় রাখতে হবে।
আট: নলেজকে প্রাধ্যান্য দিন, কাজের কথা ভাবুন
আমরা অনেকেই ফেসবুকে সময় কাটাই। আবার অনেকে ফেসবুকে সময় নষ্ট করি। যাদের জরুরী কোনো কাজ নেই। তারা যখন ফেসবুকে সময় দেই তখন সেটা সময় কাটানো। আর যাদের জরুরী কাজ থাকা সত্বেও ফেসবুকে পড়ে থাকি তারা নিজেদের সময় নষ্ট করি। মনে রাখতে হবে ফেসবুকিং আমাদের দরকারী হতে পারে কিন্তু অত্যাবশ্যক নয়। তাই আমরা যদি ফেসবুকে নলেজভিত্তিক ফেজ, গ্রুফ, ফ্রেন্ড কিংবা ইভেন্ট এর সাথে থাকি। প্রয়োজনে সার্চ দিয়ে নলেজবল তথ্যগুলো জানি। তাহলে আমি যতক্ষণ ফেসবুকে থাকবো ততক্ষণ আমার অন্তত কিছু শেখার কাজটা হবে। তবে কোনো কিছুই মাত্রাতিরিক্ত হওয়া ভালো নয়।
নয়: কমিউনিটির প্রতি একাত্ম থাকুন
মানুষ কিন্তু কমুউনিটি ভিত্তিক জীব। আমাদের খাদ্য, আচরণ, ভাষা, চিন্তা পছন্দ সব সমাজ ও পরিবার থেকে গড়ে উঠে। কমুউনিটি কোন কাজ করলে বাহবা দেবে। কোন কাজ গ্রহণ করবে? কোন কাজ জনপ্রিয় সে হিসেবে আমরা আমাদের কাজ ঠিক করি। তাই কম্যুইনিটির সাথে থাকতে হবে। নিজের চারপাশের কমুইনিটি ছাড়াও শখের কমুউনিটি মনে করুন আপনি একজন বাইকার তাহলে বাইকার কমুউনিটির সাথে থাকুন, আপনি একজন ডাক্তার, বা ডায়াবেটিক রোগী তাহলে সেসব কমিউনিটির সাথে আপনি থাকতেই পারেন।
দশ: ইন্টারেস্ট লেবেলকে ম্যচিউরড করুন
আপনার কিসে ইন্টারেস্ট এটা কিন্তু ফেসবুক প্রতিনিয়ত বুঝতে পারছে। আপনার লাইক, কমেন্ট, শেয়ার বন্ধুদের ধরণ, যেসব পেজে লাইক দেয়া, যেসব গ্রুপে মেম্বার হওয়া, যেসব ইভেন্টে গোয়িং বা ইন্টারেস্টিং দেয়া সেগুলো রিড করে ফেসবুক আপনার ব্যক্তিত্বের ধরণ ধরে নিচ্ছে এবং আপনাকে আরো বেশী সে ধরনের পোস্ট এড ইভেন্ট দেখাচ্ছে। তাই আপনি সর্তক হোন, আপনি নিছক সুন্দর ও ভালোলাগা দেখে লাইক কমেন্ট শেয়ার গ্রুপ পেজ নেয়ার চেয়ে আপনার প্রয়োজন ও চাহিদাকে গুরুত্ব দিন।
এগার: চোখ কান খোলা রেখে কাজ করুন
ফেসবুকে অনেকে নিউজ শেয়ার করে অনেকে অনেক তথ্য বা ঘটনা শেয়ার করে। অনেকে নিজেদের মতামত দেয়। ফেসবুক যেহেতু এগুলো সেন্সর করেনা। তাই এখানে ভুল ও মিথ্যা থাকার সম্ভাবনা থাকে। তাই নিছক আবেগের বশবর্তী হয়ে কোনো কোনো কিছু শেয়ার বা রিপোস্ট দেয়া থেকে বিরত থাকুন। তথ্য উপাত্ত নিন। কিন্তু সেগুলো ব্যবহার বা বিশ্বাস করার আগে সাবধানতার পরিচয় দিন।
ফেসবুকের ফিচারগুলো মানুষের উপকারের কথা বিবেচনা করে তৈরী করা হয়েছে। এগুলো সঠিকভাবে ব্যবহার না করলে উপকার পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। একটি চুরিতে ধার থাকে, একটি মোমবাতিতে আগুন থাকে, একটি চৌবাচ্চায় পানি থাকে একটি বেলুনে গ্যাস থাকে। এখন এই জিনিসগুলো আপনি ২ভাবে ব্যবহার করতে পারেন। এগুলো আপনি আপনার কাজে লাগাতে পারেন আবার এগুলো দিয়ে অন্যের উপকার করতে পারেন। ঠিক তেমনি ভাবে এগুলো আপনি নিজের ক্ষতির জন্য ব্যবহার করতে পারেন এগুলো দিয়ে অন্যের অনিষ্টও করতে পারেন। সিদ্ধান্ত আপনার আপনি কি করবেন।
সূত্র: আমার লেখা বই- নিজেকে গড়ে তুলতে।
4,454 total views, 3 views today