সারাবিশ্ব জুড়ে সাপ্লাই চেইন বা সরবরাহ শেকল ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বিশ্বের একস্থান থেকে অন্যস্থানে নানা ধরনের পন্য সাপ্লাই হয়ে আসছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে ও অঞ্চলে এমন শত শত সাপ্লাই চেইন খুব সফলতার সাথে টিকে আছে। আবার কখনো নতুন চেইন তৈরী হয় পুরনো চেইন অকেজো হয়ে যায়। বর্তমানের বহু সাপ্লাই চেইন থেকে কার্যকর ভাবে টিকে থাকা কয়েকটি সাপ্লাই চেইন নিয়ে এ অধ্যায়ে আলোচনা করতে চাই।
১. পারিবারিক সাপ্লাই চেইন: এটি পৃথিবীর সবচে আদিম, সবচে সফল এবং অন্যতম বেশী পন্যের জন্য ব্যবহার করা হয়। একটি পরিবারের বহু ধরনের ব্যবহার্য পন্য পরিবার তার নিজস্ব , তথ্য, ব্যবস্থা ও সক্ষমতার উপর ভিত্তি করে তার সাপ্লাই চেইনটি গড়ে ওঠে। কোন একটি পরিবারের যদি নিজস্ব পারিবারিক ব্যবসা থাকে তাহলে সে পরিবারটি একই সাথে জটিল দুইটি চেইন অনুসরণ করে। যেমন পরিবারের নিত্য প্রয়োজনী চাল ডাল আল তেল এসব সংগ্রহ করার জন্য সাধারণ এলাকা ভিত্তিক চেইন। তেমনি আবার তাদের ব্যবসার কাাঁচামাল যোগাতে সংশ্লিস্ট সব পক্ষ নিয়ে আরেকটা চেইন তাদের জন্য থেকে থাকে।
২. হাট, বাজার, বন্দর বা মেলা ভিত্তিক সাপ্লাই চেইন: এতে কোন একটা নির্দিষ্ট ভেন্যুতে ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ের সমাগম ঘটে তার যার যার প্রয়োজনীয় পন্য পরিশোধ করে, মূল্য বিনিময় করে, এবং পরে প্রয়োজনে পন্য পরিবহন করে থাকে। এটাও একটা প্রচলিত এবং শক্তিশালী পক্রিয়া। বাজার ব্যবস্থার বাইরে আজকের অর্থনৈতিক কার্যকলাপ চিন্তা করা যায়না।
৩. দাদন, মহাজন ও মুনাফাখোরদের চেইন: সামন্তবাদী সমাজব্যবস্থা এই চেইনের জন্ম দিয়েছে আবার অনেকের মতো বুর্জোয়া আর্থসামাজিক পরিস্থিতি একে হাজার বছর ধরে টিকিয়ে রেখেছে। এতে মহাজনরা অতি স্বল্পমূল্য কৃষক ও জেলেদের কাছ থেকে অগ্রিম মূল্য দিয়ে পন্য কিনে নেয়। পরে কৃষক বা শ্রমিক তাদের শ্রম অথবা উৎপাদিত পন্য দ্বারা মূল্য পরিশোধ করে। এতে মহাজনরা অর্থের বিনিময়ে উৎপাদিত পন্যকে হাত করে নিয়ে কৃষক কমদামে দিয় সেটাই তারা বেশীদামে বিক্রি করে থাকে। এতে সমাজে অর্থ বিনিময়, সরবরাহ শেকল, বাজার ব্যবস্থা উৎপাদন এসব চলমান পক্রিয়ায় থাকে। আমাদের দেশে সমুদ্র মাছ আহরনের জন্য এখনো এই পক্রিয়া চলমান আছে। এতে দালাল ও ফড়িয়ারা জেলেদেরকে অগ্রীম ঋণ দেয় পরে জেলেদের কাছ থেকে তারা ইচ্চেমত দামে মাছ কিনে নিতে পারে। আবার সেই মাছ আড়তে নিলাম তুলে তারা শহরের পাইকারদের হাতে তুলে দেয় তারা আবার শহরের আড়তে এনে নতুনভাবে ডাক তুলে মাছ ব্যবসায়াদের কাছে তা বিক্রি করে থাকে।
৪. ওয়ানস্টপ কেন্দ্রীক সাপ্লাই চেইন: আজকের সুপার স্টোর বা ওয়ান স্টপ সার্ভিস পয়েন্টগুলো এ ধরনের এক ভেন্যুকেন্দ্রীক সরবরাহ ব্যবস্থা চালু করেছে। একই ছাদের নিচে সব ধররে পন্যের সমাহার বা চাহিদা মেটানোর প্রচেষ্টা। প্রকৃত অর্থে এটা ওয়ান স্টপ চেইন নয় কারণ এখানে ১ হাজার পন্য ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে তৈরী করা হয়। এবং ভিন্ন ভোক্তার কাছে চলে যায়্ মাঝখানে কেবল একটা পর্যায়ে এটা এক জায়গায় অল্প সময়ের জন্য থিতু হয়। আধুনিক বিশ্বে এটি ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বিশ্বের বড়ো বড়ো সুপার শপগুলো এটি সঠিক ভাবে পরিচালনা করার জন্য বিভিন্ন কৌশল ও তৃতীয় পক্ষের সাহায্য নিয়ে থাকে।
৫. প্রতিনিধি ভিত্তিক সাপলাই চেইন: কোম্পানীগুলো এজেন্ট বা ডিস্ট্রিবিউটর নিয়োগ দিয়ে থাকে। যাদের মাধ্যমে তারা পন্য সংগ্রহ, পরিবহন ওসরবরাহ করে থাকে। এটাই আসলে প্রতিনিধিভিত্তিক সাপ্লাই চেইন।
৬. ই কমার্স ভিত্তিক সাপ্লাই চেইন: ই কমার্সের ক্ষেত্রে ক্রেতা ঘরে বসে পন্য পেতে চান বলে এক্ষেত্রে তৃতীয় পক্ষের সহযোগিতা নিতে হয়্ এতে পন্য সংগ্রহ এবং সরবরাহ দুটোই ক্ষেত্রেই প্রথাগত চেইনের চেয়ে আলাদা হয় বলে একে ই কমার্স বেসড চেইন বলা যেতে পারে। সাধারণত একটি দেশের প্রচলিত পন্য সরবরাহের জন্য যেসব শিপিং সুবিধা বহাল থাকে সেসব সুবিধার উপর ভিত্তি করে এ ধরনের ব্যবস্থা গড়ে ওঠে।
৭. নিজস্ব সাপ্লাই চেইন: আজকাল বড়ো বড়ো কোম্পানীগুলোতে নিজেদের কর্মী এবং পরিবহন সার্ভিসের মধ্য দিয়ে নিজেরা পন্য সংগ্রহ, পরিবহন, ডেলিভারী দিয়ে থাকে।
৮. তৃতীয় পাক্ষিক সাপ্লাই চেইন: এ ধরনের চেইন ব্যবস্থায় তৃতীয় একটি পক্ষ থাকে যারা মূলত পন্য সংগ্রহ করে সাপ্লাই এর ব্যবস্থার সাথে জড়িত। এবং এটাই তাদের মূল ব্যবসা।
বিশেষ সাপ্লাই চেইন: নিজেদের প্রয়োজনে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে মানুষ নিজেদের মতো করে সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। মুম্বাই শহরের ক্যাটারিং সার্ভিসে যে সাপ্লাই চেইন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেটা বিশ্বের অন্যতম সেরা সাপ্লাই চেইনের স্বীকৃতি পেয়েছে। এতে প্রায় ৫০ ধরনের খাবার সম্বলিত ২ লাখ টিপিন বক্স কয়েক হাজার কর্মী উৎপাদক থেকে ভোক্তার কাছে পৌছে দেয় মাত্র কয়েকঘন্টার মধ্যে।এর নাম: ডাব্বাওয়ালা। শত শত অশিক্ষিত লোক প্রতিদিন শহরের অফিস গুলোতে দুপুরের খাবার সরবরাহ করে থাকে। নানা জায়গা থেকে খাবার গুলো তৈরী করা হয় এবং নানা স্থানে সেগুলো পৌছে দেয়া হয়। তবুও প্রতিনিয়ত নানা রুচি ও ধর্মের লোকেরা এবং ভারতের নানা বর্ণ, ধর্ম ও এলাকার লোকদের ভিন্ন ভিন্ন খাবারের রেসিপি সত্বেও প্রতিদিন তারা সঠিক প্রাপকের কাছে সঠিক বাক্সটি পৌছে দিতে সক্ষম হয়। অশিক্ষিত ও অল্পশিক্ষিত লোকদের দ্বারা পরিচালিত এই সফল সরবরাহ শেকল অনেকেই বিষ্ময় এবং ধাঁধাঁয় ফেলে দিয়েছে। কিন্তু তারা সফল হয়েছে। এটাই বাস্তবতা।
বর্তমানে বাংলাদেশে যারা ই কমার্স নিয়ে কাজ করছেন। পন্য সরবরাও ডেলিভারি নিয়ে বর্তমানে তারা কঠিন অনিশ্চয়তার মুখে প্রতিটি মুহুর্ত পার করছেন। বাংলাদেশে বর্তমানের শিপমেন্ট গুলো সম্পর্কে ধারণা থাকলে খুব আরামদায়ক না হলেও কাজ চালিয়ে যাওয়া যায়। তবে ই কমার্স এর সমস্যা সমাধানের জন্য ডাক বিভাগের ভিপি সিস্টেম, কুরিয়ার সার্ভিসের ক্যাশ অন ডেলিভারি, আর পার্সেল সার্ভিসের কন্ডিশন ডেলিভারী আরো সহজ ও ব্যাপক করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। পাশাপাশি পন্যের মূল্য পরিশোধ পক্রিয়া আধূনিক ও যুগ উপযোগী করার কথা ভাবা যায়।
7,375 total views, 5 views today