হাইপার-লোকাল ই-কমার্স সিরিজের এ পোস্টে ভারতে হাইপার-লোকাল ই-কমার্স নিয়ে কথা বলব। ভারতে হাইপার-লোকাল ই-কমার্স এখন উঠতি পর্যায়ে আছে। ভারতের ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রি বিশেষজ্ঞদের মতে দেশটিতে বর্তমানে ই-কমার্স বাজারের আকার ১৬ বিলিয়ন ডলার এবং ২০২০ সাল নাগাদ এটি ৮০ বিলিয়ন ডলার হবে।
ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি, বিভিন্ন ধরণের পেমেন্ট অপশন এবং জিও-লোকেশন ফিচার সম্পন্ন ডিভাইসের জনপ্রিয়তার ভারতে হাইপার-লোকাল ই-কমার্সকে জনপ্রিয় করেছে। ভারতের দ্যা অ্যাসোসিয়েটেড চেম্বার্স অব কমার্স অব ইন্ডিয়া (অ্যাসোচ্যাম)এবং প্রাইস-ওয়াটার হাউজ কুপার্স ইন্ডিয়া এর মিলিত একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে যে গত বছরে ৪ কোটি ভারতীয় ভোক্তা অনলাইনে একবারের জন্যে কেনাকাটা করেছে এবং এ সংখ্যা এ বছরে ৬ কোটি ৫০ লক্ষে পৌঁছবে। ২০২০ সাল নাগাদ ভারতের ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রি ১০০ বিলিয়ন ডলারের বাজার হবে।
অনলাইনে ক্রেতা পণ্যের অর্ডার দেবার পরে হাইপার-লোকাল ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো স্থানীয় রিটেইলারদের থেকে পণ্য সংগ্রহ করে ক্রেতাদের কাছে সরবরাহ করছে। হাইপার-লোকাল মডেলের সুবিধা হচ্ছে, এখানে প্রথাগত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের মতো বড় বড় অবকাঠামো তৈরি করা লাগছে না। ভারতে যোগাযোগ ব্যবস্থা খুব একটা উন্নত নয়। তাই প্রথাগত ই-কমার্স মডেলে ফুলফিলমেন্ট সেন্টারে পণ্য স্টক করে অনলাইনে অর্ডার পাবার পরে সেটা ক্রেতাকে পৌছে দিতে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রচুর টাকা গুণতে হচ্ছে (ভারতের ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো ডেলিভারি সমস্যা নিয়ে আমি ইতিমধ্যে একটি পোস্ট দিয়েছি। সেটা পড়ে দেখতে পারেন লিঙ্ক: http://goo.gl/fB41gP) শুধু তাই নয় অনলাইন ক্রেতারাও এখন কয়েক ঘন্টার মধ্যে ডেলিভারি চাচ্ছেন যা ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান গুলোর উপরেও চাপ সৃষ্টি করেছে।
ভারতে ভেঞ্চার ক্যাপিটাল প্রতিষ্ঠানগুলো এখন হাইপার-লোকাল ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করা শুরু করেছে। এ বছরে ভারতে ভেঞ্চার ক্যাপিটাল থেকে সবচেয়ে বেশি টাকা পেয়েছে হাইপারলোকাল ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো। ইয়োরস্টোরির সূত্র মতে, হাইপার-লোকাল ই-কমার্স স্টার্ট-আপ সমূহ বিভিন্ন বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে মোট ১৭০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ পেয়েছে যা বড় বড় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোকেও চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। এখনো পর্যন্ত শুধুমাত্র বড় বড় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোই ৩০মিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগ যোগাড় করতে পারত কিন্ত এখন সে চিত্র আস্তে আস্তে বদলে যাচ্ছে।
সেকুয়্যো ক্যাপিটাল এর ভেঞ্চার ফাণ্ডের প্রধান অভিক আনন্দ এ ধারাকে “disrupt[ing] e-commerce 1.0” হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন যেখানে ক্রেতা অনলাইনে কেনাকাটা করার কয়েক মিনিটের মধ্যে ডেলিভারি পাচ্ছেন। সেকুয়্যো ক্যাপিটাল এ পর্যন্ত চারটি গ্রসারি এবং ফুড-ডেলিভারি প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করেছে এর মধ্যে আছে গ্রফার্স, টাইনি আউল, এবং পেপারট্যাপ। এসএআইএফ পার্টনার্স তিনটি হাইপারলোকাল প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করেছে- সুইগি, পেপারট্যাপ, স্পুন জয়।
ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকটি হাইপার-লোকাল ই-কমার্স স্টার্ট-আপ সফলতার সাথে ব্যবসা করছে। এ ধরণের ই-কমার্সের ফলে দেশটিতে ভোক্তারা ঘরে বসেই তাদের স্থানীয় দোকান থেকে পণ্য কিনছেন, ইলেকট্রিশিয়ান, প্লাম্বারের সেবা নিচ্ছেন।
এরকম একটি সফল হাইপার-লোকাল ই-কমার্স কম্পানির উদাহারণ হচ্ছে জপার। জপার একটি মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন এটি কনজ্যুমার ড্যুরেবলস পণ্য (ফ্রিজ, টিভি, ফার্ণিচার ইত্যাদি যেসব পণ্য প্রতিদিন কেনা হয় না), ইলেক্ট্রনিক্স পণ্য বিক্রী করে থাকে। এর সার্চ ইঞ্জিনের মাধ্যমে একজন ক্রেতা ঐ অঞ্চলের বিক্রেতাদের কাছে থেকে পণ্য ক্রয় করতে পারেন। শুধু তাই নয় একই পণ্য বিভিন্ন বিক্রেতা কি দামে বিক্রী করছেন অর্থাৎ পণ্যের দাম তুলনা করতে পারেন। বর্তমানে ৫০০০ রিটেইলার যপার প্ল্যাটফর্মের সাথে যুক্ত। এ বছরের মধ্যে যপারের লক্ষ্য হচ্ছে ২৫০০০ বিক্রেতাকে তাদের প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসা এবং ভারতের আরো ১৫টি শহরে তাদের সেবা বিস্তার করা।
জপারের নিরাজ জৈন দ্যা ইকনোমিক টাইমস কে বলেন যে ভারতের ২৫ কোটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মধ্যে মধ্যে মাত্র ৩ কোটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী অনলাইনে কেনাকাটা করেন। ক্যাশ-অন-ডেলিভারি, আকর্ষণীয় ডিসকাউন্ট এবং রিটার্ণ-পলিসি সহ বিভিন্ন অফার দেবার পরেও সেভাবে বিক্রী হয় না। তার মতে এর পিছনে প্রধান কারণ হচ্ছে অনলাইনে ক্রয়কৃত পণ্যের মান এবং বিক্রোয়ত্তর সেবা নিয়ে ক্রেতারা সন্দিহান। হাইপার-লোকাল ই-কমার্স এ সমস্যার উপযুক্ত সমাধান। এতে বিক্রেতারা ক্রেতাদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারছে। একজন ক্রেতা জানে যে কোন দোকান থেকে সে পণ্যটি কিনছে এবং প্রয়োজন হলে সেই দোকানে সে যেতে পারে এবং মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে যে কোন সমস্যার সমাধান পাবে।
ভারতের প্রথম সারির ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান-অ্যামাজন, ফ্লিপকার্ট, পেটিএম ইতিমধ্যেই হাইপার-লোকাল ই-কমার্সের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠেছে।
বেঙ্গালুরুতে অ্যামাজন পরীক্ষামূলক ভাবে চালু করেছে অ্যামাজন কিরানা নাউ এ বছরে প্রতিষ্ঠানটি চালু হয়েছে। শুধু তাই নয় ক্রেতাদের কাছে পণ্য দ্রুত পৌঁছে দেবার জন্যে গত বছর থেকে অ্যামাজন ভারতের বিভিন্ন শহরের স্থানীয় দোকানগুলোকে পিক-আপ এবং ডেলিভারি পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহার শুরু করেছে। বর্তমানে ভারতের ২৮টি শহরের ৫০০ দোকানের মাধ্যমে অ্যামাজন পণ্য ডেলিভারি দিচ্ছে।
অ্যামাজন এর কান্ট্রি-হেড অমিত আগরওয়াল বলেন, “অ্যামাজন ইন্ডিয়াতে দ্রুত ডেলিভারি দেবার ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে এ বিচারে হাইপার লোকাল ই-কমার্স আমাদের জন্যে পরের ধাপ। দ্রুত ডেলিভারি দেবার ক্ষেত্রে সেরা উপায় হচ্ছে স্থানীয় বিক্রেতাদের সাথে পার্টনারশীপে আসা যারা ক্রেতার হাতের নাগালের মধ্যে আছে।”
পেটিএম স্টোর পেটিএম জিপ গ্রসারি মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন পরীক্ষামূলকভাবে বেঙ্গালুরুতে চালু করেছে।
ট্যাক্সি ক্যাব সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ওলা চালু করেছে হাইপার-লোকাল গ্রসারি মোবাইল অ্যাপ ওলা স্টোর
ভারতের সবচেয়ে বড় অনলাইন গ্রসারি বিক্রেতা বিগ বাস্কেটও হাইপার-লোকাল ই-কমার্স সেবা চালু করার ঘোষণা দিয়েছে। তারা স্থানীয় দোকানের সাথে মিলে ক্রেতাকে পণ্য বিক্রী করবে।
পেপারট্যাপ এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা নবনীত সিং বলেন, “অদূর ভবিষ্যতে ভারতের ই-কমার্স হাইপার-লোকাল ই-কমার্সে পরিণত হবে কারণ এটি সাশ্রয়ী।” তবে অনেকেই ভিন্নমত পোষণ করেন এবং ইনভেন্টরি-ভিত্তিক ই-কমার্স ব্যবসাকে সমর্থন করেন। বিগ বাস্কেটের কৃষ্ণন গণেশ এর মতে ইনভেন্টরি-ভিত্তিক ব্যবসার ক্ষেত্রে বিক্রেতাকে পণ্য সংগ্রহ নিয়ে চিন্তা করতে হয় না এবং ক্রেতাকে সে তার পছন্দের পণ্যটি দিতে পারে। এ ক্ষেত্রে ক্রেতা-সন্তুষ্টি অর্জন করা যায় কিন্তু মার্কেটপ্লেস মডেলে তা সম্ভব নয় কারণ ক্রেতার পছন্দের পণ্য যে সবসময় পাওয়া যাবে তার কোন গ্যারান্টি নেই।
ভারতের হাইপার-লোকাল ই-কমার্সের ভবিষ্যত নিয়ে গ্রফার্স এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা অলবিন্দর ঢিণ্ডসা বলেন যে ক্রেতা মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করে তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অর্ডার দিতে পারবে এবং এর ফলে অদুর ভবিষ্যতে ক্রেতা অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহারে করে কি কি ক্রয় করছে তার উপরে ভিত্তি করে স্থানীয় বাজারে পণ্য রাখা হবে।
সূত্রঃ
লেখক: এস এম মেহদী হাসান
9,011 total views, 2 views today