২০১৬ সালে ই-ক্যাব ব্লগে আমার প্রথম পোস্ট। এ লেখাটি দ্যা ওয়াল স্ট্রীট জার্ণাল এ প্রকাশিত “The Future of Mobile Chatting: Commerce” শিরোনামের একটি লেখার অনুবাদ। মূল লেখাটি লিখেছেন দীপা সীতারমণ (DEEPA SEETHARAMAN) এবং জুরো ওসাওয়া (JURO OSAWA)।
চীনে ইন্টারনেট মেসেঞ্জার অ্যাপ্লিকেশনের উত্থান:
২০১১ সালে চীনের অন্যতম বৃহৎ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান টেনসেন্ট হোল্ডিংস লিমিটেড একটি অ্যাপ্লিকেশন চালু করে যার মাধ্যমে স্মার্টফোন ব্যবহারকারীরা একে অন্যকে ফ্রী টেক্সট মেসেজ পাঠাতে পারবেন। পাচঁ বছর পরে আজকে উইচ্যাট (WeChat) দেশটির সবচেয়ে জনপ্রিয় মেসেজিং সার্ভিস। বর্তমানে ৬৫ কোটি লোক উইচ্যাট ব্যবহার করে থাকে। লক্ষ লক্ষ চীনা ব্যবহারকারীরা উইচ্যাট এর মাধ্যমে বন্ধুদের টাকা প্রেরণ, জিনিস কেনাকাটা এমনকি চিকিৎসকের অ্যাপয়েন্টমেন্টও ঠিক করেন। একটি সাধারণ বার্তা আদান-প্রদান অ্যাপ্লিকেশন এখন ইন্টারনেটের প্রাণকেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু তাই নয় এর জনপ্রিয়তা ফেইসবুককেও ছাড়িয়ে গিয়েছে। এশিয়াতেই এ বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছে।
চীনে এমন কোন স্মার্টফোন ব্যবহারকারীকে পাওয়া যাবে না যার উইচ্যাট অ্যাকাউন্ট নেই। চাকুরিজীবি, ব্যবসায়ী, ছাত্র সবাই এটি ব্যবহার করে। অবস্থা এখন এমন পর্যায়ে গিয়েছে যে লোকেরা এখন আর বিজনেস কার্ড আদান-প্রদান করে না তারা তাদের উইচ্যাট ইউজার নেইম আদান-প্রদান করে থাকে।
উইচ্যাটের উত্থানের সাথে চীনের মধ্যবিত্ত সমাজের উত্থানও নিবিড়ভাবে জড়িত। দেশটির অনেক ইন্টারনেট ব্যবহারকারীই তাদের ইন্টারনেটের প্রথম পাঠ নিয়েছেন উইচ্যাট ব্যবহারের মাধ্যমে। চীনে টেক্সট মেসেজ খুবই ব্যয়বহুল। অ্যাক্টিভেট এর মতে চীনে মোবাইলে টেক্সট মেসেজ প্রেরণের খরচ যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় ২৬গুণ বেশি। এটাই দেশটিতে মেসেজিং অ্যাপ্লিকেশন জনপ্রিয় করার অন্যতম প্রধান কারণ। উইচ্যাট চালু করার পরে আস্তে আস্তে আরো নানা ধরণের সেবা প্রদান করা শুরু করে। এর একটি ফিচার আছে অনেকটা ওয়াকি-টকির মতো। উইচ্যাট ব্যবহারকারী তাদের কথা রেকর্ড করে অডিও মেসেজ আকারে পাঠাতে পারে। এর আরেকটি মজার ফিচার হচ্ছে “ড্রিফট বটল” (“Drift Bottle”)। এ সেবার আওতায় কোন উইচ্যাট ব্যবহারকারী ভার্চুয়াল বোতলে করে মেসেজ পাঠিয়ে দেয় এবং আরেকজন ব্যবহারকারী যদি সেই বোতলটি কুড়িয়ে নেয় তাহলে সে প্রেরকের সাথে যোগাযোগ করতে পারে।
২০১৩ সালে উইচ্যাট পেমেন্ট সেবা প্রদান করা শুরু করে। এ ধরণের সেবা চালু করার পেছনে টেনসেন্টের মূল উদ্দেশ্য ছিল আলিবাবা গ্রুপ হোল্ডিংস লিমিটেড এর পেমেন্ট সেবা “আলি-পে” কে চ্যালেঞ্জ করা। সফলভাবে এ কাজটি করার পরে উইচ্যাট তাদের মেসেজিং সার্ভিসের মাধ্যমে আরো নানা ধরণের সেবা দেয়া শুরু করল যেমন-রেস্টুরেন্ট বুকিং, ট্যাক্সি ভাড়া করা ইত্যাদি।
চীনের দ্বিতীয় বৃহত্তম ই-কমার্স সাইট জেডি ডট কম এর শপিং সাইট জেডি মল এর প্রধান নির্বাহী শেন হাউ-ইয়ু বলেন, “এটি (উইচ্যাট) একটি গেটওয়ের মতো যার মাধ্যমে একজন ব্যবহারকারী অনেক সেবা পায়-বিনোদন, তথ্য ইত্যাদি।” জেডি ডট কম এর স্টেইক হোল্ডার টেনসেন্ট হোল্ডিং এবং এ কারণে উইচ্যাট ব্যবহারকারীরা চ্যাট অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে জেডি ডট কম এও কেনাকাটা করতে পারে।
Source: City Weekend
উইচ্যাট এর সবচেয়ে জনপ্রিয় ফিচারের একটি হচ্ছে “ভার্চুয়াল এনভেলপ।” উইচ্যাট ব্যবহারকারীরা এই এনভেলপে করে একে অন্যকে টাকা দিতে ও নিতে পারেন। চীনে চান্দ্র নববর্ষ সবচেয়ে বড় উৎসব এবং এ উৎসবে লাল খামের মধ্যে লোকে টাকা লেনদেন করে। এ লাল খামকে বলা হয় হংবাউ (Hongbao)| উইচ্যাটের “ভার্চুয়াল এনভেলপ” এই ধারণার উপরে ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে। ২০১৪ সালে চান্দ্র নববর্ষে উইচ্যাটে এ ফিচারটি ছাড়া হয়। কিন্তু উইচ্যাট ব্যবহারকারীরা সারা বছরই এখন এটি ব্যবহার করেন। লিন-চুই-লু চীনের গুয়াংদং প্রদেশের সেনজেন শহরের একটি স্টার্ট-আপ প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। তার বয়স ২৭ বছর। সম্প্রতি তারই অফিসের এক সহকর্মী তার জন্যে নিকটবর্তী কেএফসি থেকে দুপুরের খাবার ক্রয় করেন। লিন তাকে উইচ্যাট হংবাউ এর মাধ্যমে ১২ইউয়ান (১.৮৫ ডলার) পাঠান। তিনি আরো বলেন যে সপ্তাহে কয়েকবার তিনি উইচ্যাট হংবাউ এর মাধ্যমে টাকা প্রদান করেন এমনকি বন্ধুদের জন্মদিনেও তাদেরকে হংবাউ প্রেরণ করেন। উইচ্যাট এর মাধ্যমে লিন খাবার, সিনেমার টিকেট এবং ট্যাক্সিও ভাড়া করে থাকেন।
লিন নিজেই বলেন যে অন্যান্য যে কোন অ্যাপ্লিকেশনের তুলনায় তিনি উইচ্যাট বেশি ব্যবহার করে থাকেন।
বিশ্বজুড়ে মেসেজিং অ্যাপ্লিকেশন:
বিখ্যাত ভেঞ্চার ক্যাপিটাল প্রতিষ্ঠান জিজিভি ক্যাপিটাল এর ম্যানেজিং পার্টনার জেনি লি মেসেজিং অ্যাপ সম্পর্কে বলেন, “আর কোন প্রযুক্তিই সিলিকন ভ্যালিতে এত নিবিড়ভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয় নি।”জিজিভি ক্যাপিটাল মোবাইল, ইন্টারনেট, ডিজিটাল মিডিয়া, ইন্টারনেট অব থিংস খাতে বিনিয়োগ করে থাকে।
বিখ্যাত গবেষণা প্রতিষ্ঠান অ্যাক্টিভেট এর সূত্রমতে, বর্তমানে বিশ্বজুড়ে ২.৫ বিলিয়ন লোক কমপক্ষে একটি মেসেজিং অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করছেন। প্রতিষ্ঠানটি ধারণা করছে যে ২০১৮ সাল নাগাদ এ সংখ্যা ৩.৬ বিলিয়নে পৌছুবে অর্থাৎ বিশ্বের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর ৯০% এ ধরণের অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করবে।
প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের মতে বিভিন্ন সেবা সমূহ প্রদানের ক্ষেত্রে মেসেজিং অ্যাপ্লিকেশন আদর্শ জায়গা কারণ মেসেজিং অ্যাপ ব্যবহার করা একদিকে যেমন সহজ তেমনি এর ব্যবহারকারীও বিশাল এবং এসব ব্যবহারকারীরা মেসেজিং অ্যাপ্লিকেশনে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করে।
যুক্তরাষ্ট্রে মেসেজিং অ্যাপ্লিকেশন:
চীনের মতো যুক্তরাষ্ট্রে মেসেজিং অ্যাপ্লিকেশন এতটা জনপ্রিয় নয় কারণে এখানে মোবাইলে টেক্সট মেসেজ পাঠাতে খরচ কম হয়। ২০০৯ সালে কানাডার কিক মেসেঞ্জার যুক্তরাষ্ট্রে ছাড়ে। কিক মেসেঞ্জার ইঙ্ক -এর প্রধান নির্বাহী টেড লিভিংস্টোন বলেন, “পশ্চিমা দেশ সমূহে সেরকম জনপ্রিয় মেসেঞ্জার অ্যাপ্লিকেশন নেই।”
শুরু করার দুই বছর পরে কিক অ্যাপ নির্মাতাদের জন্যে উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। এসব অ্যাপ নির্মাতার তাদের অ্যাপ্লিকেশন গুলো কিক মেসেঞ্জার সার্ভিসের সাথে ইন্টিগ্রেট করতে পারত কিন্তু ব্যবহারকারীরা সেসব অ্যাপ্লিকেশনগুলো ডাউনলোড করেন না। ফলে অ্যাপ নির্মাতারা উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। এর পরে টেনসেন্ট হোল্ডিং কিক-এর ৫০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে।
নড়েচড়ে বসেছে বড় বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান:
মেসেজিং অ্যাপ্লিকেশনের এ উত্থানে বড় বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোও নড়ে চড়ে বসেছে। গত বছরের ডিসেম্বর মাসে বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় ট্যাক্সি সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান উবার টেকনোলজিস একটি নতুন সেবা চালু করেছে যার মাধ্যমে এখন ফেইসবুক মেসেঞ্জার অ্যাপ্লিকেশন থেকে উবারের মাধ্যমে ট্যাক্সি ভাড়া করতে পারবেন। গুগলও এখন একটি নতুন চ্যাট অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করছে যা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে থাকে।
গত বছরে আরেকটি জনপ্রিয় মেসেজিং সার্ভিস স্ন্যাপচ্যাট মিডিয়া প্রতিষ্ঠানের সাথে মিলে ডিসকভারি নামে একটি নতুন সেবা চালু করে যার মাধ্যমে স্ন্যাপচ্যাট ব্যবহারকারী দিনের গুরুত্বপূর্ণ খবর সমূহ পড়তে পারবেন।
স্টার্ট-আপ প্রতিষ্ঠান স্ল্যাক টেকনোলজিস ইঙ্ক শুধুমাত্র ক্ষুদ্র ও মাঝারী ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের জন্যে একটি চ্যাট সার্ভিস চালু করেছে। স্ল্যাক এর লক্ষ্য হচ্ছে এসব প্রতিষ্ঠানের জন্যে এখন আস্তে আস্তে ই-মেইল এর বিকল্প হয়ে ওঠা।
ফেইসবুক মেসেঞ্জার এবং হোয়াটস অ্যাপ:
ফেইসবুকও এখন উইচ্যাট এবং অন্যান্য মেসেজিং সার্ভিস গুলোকে খুবই মনযোগের সাথে পর্যবেক্ষণ করছে কারণ তারাও এখন এধরণের একটি জনপ্রিয় মেসেজিং সার্ভিস তৈরি করার পরিকল্পনা করছে। কিন্তু এ ব্যাপারটি অত সহজ নয়।
ফেইসবুকের নিজস্ব মেসেজিং সার্ভিস আছে এর পাশাপাশি তাদের হোয়াটস অ্যাপও খুবই জনপ্রিয়। বর্তমানে ৯০ কোটি লোক হোয়াটস অ্যাপ ব্যবহার করে থাকে। ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠানটি ২২ বিলিয়ন ডলারে জনপ্রিয় মেসেঞ্জার অ্যাপ্লিকেশন হোয়াটস অ্যাপকে কিনে নেয়। এরপরে এ মেসেঞ্জারের সাথে ফেইসবুককে ইন্টিগ্রেট করে দেয়া হয়। এখন ফেইসবুক ব্যবহারকারীরা এ মেসেঞ্জারের মাধ্যমেই ফেইসবুকে মেসেজ আদান-প্রদান করতে পারেন।
পে-প্যাল এর প্রাক্তন নির্বাহী ডেভিড মার্কাস এখন ফেইসবুক মেসেঞ্জার দেখাশুনা করছেন। তিনি বলেন যে তার টীম কিভাবে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ভোক্তাদের সাথে সর্বদা মেসেঞ্জারের মাধ্যমে যুক্ত থাকতে পারে তা নিয়ে কাজ করছে।
গত বছরের মার্চে ফেইসবুকের এফ৮ কনফারেন্সে প্রতিষ্ঠানটি তাদের মেসেঞ্জারকে নিয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা দিয়েছে। ফেইসবুক মেসেঞ্জার থার্ড-পার্টি অ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপারদের জন্যে উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। অ্যাপ্লিকেশন নির্মাতারা এখন ফেইসবুক চ্যাট এর সাথে তাদের অ্যাপ্লিকেশন ইন্টিগ্রেট করতে পারবে। যখন উন্মুক্ত করা হয় তখন প্রায় ৫০টির মতো অ্যাপ্লিকেশন ছিল এখন এ ধরণের অ্যাপ্লিকেশনের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭০০তে কিন্তু এতগুলো অ্যাপ্লিকেশনের মধ্যে মাত্র ৭০টি মেসেঞ্জারে ব্যবহারকারীরা দেখতে পায়।
ঐ একই কনফারেন্সে জুলিলি এবং এভারলেন এর সাথেও পার্টনারশীপ ঘোষণা দিয়েছে ফেইসবুক। ফেইসবুক মেসেঞ্জার ব্যবহারকারীরা মেসেঞ্জার থেকেই এ দুটি সাইটে কেনাকাটা করতে পারবে।
অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও এখন মেসেঞ্জার অ্যাপ্লিকেশন নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছে:
শুধু ফেইসবুক নয়, অন্যান্য অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এখন মেসেঞ্জারের মাধ্যমে সেবা প্রদান করছে।
গত বছরের নভেম্বর মাসে ডাচ এয়ারলাইন্স কেএলএম ঘোষণা দেয় যে এ বছর থেকে তারা ফেইসবুক মেসেঞ্জারের মাধ্যমে বুকিং কনফার্মেশন এবং বোর্ডিং পাস প্রদান করবে।
হায়াত হোটেলস কর্পোরেশন ফেইসবুক মেসেঞ্জারের মাধ্যমে কাস্টমার সার্ভিস দিচ্ছে। যারা হায়াত হোটেলে আসেন তারা ফেইসবুক মেসেঞ্জার ব্যবহার করে রুম সার্ভিসকে তোয়ালে দেবার অর্ডার দিতে পারেন এবং অন্যান্য সেবাও নিতে পারেন। হায়াত হোটেল কর্পোরেশন ডিজিটাল স্ট্র্যাটেজি এবং অ্যাক্টিভেশন বিভাগের প্রধান ড্যান মরিয়ার্টি বলেন যে, অনেক ভোক্তা মেসেঞ্জারের মাধ্যমে “হাই” পাঠিয়ে পরীক্ষা করে দেখেন আসলেই উত্তর পাওয়া যায় কিনা।
সূত্রঃ
লেখকঃ এস এম মেহদি হাসান
11,996 total views, 6 views today