ব্যবসায় ও বন্ধুত্ব
জাহাঙ্গীর আলম শোভন
তরুন ব্যবসায়ীদের মধ্যে সফলতার হার কত? আমাকে যদি কেউ এই প্রশ্ন করে। আমি তাকে পাল্টা প্রশ্ন করবো যে, আপনি কোন তরুন ব্যবসায়ীদের কথা বলছেন। যদি সেসব তরুন উদ্যোক্তাদের কথা বলেন যারা না জেনে না বুঝে আবেগে ব্যবসা শুরু করেছে তাদের মধ্যে ব্যর্থতার হার হবে শতকরা ৮০ ভাগ। আর যারা জেনে বুঝে সময় নিয়ে সঠিকভাবে ব্যবসা শুরু করতে পেরেছে তাদের সফলতার হার অন্তত ৮৫ ভাগ। এটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত অবজার্ভেশন।
তরুন ও নবীন উদ্যোক্তাদের যারা প্রথমবার বিফল হয়েছেন। তাদের অনেকগুলো কারণের মধ্যে রয়েছে। বন্ধুবান্ধবসহ ব্যবসা শুরু করা। এটা একটা ভালো ব্যাপার কয়েকজন মিলে ব্যবসা করলে অনেকগুলো সুবিধা রয়েছে। কারণ সবাই সবকিছু জানে না। অনেকে মিলে ব্যবসা করলে জনার গ্যাপটা কিছুটা পূরণ হয়। আর টিম ওয়ার্কের একটা ব্যাপার আছে। কিন্তু তবুও যৌথভাবে ব্যবসা শুরু করে ব্যর্থ হওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করলে সবাই বলবে ভুল পার্টনার নির্বাচন করেছিলেন তারা।
এখন সেইসব তরুনদের যদি আপনি প্রশ্ন করেন, ব্যবসা কি ২/৪ জন মিলে শেয়ারে করা ভালো নাকি একা একা, তাদের ১০০ জনের মধ্যে ৯৯ জন বলবে- ‘‘ভাই জীবনে মইরা গেলেও কাউকে ব্যবসার ভাগীদার করবেন না। যা পারেন একাই করেন, দরকার হলে ছোট করে করেন।’’
একই প্রশ্ন সেইসব উদ্যোক্তাকে যদি করা হয় যারা এখনো শুরু করেনি তাদের ৩০ ভাগ বলবে ব্যবসা আসলে কয়েকজন মিলে করলে ভালো, দেখি কি করা যায়, সেরকম কাউকে পেলে নেব। ৩০ জন বলবে না ভাই একাতো পারবোইনা। বন্ধুবান্ধব মিলে করবো। ৪০ জন বলবে একাও করতে পারি তবে বন্থু বান্ধব মিলেও করা যায়। এটা কোন সমস্যা নয়। এটাও কোন পরিসংখ্যান নয়।
এতক্ষণে আপনি হয়তো মনে মনে একটা সিদ্ধান্তের খসড়া করে ফেলেছেন যে, যেহেতু যারা অভিজ্ঞ তারা বলছে শেয়ারে ব্যবসা করতে গিয়ে ধরা খেয়েছে। সূতরাং কি দরকার। ঝামেলায় না যাওয়াই ভালো।
আমি আপনাকে নতুন করে ভাবতে পরামর্শ দেবো।
শুধু সাদা আর কালো নয়
সাদা এবং কালোর মাঝামাঝি রং আছে। যাকে বলে ধুসর। আবার তার মাঝেও রং আছে কালোটা একটু কম হলে হবে হালকা কালো, আর সাদাটা একটু কম হলে বলবেন অফহোয়াইট বা প্রায় সাদা। কেউ বলছেন অবশ্যই পার্টনার লাগবে আবার কেউ বলছেন, না না এই ভুল করা যাবেনা। তাহলে এই দুয়ের মাঝামাঝি পথটাই আপনাকে বেছে নিতে হবে।
আপনি পার্টনার নেবেন পর্টনার যদি ব্যবসায়িক পার্টনার হিসেবে উপযুক্ত হয় তবে। তা না হলে আপনার পার্টনার প্রয়োজন এজন্য আপনি পার্টনার নিতে পারেন না। আপনি ক্ষুধা পেলে খান, এর অর্থ এই নয়যে আপনি সামনে যা পান তাই খেয়ে পেলেন। আপনি সভ্যতা ও শিষ্টাচার এর জন্য পোষাক পরেন এর অর্থ এই নয় যে আপনি যেকোন একটা কাপড় হলেই পরে ফেলেন। আপনি বিশ্রাম ও শরীরের প্রয়োজনে ঘুমান এর অর্থ এই নয়যে আপনি যেখানে ঘুম পায় সেখানে শুয়ে পড়েন। একই কথা আপনার পার্টনারের বেলায় প্রযোজ্য।
বন্ধু মানেই ব্যবসায়িক পার্টনার নয়
তিনি আপনার ঘনিষ্ট বন্ধু। দুজন ছোটবেলা থেকে একসাথে। দুই ফ্যামিলির মধ্যেও যাওয়া আসা আছে। দুজনের জামা পর্যন্ত দুজন যার যখন যেটা পছন্দ সে সেটা পরে নেন। দজনের মানিব্যাগ পর্যন্ত এক । যার যখন যে কাজে টাকা দরকর হয় একজনের পকেট থেকে দিয়ে দেন। কখনো হিসেব হয়না কে কত খরচ করলো কে কত দিলো। এরপরও তাকে ব্যবসায়িক পার্টনার হিসেবে নেবেন না। আপনি দেখবেন যে যৌথ ব্যবসা শুরু হলে
১. আপনার বন্ধু ব্যবসায়িক মেজাজ রাখতে পারবে কিনা? সে কি ভাববে ও আমরা ২ জন। দোকান যখন যা খুশি নেব, যা খুশি খরচ করবো এটা কোনো ব্যাপার না সেও তো আমার কতোটাকা এমনি এমনি খরচ করে।
২. আপনি যে বিষয়ে ব্যবসা শুরু করছেন যে ঐ বিষয়ে ভালো ধারনা রাখে কিনা?
৩. তার ব্যবসায়িক নলেজ বা অন্যান্য যোগ্যতা আছে কিনা
৪. তার যেকোন কন্ট্রবিউশন বা এনভলবমেন্ট নিশ্চিত করেছেন কিনা।
৫. ব্যবসার উপর আপনার কন্ট্রোল থাকবে কিনা। বিশেষ করে যদি আপনি ব্যবসা সম্পর্কে পার্টনারের চেয়ে ভালো জানেন অথবা আপনার কন্ট্রিবিউশন বেশী থাকে তাহলে ব্যবসার আপর আপনার নিয়ন্ত্রন থাকা জরুরী। অনেকসময় আমাদের কিছু বন্ধু থাকে খুব বেশী বোঝেনা কিন্তু সে আবার একটু আগারগোঁয়া, মানে না বুঝেও সব কিছু আগেই নিজের ধারনামতো করে বসে পরে দেখা যায় এতে বড় সমস্যা হয়ে বসেছে।
ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত আবেগ থেকে নিতে হয়না
বন্ধু বান্ধবদের উপকার করা বিপদে পাশে দাঁড়ানো আমাদের সমাজের অংশ। এটা আমাদের ঐতিহ্য এটা আমাদের সবার করা উচিত। কিন্ত এজন্য আপনি আপনার অসহায় বন্ধুকে সহায় করার জন্য তাকে ব্যবসায়িক পার্টনার করবেন না। যদি সে পার্টনার হওয়ার উপুক্ত না হয়। কারণ ব্যবসাটা আপনার। আপনার বন্ধুকে আপনি অন্যভাবেও সহযোগিতা করতে পারবেন। কিন্তু ভুল সিদ্ধান্তের কারণে যদি আপনি ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হন তাহলে ব্যবসাতো যাবেই হয়তো বন্ধুকে হেল্প করার মতো অবস্থা আপনার থাকবেনা।
তারপারও যদি নিতান্ত প্রয়োজন হয় তাহলে আপনি তাকে আপনার একটি পন্য সাপ্লায়ের কাজ দিতে পারেন। যাতে তারও কিছু লাভ হবে। এবং সেটা আপনার ব্যবসায়ে কোন প্রভাব ফেলবেনা।
বন্ধুও ব্যবসায়িক পার্টনার হতে পারে।
হাঁ বন্ধুও ব্যবসায়িক পার্টনার হতে পারে। যদি সে ব্যবসাকে ব্যবসা হিসেবে দেখে, বন্ধুত্বের কোন বিষয় হিসেবে নয়। এবং তার পরিশ্রম বিনিয়োগ ও সিরিয়াস হওয়ার মানষিকতা থাকে।
আর ব্যসায়িক ব্যাপারে হিসাবপত্র আলাদা এটা বন্ধুত্বের বিষয় নয় এই কথাটা সে কতটুকু বোঝে এটাও জানতে হবে। আপনার আপনি ব্যবসাটা ব্যবসায়িক মুডে চালাতে পারবেন কিনা? নাকি বন্ধুত্ম বড়ো করে দেখবেন সেটা আপনি নিজেই জেনে নিন।
এমন যেন না হয়, আপনি ব্যবসায়িক ভাবে অফিস চালাচ্ছেন কিন্তু আপনার বন্ধুর সেটা ভালো লাগছেনা। আবার এমনও হতে পারে আপনার বন্ধু ঠিকই আছে আপনি শুধু ভুল বুজছেন। অথবা বন্ধুটি পার্টনার মেজাজে আছে, কিন্তু আপনিই এখনো সিরিয়াস নয়।
সূতরাং বন্ধ যদি ব্যবসায়িক পার্টনার হওয়ার সময় বন্ধু না থাকে, তাহলে বন্ধুও আপনার ব্যবসায়িক পার্টনার হতে পারে।
তবে তার আগে কয়েকটি বিষয় বোঝাপড়া করে নেবেন। যেমন
১. কার কি দায়িত্ব হবে, কে কি পরিমাণ আউটপুট পাবে?
২. চুক্তিটা লিখিত হওয়া জরুরী। হোকনা সেটা সাদা কাগজে। কারণ আমি আপনি যে কেউ যেকোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ভুলে যেতে পারি।
৩. কার কতটুকু ক্ষমতা থাকবে। সেটাও মেনশান করা দরকার।
৪. ট্রেড লাইসেন্স ব্যাংক একান্ট এগুলো কার নামে হবে, কে তেমন সিগনেটরি হবে এটাও আগে ঠিক করা চাই।
৫. কার কতো বিনিয়োগ কত লভ্যাংশ, লাভ এবং লোকসানের ভাগিদার কে কতটুকু হবে। সেটা জানাুতেও ভুলবেন না।
ব্যবসায়িক পার্টনার
আপনার বন্ধুত্বের বাইরে কোনো লোকের সাথেও আপনি শেয়ারে ব্যবসা করতে পারেন। অথবা আপনারা ৬ জন বন্ধু আছেন তার সাথে পরিচিত কেউ একজনও থাকতে পারে। অথবা আপনার অন্যকোন বন্ধুর বন্ধু বা আত্মীয়ও হতে পারে। সেক্ষেত্রে জেনে নিন
১. লাভের পাশাপাশি লোকটির লোকসান বহনের মানষিকতা আছে কিনা। কারণ ব্যবসা যে সব সময় লাভ হবে তা কিন্তু নয়।
২. বড়ো ধরনের কোন মামলা বা গিল্টি বা বদনাম আছে কিনা খবর নিন।
৩. তিনি নেতিবাচক কোন রাজনীতি, স্মাগলিং বা বেআইনি কাজের বা ব্যবসার সাথে যুক্ত কিনা জানার চেষ্টা করেন।
৪. অন্যের মতামতকে গুরুত্ব দেয় কিনা? নাকি নিজে যা বোঝে সেটাই আসল মনে করে। এ ধরনের ফাজিল হলে এভয়ড করুন।
৫. তার অন্যকোন দূরভিসন্ধি আছে কিনা? সেটা বোঝাাটা খুব জরুরী। যেমন তার অন্য ব্যবসা আছে, ভালো চলছেনা, তিনি চাইছেন সে মালগুলো আপনাদের কাছে বেচে দিতে। অথবা তিনি একজন কন্টাকটর তিনি আপনাদের পন্যগুলো বাকী নিয়ে যাবেন, বলবেন সরকারী বিল পেলে দাম দিয়ে দেবেন, পরে মাসের মাস তার পিছে ঘুরতে হবে। কিছু বলাও যাবেনা তিনি বলবেন ব্যবসা আপনাদেরএকার নয়, আমারো।
৬. খুব বড়ো মাপের লোক নেবেন না। যেমন পাড়ার এক বড়োভাই অথবা আপনার কলেজের এক টিচার নিয়ে নিলেন। তিনি ব্যবসা ভালো বোঝেন না। আবার আপনারা কেউ তার উপর কথা বলেন না। ফলে বার বার ভুল পন্য কেনেন। আর সেটা সময়মত বিক্রি হয়না।
৭. সন্দেহপ্রবণ, সারাক্ষণ হায় হুতাশ করে, নিজেকে বহুতকিছু মনে করে, অযথা মানুষের বদনাম করে, একজনের কথা আরেকজনের কাছে গিয়ে বলে, গ্রুপ পলিটিক্স অভ্যস্ত এ ধরনের লোক থেকে দূরে থাকবেন।
ব্যবসায় ও বন্ধুত্ব
একটা কথা না বললেই নয়। ব্যবসার ক্ষেত্রে বন্ধুত্ব টা কিন্তু কাজের জিনিস। অনেক মানুষের সাখথ পরিচয় থাকাটা বেশ কাজে লাঘে। বিশেষকরে গ্রাহকভোক্তা সার্পোট ব্যবসায় বা কম্পিটিটর ব্যবসায়ীদের সাথে বন্ধুত্ত্বও অনেক সময় কাজে লাগে। এজন্য ব্যবসায়িক পাটনার বাছাই করতে গিয়ে বন্ধুত্ব বা সম্পর্ক নস্ট করবেন না। বন্ধুর সংখ্যা কমাবেন না।
ভুল পার্টনার নির্বাচনে বন্ধুত্বের প্রভাবের কারণে কতো ব্যবসা যে লাটে উঠেছে সে উদাহরন দেয়ার জন্যও সেগুলো আর অবশিষ্ঠ নেই। আর বন্ধুত্বের কারণে অনেক ব্যবসা শীর্ষে উঠে গেছে। যা হয়তো একা একা করলে এতটা হতোনা। যেমন ধরুন ফেইসবুক এটাতো বন্ধুদের ব্যবসায়ের ফসল। বাংলাদেশের টিকে গ্রুপ তৈয়ব এবং কালাম নামে দুই বন্ধুর যৌথ ও সফল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। মার্ক জাগারবার্গ সেদিনও বলেছিলেন যে একা একা কিছু করা যায়না।
বর্তমানে পেক্ষাপটে প্রতিদিন বিশেষকরে অনলাইন ব্যবসায় নতুন নতুন তরুনরা যুক্ত হচ্ছে। এবং তাদের বেশীরভাগই ২/৪ জন বন্ধু মিলে ব্যবসা শুরু করছে। তাদের কথায় মাথায় রেখে এই লেখাটা পোষ্ট করা হলো। তারা যদি এর থেকে উপকৃত হন আমার পরামর্শ স্বার্থক হবে।
জাহাঙ্গীর আলম শোভন
8,789 total views, 2 views today