
বাজেটে ই-কমার্স খাতে সুখবর নেই, হতাশ অনলাইন উদ্যোক্তারা
এবারের বাজেটে অনেকগুলো ইতিবাচক দিক থাকলেও অনলাইন ব্যবসায়ীদের জন্য কোনো সুখবর নেই । এমনটাই ভাবছেন খাত সংশ্লিষ্ঠরা। গতকাল প্রস্তাবিত বাজেট বিশ্লেষন করেও তারা কোনো সুখবর খুঁজে পাননি। শুধুমাত্র ই-বুক ও ডিজিটাল এডুকেশনকে ভ্যাটমুক্ত করা ছাড়া ই-কমার্স ব্যবসায়ের অনুকূলে কোনো কিছুই খুজে পাওয়া যায়নি। ই-কমার্স প্লাটফর্মকে উৎসে করের আওতায় আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। একটি উঠতি ব্যবসায়িক খাতকে এখনো সরকারী দেয়ার আগে এবং শক্তিশালী অবস্থা তৈরী হওয়ার আগে এ ধরনের সিদ্ধান্ত ইতিবাচক মনে করছেন না অনলাইন উদ্যোক্তারা।
গত ২০১৮ সালে প্রণীত ডিজিটাল কমার্স নীতিমালার ২০ শতাংশও এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। ই-কমার্স ব্যবসা হিসেবে এখনো স্বীকৃতি দেয়নি সরকার। কারণ ট্রেড লাইসেন্স তালিকায় ই-কমার্স বলতে কিছু নেই। তথাপি বর্তমান সময়ে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এই খাতের ব্যবসায়ীদের অবদান অনস্বীকার্য| করোনাকালীন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে এই সেক্টরে প্রায় লক্ষ লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। পেয়াজের দাম নিয়ন্ত্রন, রমযানে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, লকডাউনে সারাদেশে সাপ্লাইচেইন সচল রাখাসহ বিভিন্ন কাজে সরকারের সাথে সহযোগি হিসেবে কাজ করেছে ই-ক্যাব। ডিজিটাল কুরবানি হাট ও মানুষের বাসায় নিত্যপণ্য পৌঁছে দিয়ে করোনা সংক্রমণ কমাতে এখাতের কর্মীরা রাতদিন পরিশ্রম করেছে। করোনাকালীন সময়ে একমাত্র ই-কমার্স খাতে বিদেশি বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় 300 মিলিয়ন ডলারের অধিক। তা সত্বেও বাজেটে এই খাতকে অবহেলা করা হয়েছে বলে মনে করছেন ডিজিটাল কমার্সের সাথে সংশ্লিষ্ঠরা।
ই-ক্যাবের প্রেসিডেন্ট শমী কায়সার বলেন, ই-বুক ও ই লার্নিং থেকে ভ্যাট প্রত্যাহার করার জন্য সরকারকে সাধুবাদ জানাই। কিন্তু ই-ক্যাব থেকে আমরা যেসব দাবী দাওয়া উপস্থাপন করেছি তার প্রতিফলন ঘটেনি এবারের বাজেটে। করোনাকালীন সময়ে দেশের অর্থনীতি সচল রাখার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছে আমাদের উদ্যোক্তা ও কর্মীরা। ই-কমার্স প্লাটফর্মকে উৎসে করের আওতায় নিয়ে আসার প্রস্তাব সময়োপযোগী নয় বলে মনে করছি আমরা। কারণ এই খাত এখনো বিকশিত হচ্ছে। এতে মাথা তুলে দাড়ানোর সুযোগটা দিতে হবে। আমরা মনে করি এ ধরনের প্রস্তাব। বাংলাদেশ ও ক্যাশলেস সোসাইটি গঠনের পথে জটিলতা সৃষ্টি করবে। আমরা আশা করা বিষয়টি সরকার পূর্নবিবেচনা করবে।
ই-ক্যাবের সহ-সভাপতি সাহাব উদ্দীন শিপন বলেন, এবারের বাজেট ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য ভাল কিছু উপহার দেবে। কিন্তু ই-কমার্স উদ্যোক্তাদের জন্য এতে কোনো সুখবর নেই। আমরা সরকারের কাছে ই-কমার্স কোম্পানীর অফিস ও গুদামবাড়ার উপর ভ্যাট মওকুপ চেয়েছি। নূনতম করসীমার ব্যাপারে আমাদের প্রস্তাবের প্রতিফলন ঘটেনি। তাছাড়া এখনো কোনো ই-কমার্স খাতে কোম্পানী লাভের মুখ দেখেনি। ই-কমার্স প্লাটফর্মকে উৎসে করকর্তন এর আওতায় আনলে এই সেক্টরের প্রবৃদ্ধি বাঁধাগ্রস্থ হবে। তাই বিষয়টা পূর্ণবিবেচনার আহবান জানাবো আমরা।
ই-ক্যাবের সেক্রেটারী জেনারেল মোহাম্মদ আব্দুল ওয়াহেদ তমাল বলেন, এই খাত এখনো ক্রমবর্ধমান। নানাবিধ প্রতিকূলতা সত্বেও কেবল বিকশিত হতে শুরু করছে। এখনি কোনো নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা এই খাতের জন্য হিতে বিপরীত হতে পারে। বিশেষ করে ট্রেড লাইসেন্স স্বীকৃতি ও ডিজিটাল কমার্স নির্দেশনা বাস্তবায়ন ব্যতিত কোনো সিদ্ধান্ত ছাপিয়ে দেয়া সুখকর হবেনা। এই খাতকে আরো স্বয়ংসম্পূর্ণ করার জন্য আমরা সরকারের সহযোগিতা চাই। যাতে করে আমরা আরো বেশী কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে পারি এবং দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারি।
তিনি আরো বলেন, এখন ই-কমার্স প্লাটফর্মকে উৎসে করের আওতায় নিয়ে আসলে এবং ই-ক্যাবের দাবীসমূহ বাস্তবায়ন না করলে এই খাতে উদ্যোক্তারা অনিয়মিত হয়ে পড়তে পারে। তারা নিয়মতান্ত্রিভাবে ট্রেড লাইসেন্স ও ওয়েবসাইট খুলে ব্যবসা করার পরিবর্তে ট্রেড লাইসেন্স ব্যতিত ফেসবুক ভিত্তিক বা দোকান ভিত্তিক ব্যবসার প্রতি ঝুঁকে পড়বে। যা শুধু ই-কমার্স বিকাশের অন্তরায় নয় বরং ডিজিটাল অর্থনীতির বিকাশকে বাঁধাগ্রস্থ করবে। আমরা ইতিমধ্যে বিষয়টা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি। জাতীয় রাজষ্ব বোর্ডের সাথে আমরা এই আগে দুইদফা বসেছি। আবারো বিষয়টা আমরা এনবিআরকে তুলে ধরব।
ই-ক্যাবের ফিন্যান্স সেক্রেটারী মোহাম্মদ আব্দুল হক অনু বলেন, যেখানে এই খাতকে এখনো স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। সেখানে ভ্যাট আদায় কিংবা তাদেরকে উৎসে করকর্তনকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করার প্রস্তাব অযৌক্তিক। কারণ আইন যেখানে স্বীকার করে না দেশে ই-কমার্স বলে কোনো ব্যবসা আছে সেখানে আপনি তার উপর আইন প্রয়োগ করবেন কিভাবে?
তিনি বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে দাবী করে আসছি সরকারের ট্রেড লাইসেন্স ক্যাটাগরিতে ই-কমার্স যুক্ত করা হোক। সেটাই এখনো হয়নি। আমাদের উদ্যোক্তাদের ট্রেড লাইসেন্স এর গায়ে যেখানে ই-কমার্স লেখা নেই। সেখানে আপনি কি করে তাকে ই-কমার্স বিবেচনা করে তারউপর কর প্রয়োগ করতে যাবেন? ই-কমার্স প্লাটফর্মকে উৎসে করকর্তনকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করার যে প্রস্তাব করা হয়েছে তা বাস্তবসম্মত নয় এবং এই অবস্থায় এটা প্রয়োগ করাও সম্ভব হবেনা। কারণ এই খাত এখনো এতটা ম্যাচিউরড হয়নি।
ই-ক্যাবের ডিরেক্টর আসিফ আহনাফ বলেন, করোনায় দেশের ডিজিটাল অর্থনীতি সচল রেখে লাখো মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা খাতকে সরকারের উচিত বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে প্রসারের সুযোগ করে দেয়া। সেখানে ই-ক্যাবের দাবীদাওয়া আমলে না নেয়া হয়নি। অন্যদিকে ফেসবুকসহ ডিজিটাল মার্কেটিংএ ২য় দফায় ভ্যাট আদায়ের পথ তৈরী করার মাধ্যমে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ব্যয় বৃদ্ধি করা হয়েছে এবং সরকার তাদের জন্য বিশেষ কোনো সুবিধা নিশ্চিত করেনি যাতে তারা বিকশিত হতে পারে। এতে ই-কমার্স ব্যাবসা করার সুযোগকে সীমিত করার প্রয়াস লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
ই-ক্যাবের ডিরেক্টর সাইদ রহমান বলেন, করোনাকালীন সময়ে এই সেক্টরের উদ্যোক্তা ও কর্মীরা একদিকে নিজেদের জীবনের ঝুকি নিয়ে নিত্যপণ্য সেবা সচল রেখেছে অন্যদিকে ডিজিটাল অর্থনীতিকে করেছে গতিশীল। বিশ্বের ৩টি দেশ করোনাকালীন ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এটা সম্ভব হয়েছে ই-কমার্স সেক্টর সচল থাকার কারণে। এবারের বাজেটে এই খাত সবচেয়ে বেশী অবজ্ঞার স্বীকার হয়েছে। এতে তরুন যেসব উদ্যোক্তারা নিজ দায়িত্বে নিজেরা কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছিল তারা পিছিয়ে পড়বে। তারা পিছিয়ে পড়লে পুরো দেশ পিছিয়ে পড়বে।
এই বিষয়ে ই-ক্যাব ৪ জুন সদস্যদের সাথে এক মতবিনিময় সভা আয়োজন করে তাতে সদস্য এবং খাত সংশ্লিষ্ঠ ব্যক্তিরা এবারের বাজেট নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করেন।
জাহাঙ্গীর আলম শোভন
3,419 total views, 7 views today