বাংলাদেশে আমার জানামতে ই-কমার্স সাইটের সংখ্যা দেড় হাজারের ও বেশী। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এগুলার বেশীরভাগের উদ্যোক্তারাই এক দুই মাস খুব লাফঝাপ করে চুপ হয়ে যান এমনকি পরবর্তীতে দেখা যায় ডোমেইন হোষ্টিংয়ের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে আর রিনিউ ও করানো হয় না। এটা খুবই কমন সমস্যা এবং এর ফলে বেশীরভাগের স্বপ্নই মরে যায়। যাহোক, আমার এক্সপিরিয়েন্স থেকে এই সমস্যাগুলোকে দুইটা ফেইজে ভাগ করেছি। আজকে পোষ্টে সেগুলা নিয়েই আলোচনা করব।

 

ষ্টার্ট আপ ফেইজ

 #ওয়েব ডেভেলপার থেকে ই-কমার্সঃ যদি একটা রাফ সার্ভে করা হয় তাহলে দেখা যাবে বেশীরভাগ ই-কমার্স সাইটের মালিকরাই ফ্রিল্যান্স মার্কেটপ্লেসে ওয়েব ডেভেলপ করতে করতে একসময় শখের বশে অনলাইন শপ খুলে বসে। যার কারণে বিজনেস নলেজের একটা গ্যাপ থেকেই যায়। এই গ্যাপটা পরবর্তীতে বাড়তে বাড়তে প্রেসারের লেভেল পার করে যায়।

# ওয়ান ম্যান এন্ট্রাপ্রেনিউয়ারশীপঃ এটা শুধু ই-কমার্স সাইটের ক্ষেত্রে না বরং বাংলাদেশের টেক এন্ট্রাপ্রেনিউয়ারদের বেশীরভাগেরই সেইম ঝামেলা। যার কারণে ডেডলাইন মিস হওয়া, আফটার সেলস সাপোর্টে খারাপ পারফরমেন্স থেকে ষ্টার্ট করে একটা টাইমে আর বিজনেস ডেভেলপ হয় না।

# স্বল্প বিনিয়োগঃ বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় উদ্যোক্তারা শুধু ওয়েব সাইট বানানোর আর কিছু প্রোডাক্ট কেনার জন্য যে টাকা দরকার সেটা নিয়েই মাঠে নামে। যার কারণে সাইট+প্রোডাক্ট কমপ্লিট হওয়ার পরে ও মার্কেটিং কিংবা অন্যান্য লজিষ্টিকের অভাবে বিজনেস এক্সপানশন হয় না।

#সমাধানঃ এই সবগুলা প্রবলেমের একটাই সমাধান। সেটা হচ্ছে টিম ওয়ার্ক। একটা সাক্সেসফুল অনলাইন শপ দাড়া করানোর ক্ষেত্রে টিম ওয়ার্কের কোনো বিকল্প নাই। এক্ষেত্রে কেউ ভাল ডেভেলপার, কেউ ভাল বিজনেস বুঝে, কেউ র’ ম্যাটেরিয়াল আর প্রোডাক্ট বুঝে, কারো মার্কেটিং সেন্স ভাল এইরকম ভাবে যার যার রেস্পন্সিবিলিটি বুঝে নিলে লোড কমে যায়, সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্টের কোয়ালিটি বাড়ে, তাছাড়া মানুষ বাড়লে কম লোডে বিনিয়োগ বাড়ে আর সর্বোপরি বেশী মানুষ মানেই বড় নেটওয়ার্ক। তবে এটাও ঠিক বেশী মানুষ হলে পার্টনারশীপ বিজনেসে ঝামেলা হওয়ার ও চান্স থাকে। এক্ষেত্রে আগে থেকেই নিজেদের রেস্পন্সিবিলিটি গুলা লিখিত ডীড আকারে করে ফেললে এই ঝামেলা গুলো থেকে ও দূরে থাকা যায়।

মেইনটেন্যান্স ফেইজ

# ওয়েবসাইট খুললেই লাখ লাখ ভিজিটর চলে আসবে এমন ভুল ধারণাঃ বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত বেশীরভাগ মানুষই মনে করে সাইট খুললেই মনে হয় ভিজিট করতে দলে দলে মানুষ চলে আসবে। যার কারণে অনেক উৎসাহ নিয়ে সাইট ওপেন করলে ও কিছুদিন পরে আশার আলো না পেয়ে পুরাই হতাশ হয়ে যায় যেটা অনেককে বিজনেস ট্র্যাকের বাইরে ও নিয়ে যায়। এটা মনে হয় সবচেয়ে কমন সমস্যাগুলোর একটা।

# প্রথমেই এষ্টাবলিশড সাইটগুলার সাথে কম্প্যারিজনে চলে যাওয়াঃ অনেক সাইটের মালিকরাই প্রথমেই বড় বড় সাইটের সাথে কম্প্যারিজনে চলে যায়। যার কারণে নিজের সাইটকে খালি খালি মনে হয় অথবা ডেভেলপারকে ও প্রেসার ক্রিয়েট করে। কিন্তু এই এষ্টাবলিশড সাইটগুলা ও একসময় জিরো থেকেই ষ্টার্ট হইছিল এবং বছরের পর বছর তাদের ডাটা আপডেট হয়েছে, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রবলেমের উপর বেইজ করে সাইটের ইন্টারফেস কিংবা ফিচার চেইঞ্জ হয়েছে। সুতরাং আজকে যে নতুন তার সাইট ও একদিন ফিলআপ হবে। কিন্তু সময় দিতে হবে, লেগে থাকতে হবে এবং ধৈর্য্য হারা হলে চলবে না।

#কনজিউমার সেন্টিমেন্টের চেয়ে নিজের সেন্টিমেন্ট নিয়ে ব্যস্ত থাকাঃ বাংলাদেশের ক্ষেত্রে একটা কমন প্রবলেম হচ্ছে যারা ই-কমার্স সাইট করতে চায় তারা ডিজাইন নিয়ে খুব বেশী সিরিয়াস হয়ে যায় অথচ কন্টেন্টের কোনো ঠিক নেই। লোগো ডানে থাকবে নাকি বামে থাকবে, প্রোডাক্ট লিষ্ট উপরে থাকবে নাকি নিচে থাকবে এসব নিয়ে অযথা টাইম নষ্ট করে। কিন্তু এগুলা রিলেটিভ প্রবলেম। কারণ আমার কাছে লোগো ডানে ভাল লাগলে ও আরেকজনের কাছে বামে ভাল লাগবে এটাই নরমাল। সুতরাং এইসব নিয়ে টাইম নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। বরং কনজিউমার যাতে ইজিলি প্রোডাক্ট খুজে পায়, ইজিলি অর্ডার দিতে পারে এসব সাইড বেশী মাথায় রাখা লাগবে।

# ফোকাস পয়েন্ট থেকে সরে আসাঃ ই-কমার্স সাইট মানেই অনলাইন শপ । যার কারণে ফোকাস পয়েন্টটা থাকাই উচিত ওয়েব থেকে কেনাবেচা বাড়ানো। এক্ষেত্রে একটু টাইম লাগলে ও ধৈর্য্য ধরা উচিত। কিন্তু ম্যাক্সিমাম ক্ষেত্রেই দেখা যায় অনলাইন শপের মালিকরা অনলাইনে বিক্রির চেয়ে কিছুদিন পরে ডোর টু ডোর মার্কেটিং করে নিজেকে মুদী দোকানদারের লেভেলে নিয়ে আসে। যার ফলে একসময় সাইটটা নামে মাত্র থাকে।

# সমাধানঃ একজন সাক্সেসফুল ই-কমার্স ব্যবসায়ী হতে হলে আপনাকে অবশ্যই অন্তত ৩-৬ মাসের অ্যাকশন প্ল্যান নিয়ে মাঠে নামতে হবে। এই টাইমে অনলাইনে অফলাইনে ক্যাম্পেইন, সাইটে সব ডাটা দেওয়া থেকে শুরু করে সব ডেভেলপমেন্টের কাজ কমপ্লিট করে ফেলতে হবে। ইন দ্য মীন টাইম অনেক ধরনের হতাশা আসতে পারে, সাইট খালি খালি লাগতে পারে কিংবা যেকোনো বাধা আসতে পারে। কিন্তু অ্যাকশন প্ল্যান শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত ট্র্যাকে থাকতে হবে। সেই সাথে যত ভাল অর্ডার ই হোক অনলাইন ছাড়া নেওয়া যাবে না। ফোনে অর্ডার পেলে নিজে থেকে হলে ও ঐ অর্ডারটা অনলাইনে সাবমিট করে রিসিপ্ট ক্ল্যায়েন্টকে দিতে হবে। সেই সাথে অনলাইনে অফলাইনে ক্যামপেইন তো চলবেই। সর্বোপরি ক্লায়েন্টের সাথে কুইক রেস্পন্সিভ হতে হবে এবং নিজের ফোকাস পয়েন্ট থেকে কোনোভাবেই সরে আসা যাবে না।

মোটামুটি আজকের মত এ আলোচনাতেই থাকলাম। পরের পোষ্টে আরো কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করব।

তবে সবচেয়ে আশার কথা যেটা তা হচ্ছে কিছুদিন আগ পর্যন্ত ও মানুষ অনলাইন শপকে ঐভাবে বিশ্বাস না করলে ও আস্তে আস্তে মানুষের মধ্যে অনলাইন শপের প্রতি একটা ফ্যাসিনেশন ক্রিয়েট হচ্ছে এবং অল্প কিছুদিনের মধ্যেই এটা ডিপেন্ডেন্সিতে কনভার্ট হবে। তাই যারা ই-কমার্সকে নিজের পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন তারা তারা হতাশ না হয়ে নিজেকে ডেভেলপ করতে থাকুন। যত কষ্টই হোক লেগে থাকুন যাতে পরে এটা বলে আফসোস করা না লাগে যেঃ “ইশশ……………. আমার ও একটা সাইট ছিল, ঐটা যদি কন্টিনিউ করতাম তাহলে আজ আমার ও হতে পারত”।

যারা অনলাইনে ম্যাগাজিন পড়লে ভালবাসেন তারা এন্ট্রাপ্রেনিউয়ার ডট কম দেখতে পারেন।

—————————–

লেখক পরিচিতি

আমি ইফতেখার ইদ্রিস আসিফ, একজন টেক এন্ট্রেপ্রেনিউয়ার। আমি সরাসরি  ই-কমার্স বিজনেসের সাথে জড়িত না থাকলে ও এখন পর্যন্ত অনেকগুলো ই-কমার্স সাইটের সাথে সরাসরি  কাজ করেছি। যার কারণে ই-কমার্স উদ্যোক্তাদের অনেকেরই মিশন, ভিশন, এক্সপিরিয়েন্সগুলো অনেক কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। সেখান থেকেই কিছু মেইন জিনিষ হাইলাইট করে এই লেখা।

এই লেখার ব্যাপারে আপনার যেকোনো মতামত থাকলে কমেন্ট করতে পারেন অথবা ফেইসবুকে ইনবক্স করতে পারেন।

6,235 total views, 3 views today

Comments

comments

Your email address will not be published.