ই-কমার্স ও বাংলাদেশ

ই-কমার্স ও বাংলাদেশ পর্ব ৪

জাহাঙ্গীর আলম শোভন

ডিজিটাল কমার্স নীতিমালা

ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ ও ডিজিটাল সেবাকে নিরাপদ ও আস্থাপূর্ণ করে জনগনের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে সরকার ডিজিটাল কমার্স নীতিমাল প্রণয়ন করে। এই নীতিমালা একদিকে ক্রেতাকে সুরক্ষা দিয়েছে, ভোক্তা অধিকার নিশ্চিত করেছে অন্যদিকে সুষম প্রতিযোগিতার মাধ্যমে দেশে অনলাইন ব্যবসার বিকাশের পথ সুগম করেছে একই ভাবে ব্যবসায়িক উদ্যোগ বা এন্টাপ্রেউনিয়ারশিপ উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা রাখছে। এখন ছাত্র থেকে গৃহবধু, বেকার থেকে চাকরীজীবি অনেকেই ডিজিটাল কমার্সের দিকে ঝুঁকছে কেউ কেউ রীতিমত সফলতার উদাহরণ তৈরী করেছে।

ডিজিটাল কমার্স নীতিমালায় যে বিষয়গুলো স্থান পেয়েছে

* ডিজিটাল কমার্স প্রতিষ্ঠানসমূহকে অবশ্যই ভোক্তা অধিকার সংক্রান্ত বিদ্যমান বিধান মেনে চলা,  ই-কমার্স সাইটে বিক্রির জন্য উপস্থাপিত পণ্য সামগ্রীর যথাযথ বিবরণ ও পণ্যটি মানসম্মত হওয়া,  ডিজিটাল কমার্স প্রতিষ্ঠান বিধি অনুযায়ী বিক্রিত পণ্যের ফেরত, মূল্যফেরত, পণ্য বদলের শর্তাবলী ওয়েবসাইটে প্রদর্শন করা এসব বিধানের মাধ্যমে ডিজিটাল কমার্সে আস্থা তৈরী করেছে।

* সকল ব্যাংকে আন্তঃব্যাংক ও মোবাইল ফিনান্সিয়্যাল সার্ভিস (এমএফএস), ডিজিটাল ফিনান্সিয়্যাল সার্ভিস (ডিএফএস) লেনদেন উপযোগী ডিজিটাল প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের উদ্যোগ, ডিজিটাল কমার্স সংশ্লিষ্ট পেইমেন্টের নিরাপত্তার স্বার্থে  ‘ESCROW Service’’ চালু করা,  ব্যাংক ও মোবাইল ব্যাংকিং, প্রি-পেইড কার্ড, ক্রেডিট কার্ডসহ সমস্ত পেইমেন্ট পদ্ধতি ন্যাশনাল পেমেন্ট সুইচ-এর সাথে সংযুক্ত থাকার মাধ্যমে রিয়াল টাইম ফান্ড ট্রান্সফার,  বৈধ পথে আন্ত:দেশীয় অনলাইন কার্ডভিত্তিক লেনদেন সম্প্রসারণের নিমিত্ত ট্রাভেলার্স কোটা ও অনলাইন লেনদেনের কোটা বর্ধিতকরণ ও যুগোপযোগীকরণের ব্যবস্থা গ্রহণের নীতিগত পথ তৈরী করেছে।

* পাইরেসি, হ্যাকিংসহ ডিজিটাল কমার্স খাত সংশ্লিষ্ট সকল সাইবার অপরাধ, ইন্টারনেট ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিং ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিদ্যমান ও উদ্ভূত ঝুঁকি চিহ্নিতকরণ, ব্যবস্থাপনা ও তদারকি নিশ্চিতকরণেসংশিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রণালয় বা বিভাগের কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেল ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

* ই-পেমেন্ট পদ্ধতিতে আর্থিক লেনদেন এর অপপ্রয়োগ, জালিয়াত চিহ্নিতকরণের ক্ষেত্রে আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ক্লিয়ারিং হাউজ এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেলের সাথে সমন্বয়ের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

সার্বিকভাবে ডিজিটাল কমার্স নীতিমালার কর্মপরিকল্পনায় স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী ৬০টি করণীয় ঠিক করা হয়েছে। এগুলোকে ১৪টি বিষয়ভিত্তিক উদ্দেশ্যে ভাগ করে প্রাথমিক বাস্তবায়নকারী সংস্থা ও প্রত্যাশিত ফলাফলের উল্লেখ করা হয়েছে ।

প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বিনির্মাণের মাধ্যমে দেশব্যাপী তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির অবকাঠামো তৈরি, মানবসম্পদ উন্নয়ন, ই-গভর্নেন্স প্রতিষ্ঠা এবং আইটি শিল্প বিকাশে সরকার বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। মোবাইল প্রযুক্তি এক্ষেত্রে অন্যতম সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।

বর্তমানে সারাদেশ ৩-জি নেটওয়ার্কের আওতাভুক্ত এবং ৪-জি নেটওয়ার্ক ইতোমধ্যে চালু হয়েছে। উল্লেখ্য, সারাদেশে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার স্থাপনের মাধ্যমে আইসিটি নেটওয়ার্ক কানেক্টিভিটি এর আওতায় প্রান্তিক বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে ই-সেবা এবং মোবাইল ব্যাংকিং এর আওতাভুক্ত করেছে।

 

করোনাকালীন সময়ে ই-কমার্সকে গতিশীল রাখতে সরকারী সহযোগিতা

১. শুরু থেকে সরকার এই বিষয়ে সচেতন ছিল। একদিকে আইসিটি ডিভিশন থেকে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের ডেলিভারী পার্সনদের জন্য এসওপি তৈরী করা হয়েছে। অন্যদিকে জনসাধারণের চলাচল সীমিত করে যে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে তার প্রথম থেকেই খাদ্য, ঔষধ ও জরুরী পন্য সরবরাহ এবং পরিবহন অনুমোদন দেয়া হয়েছে।

২. পরবর্তীতে, বিশেষ করে রমযান মাসে অনেকে ইফতার এবং সেহরীর জন্য রেস্টুরেন্ট এর তৈরী খাবার খেতে পছন্দ করেন। তাদের জন্য ফুড ডেলিভারী সেবাকে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এতে ঘরে বসে ক্রেতারা পছন্দের খাবার পেয়েছে। রেস্টুরেন্টগুলো কিচেন খোলা রেখে তাদের বেচাকেনো চালু করার সুযোগ পেয়েছে।

৩. কিছু প্রতিষ্ঠান বিশেষ অনুমতি নিয়ে গ্রাম থেকে নতুন কর্মী এনে নিয়োগ দেয়ার সুযোগ পেয়েছে। ই-কমার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব) জানিয়েছে তাদের সদস্য প্রতিষ্ঠানের ২০ হাজার পণ্যবাহী গাড়ি সারাদেশে সেবা দিয়েছে। প্রতিদিন এই ২০ হাজার গাড়ি কি পরিমান পন্য সরবরাহ করে লাইফ লাইন সচল রেখেছে তার একটা ধারণা  এখান থেকে পাওয়া যায়। এসব গাড়িকে চলাচলের বিশেষ অনুমোদন দেয় সরকার।

৪. ঈদ ঊল ফিতরে সরকার যখন স্বাস্থ্য বিধি মেনে পোশাক, গেজেট ও ইলেকট্রনিক্স পণ্য বিক্রয়ের অনুমতি দেয়। তখন একদিকে যেমন ঘরে থেকে প্রতিদিন ঢাকায় অন্তত ৫০ হাজার মানুষ এসব সেবা নিয়েছে। একই কারণে পোশাক ভিত্তিক ই-কমার্স, গেজেট বিক্রেতা ও ইলেকট্রনিক্স পণ্য বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসায় ফিরে আসতে পেরেছে। দেশের অর্থনীতিতে এর প্রভাব দৃশ্যমান।

৫. করোনার কারণে একদিকে আমচাষীরা যেন চিন্তায় পড়েছিল অন্যদিকে ক্রেতারা আশংকায় ছিল যে তারা ক্যামিকেলমুক্ত আম খেতে পারবে কিনা? ই-ক্যাব ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় অনলাইনে আমমেলার উদ্যোগ নিয়ে একদিকে বাগান মালিকের পাশে দাঁড়িয়েছে অন্যদিকে অনলাইন প্রতিষ্ঠানগুলো বিকল্প পণ্য বিক্রির সুযোগ পেয়েছে। এভাবে সরকার এবং সরকারী বিভিন্ন এজেন্সির তড়িৎ সিদ্ধান্ত ডিজিটাল অর্থনিীতি সচল রাখতে সহযোগিতা করেছে।

৬. শহরের দুটো এলাকায় পরীক্ষামূলক ও পূর্নাঙ্গ লকডাউন ঘোষিত হলে ই-কমার্স এসোসিয়েশন এর সরাসরি তত্বাবধানে ১০০ হাজার পরিবারকে প্রতিদিন নিত্যপণ্য সেবা দেয়া হয়। যা ছিল ১০০% অভিযোগ বিহীন। পন্যের মান যেমন ঠিক ছিল, দামও ছিল নিয়ন্ত্রিত তেমনি সেবাও দেয়া হয়েছে সময়মত।  এসব এলাকায় পরবর্তীতে অনলাইনে অর্ডারের পরিমাণ ৩ গুণ বেড়ে গিয়েছিল।

৭. সাধারণত আমাদের দেশে ঈদউল আযহার সময়ে পশুর হাটে ব্যাপক ভীড় হয়। এখানে সামাজিক দূরত্ব বজায় খুব কঠিন। এই সময়ে সারাদেশে বিভিন্ন প্লাটফর্মে পশু বিক্রি শুরু হয়। ই-ক্যাবের প্রতিবেদন অনুযায়ী অনলাইন থেকে ২৭ হাজার কুরবানি পশু বিক্রি হয়েছে। যা একদিকে রেকর্ড অন্যদিকে মাইলফলক। গরু জবাই করে মাংস প্রক্রিয়াকরণ সম্পন্ন বাসায় ডেলিভারী সেবা ক্রেতাদের ব্যাপক প্রশংসা পেয়েছে। এ ব্যাপারে সরকার জনগণকে বিশেষ উৎসাহ দিয়েছে। সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের জনশক্তি এ ব্যাপারে ব্যাপক কাজ করেছে যাতে সাধারণ মানুষ অনলাইনে পশু ক্রয়ে উৎসাহিত হয়।

৮. গতবছর পেয়াজ আমদানীর ব্যাপারে হঠাৎ নেতিবাচক খবর আসায় পেয়াজের দাম বেড়ে যায়। চলতি বছরও একই ঘটনা ঘটে। কোনো পূর্ব ইঙ্গিত ছাড়াই কাছের উৎস থেকে পেয়াজ আমদানী বন্ধের কথা শোনা যায়। এতে পেয়াজের দাম বাড়তে শুরু করে। সাথে সাথে সরকার দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে বাজারের ৯০ টাকার পেয়াজ অনলাইনে ৩৬ টাকায় বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয়।  এতে রাতারাতি পেয়াজের বাজারে দাম কমে যায়। শুধু পাইকারী বাজারে ২৪ ঘন্টায় পেয়াজের দাম কমে ২০ টাকা। এবং এখনো তা কমছে। গত বছরের মতো বা তার কাছাকাছিও যায়নি।

৯. পেন্ডামিকের আগে যেখানে ই-কমার্স এসোসিয়েশন এর সদস্য সংখ্যা ১০০০ সেখানে ৮ মাসে তা এসে দাড়ায় ১৪০০ তে। প্রায় ৪০% বাড়ে এর সদস্য সংখ্যা। ই-কমার্স উদ্যোগ বেড়েছে হয়তো তারও বেশী। এখাতে প্রায় ৬০ লক্ষ প্রত্যক্ষ উপকারভোগী তৈরি হয়েছে। যা সম্ভব হয়েছে এই সময়ে সরকারী কিছু ইতিবাচক সিদ্ধান্ত ও দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার ফলে। এই অগ্রগতি ছিল  সরকারের গৃহিত একটার পর একটা পদক্ষেপ এর ফল।

 

এই মুহুর্তে ডিজিটাল কমার্সের চ্যালেঞ্জসমূহ

১. ডিজিটাল কমার্সের উপকারভোগী বানাতে হবে গ্রামের প্রান্তিক মানুষদের। গ্রামীণ পর্যায়ে ই-কমার্স পৌঁছে গেলেও তার পরিসর বাড়েনি। এই লাস্টমাইল ডেলিভারী সেবা নিশ্চিত করতে হলে ই-কমার্স সাপ্লাই চেইন ও গ্রামীণ পণ্য এই দুটো সম্পৃক্ত করতে গ্রামীণ পর্যায়ে সেবার বিস্তৃতি ঘটাতে হবে। বাংলাদেশ ডাক বিভাগ ইতোমধ্যে কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।

২. ই-কমার্সের স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধি যেখানে ২৫% ছিল বছরে, সেখানে ক্রসবর্যডার ই-কমার্স বা রফতানীমুখী ই-কমার্সের ক্ষেত্রে তা ৭৪%। এখানে কিছু করনীয় রয়েছে। আশা করি দ্রুত এগুলো বাস্তবায়িত হলে, বাংলাদেশীর গৃহবধুর সে ফুলতোলা রুমাল কিংবা নকশীকাঁথা বিদেশী ক্রেতার হাতে আরো সহজে পৌঁছে যাবে।

৩. ক্রমবর্ধমান হারে গড়ে উঠা ক্ষুদ্র ডিজিটাল কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রবৃদ্ধির জন্য পরিবেশ নিশ্চিত করা এবং প্রতিনিয়ত যুক্ত হওয়া নতুন ভোক্তাকে সঠিক সেবা দিয়ে ডিজিটাল কর্মার্স ইন্ডাস্ট্রির একজনে রুপান্তরিত করা।

৪. একটি অভিন্ন সাপ্লাইচেইনের আওতায় দেশের সকল ই-কমার্স প্লাটফরম ও উদ্যোগকে যুক্ত করার মাধ্যমে সেবার মান উন্নয়ন এবং মার্জিনাল পিপলদের কাছে সেবা পৌঁছে দেয়ার মাধ্যমে সারাদেশকে ডিজিটাল কমার্স নেটওয়ার্কের আওতায় নিয়ে আসার।

 

1,631 total views, 3 views today

Comments

comments