মার্কেটিং বেসিক

মার্কেটিং ও ফোর পি

জাহাঙ্গীর আলম শোভন

আমেরিকান মার্কেটিং এ্যাসোসিয়েশন-এর প্রদত্ত সংজ্ঞানুসারে: ‘‘সংগঠন ও স্টেক হোল্ডারদের সুবিধার্থে ক্রেতা সম্পর্কভিত্তিক ব্যবস্থাপনা এবং ক্রেতা সৃষ্টি, যোগাযোগ স্থাপন ও মূল্য প্রদানের লক্ষ্যে সম্পাদিত সাংগঠনিক কার্যক্রম এবং প্রক্রিয়ার সমষ্টিকেই বাজারজাতকরণ বলে’’।
মার্কেটিং নিয়ে কথা হবে অথচ ফিলিপ কটলারের নাম হবে না, তা কি হয়? হাঁ এই ভদ্রলোককে বলা হয় আধুনিক মার্কেটিং এর জনক। তিনি বলেনঃ marketing is about Satisfying needs and wants through an exchange process|  অনেকেই মনে করে মার্কেটিং মানেই হল প্রসার, কেউ মনে করে মার্কেটিং মানে এড বা বিজ্ঞাপন দেয়া আবার কেউ একেবারেই অন্যটা মনে করেন তারা মনে করেন মার্কেটিং মানে প্রোডাক্টস সেল করা। মার্কেটিং এ প্রচার এবং প্রসার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং এর অন্যতম একটি উদ্দেশ্য হলো পন্য বিক্রয় করা। আসলে মার্কেটিং হলো একগুচ্ছ কাজের সমাহার এর অনেকগুলো উদ্দেশ্যও রয়েছে।

মার্কেটিং তখনি শুরু হয়ে যায় যখন একজন উদ্যোক্তা একটি পন্য সংগ্রহ করে কিংবা উৎপাদন করে বাজারে আনবেন বলে চিন্তা ভাবনা শুরু করেন। আসলে পণ্যসামগ্রী উৎপাদকের কাছ থেকে ভোক্তার কাছে পৌঁছাতে যে কার্য সম্পাদিত হয় তার সমষ্টি বাজারজাতকরণ বা মার্কেটিং। আমরা শুধু বাইরে থেকে দেখি মার্কেটিং এমন কাজগুলো যেগুলো উৎপাদক ও উৎপাদকের পন্য সম্পর্কে ভোক্তাকে সচেতন করে তোলে এবং ভোক্তার মাঝে পন্যটি পাওয়ার আগ্রহ জাগ্রত করে। আসলে যেকোনো পণ্য উৎপাদনের লক্ষ হলো ভোক্তার কোনো প্রয়োজন পূরণ বা কোনো সমস্যার সমাধান। তাই অন্যকথায়, ভোক্তাকে উদ্দেশ্য করেই পন্য বিপনন ও বাজারজাতকরণের যে সমস্ত কার্যক্রম চিন্তা করতে হয় সেগুলোর সমষ্টি মার্কেটিং।
প্রত্যক্ষ প্রচার (ডাইরেক্ট প্রমোশন): যখন কোনো বিজ্ঞাপন বা প্রচারে সরাসরি পন্য বিক্রয়ের কথা বলে তখন সেটাই প্রত্যক্ষ প্রচার।
পরোক্ষ প্রচার (ইনডাইরেক্ট প্রমোশন): যখন সরাসরি পন্য প্রচারের কথা না অন্যভাবে পন্যকে বা কোম্পানীকে তুলে ধরা হয় তখন সেটাকে পরোক্ষা প্রচার বলে।

কাস্টমারের মনে একটি পণ্যের ইউনিক বা অনন্য নাম এবং পরিচিতি তৈরি করাকে ব্র্যান্ডিং বলা হয়। এক কথায় বলতে গেলে ব্র্যান্ডিং হচ্ছে আপনার ক্রেতার প্রতি আপনার পণ্যের মান ও সেবার প্রতিশ্রæতি।

অন্যভাবে বলতে গেলে ব্র্যান্ডিং একটি ভিন্ন ধরনের পরোক্ষ প্রমোশন প্ল্যান। মার্কেটিং এর ক্ষেত্রে ক্রেতাকে পন্যটি কিনতে একরকম পটানোর চেষ্টা করা হয়। ব্রান্ডিং ব্যাপারটা তেমন নয়। ব্র্যান্ড তার কাস্টমারকে পুশ করে না, পুল করে। প্রলুব্ধ না করে তার নিজের প্রতি আকর্ষণ তৈরী করে বা ইতিবাচক ধারণা তৈরী করে। এতে ক্রেতাকে পন্যটি ক্রয় করতে বলা হয় না ক্রেতাই পন্যের প্রতি উৎসাহ বোধ করে। সুপরিকল্পিত ব্র্যান্ডিংএর মাধ্যমে আপনি খুব সহজেই আপনার পণ্যের ক্রেতা আকৃষ্ট করতে পারবেন এবং ব্র্যান্ড ইমেজ বজায় রেখে ব্র্যান্ডিং সঠিকভাবে করতে পারলে পণ্য বিক্রির কাজ খুব সহজ হয়ে যায়।
পৃথিবীতে অনেক বড় বড় ব্র্যান্ড রয়েছে, আমরা নিজেরাই এইসব ব্র্যান্ড এর কাছ থেকে পণ্য কিনতে আকৃষ্ট হই খুব সহজেই। কিছু ব্রান্ড তাদের ব্রান্ড ইমেজ এমনভাবে প্রতিষ্ঠা করেছে যে, তাদের গাড়ি অনেক দাম দিয়ে কিনতে পারলে কাস্টমার খুশি হয়। যেমন ফেরারি। তাদের পণ্য বেশীরভাগ মানুষেরই কেনার সামর্থ্য নেই, তবুও অনেকে স্বপ্ন দেখে আর ভাবে, আহা! আমার যদি একটা ফেরারি গাড়ি থাকতো!

মার্কেটিং প্লান
মার্কেটিং প্লান বলতে প্রধানত ৪টি বিষয় নিয়ে কাজ করতে হয়। আর এগুলুকেই মার্কেটিং মিক্সও বলা হয়। কেউ কেউ এগুলোকে ফোরপি বলে থাকেন।

প্রডাক্ট
বেশীরভাগ ক্ষেত্রে আমরা যেটা করি তাহলো প্রডাক্ট বের করি তারপর মার্কেটিং শুরু করি। বড় বড় কোম্পানি কিন্তুতারা আগে ক্রেতা ঠিক করে তার তাদের চাহিতা মত পণ্য তৈরি করে। মানে গবেষনার মাধ্যমে জেনে নেয় তারা কোন গ্রæপের ক্রেতাদের সেবা দিবে এবং কি সেবা দিলে তারা তা গ্রহণ করবে। এতে করে তাদের বাজারে নামার আগে বেশকিছু কাজ করতে হয় কিন্তু মার্কেটে এসে ক্রেতার কাছে পৌছতে খুব বেগ পেতে হয়না। এক্ষেত্রে পন্য ও ক্রেতা নিয়ে গবেষণা করে পন্য তৈরীর পরিকল্পনা পুরোটাই মার্কেটিং এর অংশ।
পণ্যের শ্রেণী উদাহরণ
সেবা পণ্য : ফ্রিজ, চুলা, ফ্যান, ওভেন, বাইসাইকেল,
আবশ্যক পণ্য : চাল, ডাল, কাগজ, লবণ, পোশাক
জরুরি পণ্য : ঔষধ, খুচরা যন্ত্রাংশ, গাড়ির তৈল, জ্বালানী,ফোন
প্রযুক্তিপন্য : কম্পিউটার, মোবাইল, রেফ্রিবারেটর
সৌখিন পণ্য : অলংকার, দামি আসবাবপত্র, গিফট সামগ্রী
ভার্চুয়াল পন্য : গান, সফটওয়ার, ডিজাইন, ওয়েবথিম
বিশিষ্ট পণ্য : ক্যামেরা, দামী মোবাইল ফোন
ইন্টেলেকচুয়াল পন্য: বই, চিত্র, সিনেমা
বিলাসী পন্য : কসমেটিক্স, খেলনা, ফুলদানি

সেবা:

সেবা বলতে এমন কার্যাক্রমকে বোঝায় যা অদৃশ্যমান, অস্পর্শনীয় এবং গ্রাহকের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য লেনদেনে প্রধান লক্ষ্য বস্তু অর্পিত হয় কিন্তু মালিকানা স্বত্ব সৃষ্টি করে না। সেবার বৈশিষ্ট্য নিন্মরুপ
১. অস্পর্শনীয়তা (Intangibility))
২. অবিচ্ছেদ্য (Inseparability)
৩. বৈসাদৃশ্যতা(Heterogeneity)
৪. নশ্বরতা (Permeability)
প্রাইস
দাম নিয়ে কাজ দামাদামী? অনেক সময় বাজারে কোনো কিছু কিনতে গেলে। আমরা আগে বলি ‘‘দামটা বলেনতো’’? আর ক্রেতা বলে ‘‘আপনার পছন্দ হয়েছে কিনা সেটা আগে বলেন’’। মানে দাম একটা ফ্যাক্টর। সত্যিইতো ¯্রফে দামের জন্যইতো আজ অবধি কতো কিছু কেনা হলো না। একটা চার্টাড প্লেন কিংবা সমুদ্রের ধারে প্রাসাদসম বাড়ী। টাকা থাকলে কতো কিছু না করা যেত! কিংবা দাম কম হলে কতো কিছুইনা কেনা যেত!
সহজ কথা হলো, কোনো পন্য বাজারে আনার আগে আপনার টার্গেট কাস্টমার সেটা পয়সা দিয়ে কিনবে কিনা কিনলে কত টাকা দিয়ে কিনবে ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করে পন্যের মূল্য ঠিক করতে হয়। আবার পন্যটির সংগ্রহ ও উৎপাদন প্রক্রিয়াও দেখতে হবে। দেখতে হবে অন্য কোম্পানী কি দামে বিক্রি করছে। লাভ লোকসানের হিসাবতো থাকতেই হবে। এজন্য পন্যের মূল্য নির্ধারণ করাও বাজারজাতকরণ পরিকল্পনার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

প্লেস
আমরা যখন কোনো বাজার চিন্তা করি। সেটা একটা এলাকার উপর। এমনকি আমরা অর্থনীতির ভাষায় যে বাজারের কথা বলছি। সেটার একটা আকৃতি বা সাইজ আছে। মানে সে বাজারের ক্রেতারা কতটুকু এলাকাজুড়ে বসবাস করেন। বা তাদের সংখ্যা কতো কিংবা তাদের চাহিদা কতো। এসব মিলিয়ে বাজারের আকার। এটা একটা স্থান বা এলাকা নির্দেশ করে। এমনকি আধুনিক যুগের ভার্চুয়াল বাজারও কিছু পরিমাণ ভাচুয়াল নাগরিক বা নেটিজেনের সমন্বয়ে গঠিত এবং এখানেও একটা ভার্চুয়াল সাইজ বা সংখ্যা নির্দেশ করে। তাই আমরা বলতে পরি। আপনি যে পন্য বাজারে আনছেন সেটির কোনো প্লেসে বা কাদের মাঝে বা কতো জনের জন্য কি পরিমাণ করবেন এসব বিস্তারিত পরিকল্পনা থাকা চাই। আর বিষয়টাই হলো মার্কেটপ্লেস বা প্লেস অব মার্কেট। এছাড়া আপনি ক্রেতা কিংবা আপনার বিক্রেতা কেউ হাওয়ায় ভেসে থাকে না এমনকি আপনার পন্যটিও না। সবার জন্য স্থান বা জায়গা প্রয়োজন হয়। আপনার মার্কেটিং পরিকল্পনায় আপনার জানা থাকা চাই এই জায়গা সম্পর্কে।

প্রমোশন
এলাকায় যাদের লোকে বেশী চেনে তাদের আমরা বলি গণ্য লোক আর লোকেরা যাদের বেশী শ্রদ্ধা করে তাদেরকে বলি মান্য লোক। আর উভয়কে একসাথে বলি গন্যমান্য ব্যক্তিগবর্গ। এই প্রমোশনই হলো মার্কেটিং প্লানের সবচেয়ে দৃশ্যমান কার্যাবলী। সহজ কথায় গণ্যমান্য কাজ। আপনি আগে যাই করুন না করুন প্রমোশনের মাধ্যমই ক্রেতার তার সব খবর জানতে পারে। আপনার পন্য নির্বাচন কিংবা ক্রেতা নির্বাচন কিংবা বাজার বা স্থান নির্বাচন এসব কিছুর ভিত্তি করে তৈরী হয় প্রমোশন প্লান আর প্রমোশনের মাধ্যমেই ক্রেতা জেনে যায় আপনার বার্তাটি। প্রমোশন মার্কেটিং প্লান এর সবচেয়ে আলোকোজ্জল অংশ।

সূত্র: জাহাঙ্গীর আলম শোভনের বই ক্রিয়েটিভ মার্কেটিং

25,998 total views, 9 views today

Comments

comments

Your email address will not be published.