ডিজিটাল কমার্স নির্দেশিকা ২০২১: গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের পর্যালোচনা

ডিজিটাল কমার্স নির্দেশিকা ২০২১: গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের পর্যালোচনা

গত ৪ জুলাই ডিজিটাল কমার্স নির্দেশিকা ২০২১ ঘোষনা করেছে সরকার। এখানে বিভিন্ন ধরনের বিষয় আলোচনায় এসেছে। এটি একটি নীতিমালা আইন নয়। এটিতে সবকিছু অন্তভূক্ত করা হয়নি। যেসব বিষয়ে প্রচলিত আইন রয়েছে সেগুলো যেমন আসেনি। তেমনি এখনো সমস্যা বড়ো আকারে দেখা দেয়নি এমন অনেক বিষয় আসেনি। যেগুলো ভবিষ্যতে প্রয়োজন হতে পারে। আবার সেবাদাতা-গ্রহীতা নিজেরা আলোচনা করে ঠিক করে নিতে পারে এমন অনেক বিষয় উন্মুক্ত ও সহজ রাখা হয়েছে।

আমার এই বিশ্লেষন একান্ত ব্যক্তিগত। যেহেতু ২০১৪ সাল থেকে আমি ই-কমার্স নিয়ে লিখি। এবং এই ব্লগে 55% লেখা আমার সেজন্য আমি এই বিশ্লেষণ তুলে ধরলাম।

যেসব বিষয় আসেনি তারমধ্যে হলো মার্চেন্ট এবং ডেলিভারী এজেন্ট এর সম্পর্ক। যেহেতু বাংলাদেশ বাংক সিওডি বিষয়ে একটি গাইড লাইন আরো ৩ মাস আগে প্রকাশ করেছে। এবং ডেলিভারী প্রতিটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের সাথে মার্চেন্ট যে চুক্তি হয়। সে চুক্তি অনুসারে হবে।  এতে সুবিধা হলো কারণ বিষয়টি নিয়মের মধ্যে বেঁধে দেয়া হয়নি। অনলাইন উদ্যোক্তা ও ডেলিভারী উদ্যোক্তা দুজন নিজেদের সুবিধামতো চুক্তি করে নিবেন। কেউ চুক্তি ভঙ্গ করলে অন্যপক্ষ আইনের আশ্রয় নিবেন।  এছাড়া ৩ ধরনের বিষয় আছে। যেমন ‘‘৬বছর ক্রেতার তথ্য সংরক্ষন’’ এটা অন্য একটা আইনে আছে তাই এটা হয়তো সে আইন পরিবর্তন না হলে এটা এভাবে থাকবে। এরকম অনেকগুলো বিষয় আছে সে আইন থেকে হবহু তুলে ধরা হয়েছে। কোনো নীতিমালা সরকারকে এমনভাবে তৈরী করতে হয় যাতে সেটা কোনো আইনের সাথে সাংঘর্ষিক না হয়। আবার ধরেন ‘‘১০% অগ্রিম’’ এটা হয়তো পরিস্থিতির উপর ভবিষ্যতে পরিবর্তন হতে পারে। যেখানে আমাদের প্রস্তাব ছিল ৫০%। পরে আমরা বলেছি ৩০% এর কম হলে অনেক উদ্যোক্তা অনলাইন ব্যবসা করতে পারবেনা। বিশেষ করে যারা বাইরে থেকে মাল আনে। আবার কিছু বিষয় ঠিকই আছে কিন্তু ভাষাগত জটিলতার কারণে মানুষ বুঝতে পারছেনা। যেমন ধরেন ‘‘কমপ্লায়ন্স অফিসার নিয়োগ’’। এর মানে এই নয়যে, প্রতিটি অফিসে বাড়তি একটা লোক নিয়োগ দিতে হবে। এর মানে হলো অন্তত একজনকে কম্লায়ন্স এর দায়িত্ব নিতে হবে। তার যোগাযোগ তথ্য সরকারের কাছে থাকবে। মানে ছোট প্রতিষ্ঠানে মালিক নিজেই এর দায়িত্ব পালক করতে পারবেন।

আসুন আমার ব্যক্তিগত বিশ্লেষনটা শেয়ার করি। এখানে নীতিমালা থেকে কোনো কিছু হবহু তুলে ধরা হয়নি। সংক্ষিপ্ত কিছু অংশ তুলে ধরা হয়েছে মাত্র।

১.  রিফান্ড ও রিটার্ন পলিসি বাংলায় ও ইংরেজীতে স্পষ্ট উল্লেখ থাকতে হবে (৩.১.২) শর্তের বিষয়ে ক্রেতার সম্মতি চেকবক্স দ্বারা নিশ্চিত করতে হবে (৩.১.৭) (৩.১.১৭)

২। ই-কমার্সের নামে এমএলএম করা যাবেনা (৩.১.৩)।  নেশা ও বিষ্ফোরক দ্রব্য বিক্রয় করা যাবে না (৩.১.৪)।  ডিজিটাল মাধ্যমে ঔষধ বিক্রয় করতে অনলাইন ড্রাগ লাইসেন্স লাগবে (৩.১.৫) প্রযোজ্যক্ষেত্রে বিএসটিআই সনদ লাগবে। (৩.২.৫)

৫। অনুমতি ছাড়া র‌্যাফল ও লটারী করা যাবেনা (বিস্তারতি প্যানাল কোড ১৮৬০/২৯৪ বি) (৩.১.৮) ((এখানে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল যেহেতু শপিং সেন্টার লটারী, কূপন ও রাফল ড্র আয়োজন করে থাকে তাহলে কেন অনলাইন শপ আয়োজন করতে পারবেনা? এর উত্তর হলো অনুমতি ব্যতিত লটারী আয়োজন যেহেতু নিষিদ্ধ তাই আইন সবার জন্য সমান। যারা করে সেটা বেআইনিভাবে করে))

৬। অর্থের বিকল্প মাধ্যম তৈরীতে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি লাগবে। যেমন কূপন, ক্যাশ ভাউচার, ওয়ালেট (৩.১.৯) ((( এই মাধ্যমগুলোকে কেনাকাটার ক্ষেত্রে অর্থের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না)

৭। ডিজিটাল উদ্যোক্তার অন্তত যেকোনো একটা নিবন্ধন লাগবে  TL /TIN/BIN/UBID/PRA (৩.১.১২) ((যারা ট্রেড লাইসেন্স নিতে চান না। কঠিন মনে করেন। তারাও PRA/UBID এর মাধ্যমে বিজনেস এর স্বীকৃতি পাবে।

৮। ব্যবসার লেনদেন তথ্য ৬ বছর রাখতে হবে-৩.১.১৪ (এটা অন্য একটি আইনে আছে) ((কোনো নীতিমালা তৈরী করতে হলে সেটা প্রচলিত আইনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে করতে হয়। তাইিএটা গুরুত্বপূর্ণ। যদিও ই-ক্যাব থেকে প্রস্তাব ছিল। এই বছরের তথ্য পরবর্তী বছর পর্যন্ত রাখা যেতে পারে))

৯। বিক্রিত পন্যের দাম হাতে পাওয়ার ১০ দিনের মধ্যে সরবরাহকারীর পেমেন্ট দিতে হবে (৩.১.১৫) ((এখানে একটা গ্যাপ আছে। পণ্য যদি ১০ দিনের মাথায় গ্রামীণ এলাকায় ডেলিভারী হয়। সেখান থেকে ক্রেতা অভিযোগ করে। এবং ব্যাংক বা পেমেন্ট গেটওয়ে টাকা আটকে দেয় তখন কি হবে? এক্ষেত্রে আসলে প্রবলেম কেসগুলোকে আলাদা বিবেচনা করতে হবে। যদিও এক্ষেত্রে প্রস্তাব ছিল এই সীমা ২১ দিন কমপক্ষে ১৪ দিন রাখা উচিৎ। মানে প্রস্তাবে ২১ দিন ছিল পরে যখন বিভিন্ন এজেন্সি এই বিষয়ে যুক্তি তর্ক তুলছিল। এবং সাপ্লায়ার এর ব্যবসার প্রসঙ্গ এসেছিল তখন এটা কমপক্ষে ১৪ দিন হওয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল))

১০। পন্যের বিস্তারিত বিবরণ থাকতে হবে। প্রযোজ্যক্ষেত্রে রাসায়নিক গঠন উল্লেখ করতে হবে। মানুষের জন্য কোনো ক্ষতিকর  উপাদান থাকলে, নারী, শিশু ও গর্ভবর্তী মায়েদের জন্য ক্ষতিকর হলে উল্লেখ করে দিতে হবে। (৩.২.১-৩.২.৪)

১১। পন্যের স্টক সংখ্যা বা পর্যাপ্ত মজুদ লিখতে হবে অথবা স্টক আউট লেখা থাকতে হবে। মোটকথা স্টক সম্পর্কিত তথ্য থাকবে।(৩.২.৯) আর পুরো দাম পাওয়ার ৪৮ ঘন্টার মধ্যে পণ্য ডেলিভারী এজেন্টকে বুঝিয়ে দিতে হবে। (৩.২.১০) যে পণ্যটি হাতে নেই। বা তৈরী করে দিতে হবে সেক্ষেত্রে ১০% এর বেশী অগ্রিম নেয়া যাবেনা) (৩.২.১০) ((তাহলে এখানে স্টক তথ্যের জায়গায় ‘‘অর্ডার টু মেক’’ লিখতে হতে পারে। যদিও ই-ক্যাব থেকে প্রস্তাব করা হলেও নতুন শব্দ বিবেচনা করে যুক্ত করা হয়নি।)) তবে স্ক্রো চালু হলে ১০০% অগ্রিম নেয়া যাবে (৩.২.১০)

১২। বিক্রেতার সকল তথ্য মার্কেটপ্লেস সংরক্ষণ করবে । প্রয়োজন হলে সংশ্লিষ্ঠ কতৃপক্ষের নিকট হস্তান্তর করতে বাধ্য থাকবে (৩.২.১২)

১৩। ক্রেতা ও বিক্রেতা একই শহরে ৫ দিন ভিন্ন শহরে হলে সর্বোচ্চ ১০ দিনের মধ্যে পণ্য ডেলিভারী করতে হবে। (৩.৩.২)। ((এখানে মূল্য সম্পূর্ণ মূল্য পরিশোধের পর ৫ দিন বা ১০ দিন সময় গোনাটা সঠিক হবে। যদিও নির্দেশিকায় রয়েছে ক্রয়াদেশ গ্রহণের সময় গোনা হবে। যা মেনে চলা কঠিন হয়ে যাবে। বিশেষ করে যারা ১০% অগ্রিম নেবে ১০ দিন দিন আগে তখনি তাদের ক্রয়াদেশ হয়ে যাবে।  এখন যদি ৯ম বা ৯ দিনের মাথায় বাকী ৯০% দেয়া হয় (বিশেষ করে যে পন্যটি তার কাছে নেই সে পণ্যটির ক্ষেত্রে তখন ১ দিনে সেটা পৌঁছানো সম্ভব নয়)) এখানেযেহেতু েই-ক্যাব থেকে প্রস্তাব ছিল প্রথমে ২১/৩০ দিন, তারপর ১৪/২১ দিন সর্বশেষ ৭/১৪ দিন ছিল তাই গ্যাপটি আলোচনায় আসেনি) তবে এখানে নির্দেশিকায় সম্ভবত  এটাই বোঝানো হচ্ছে যে, বাকী ৯০% সিওডি বা ডেলিভারীর আগে পরে দেয়া যাবে) সেক্ষেত্রে বিক্রেতা পণ্য প্রসেসিং ১০% অগ্রিম পাওয়ার শুরু করবেন। তখন সময় গোনা হবে। সেক্ষেত্রে যারা দেশের বাইরে থেকে পণ্য আনবেন তারা আবার ১০ দিনের মধ্যে পণ্য দিতে পারবেন না। এখানেও ক্রস বর্ডার ই-কমার্সের জন্য ভিন্ন আরেকটি প্রস্তাব িছিল।

((এখানে ডেলিভারী কোম্পানীর গাফিলতি হলে কি হবে তা নেই। ব্যাপারটা খুব সহজ। ডেলিভারী কোম্পানীর সাথে ই-কমার্স কোম্পানীর নিজস্ব চুক্তি থাকবে। সে মোতাবেক তারা সিদ্ধান্ত নিবে। ))

১৪।  কোনো সমস্যা দেখা দিলে গ্রাহক যেন প্রতিষ্ঠানে অভিযোগ করতে পারে। সে ব্যবস্থা রাখতে হবে। প্রয়োজনীয় ফোন নাম্বারও ই-ইমেইল থাকবে। (ক্রেতারা প্রতিষ্ঠানে অভিযোগ করে প্রতিকার পেলে তৃতীয় কোনো পক্ষের কাছে অভিযোগের হার কমবে। এছাড়া একজন কম্লায়ন্স অফিসার নিয়োগ দিতে হবে। (৩.৪.১) (এর অর্থ এই নয়যে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে একজন বাড়তি লোক নিয়োগ দিতে হবে। মানে টিমের মধ্য থেকে একজনকে কমপ্লায়ন্সগুলো দেখার দায়িত্ব দিতে হবে। যিনি ওয়ান ম্যান আর্মি তিনি নিজের নাম কমম্লায়ন্স অফিসার হিসেবে যুক্ত করবে। এবং কতৃপক্সের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে তথ্য সরবরাহ করবে)

১৫। ক্রেতার অভিযোগ রেকর্ড রাখতে হবে। এবং ৭২ ঘন্টার মধ্যে সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে। (৩.৪.২)।

১৬। পণ্য দিতে ব্যর্থ হলে ৪৮ ঘন্টার মধ্যে বিষয়টি ক্রেতাকে জানাতে হবে। এবং ৭২ ঘন্টার মধ্যে অর্থ ফেরত দিতে হবে। এজন্য অন্যকোনো পণ্য ক্রয় করতে বাধ্য করা যাবেনা। (৩.৪.৪)। যে মাধ্যমে মূল্য গ্রহণ করবে সে মাধ্যমে ফেরত দিতে হবে। মূল্য গ্রহণের ১০ দিনের মধ্যে ফেরত দিতে হবে। কোনো চার্জ রাখা যাবে না। ক্রেতা যে পরিমাণ অর্থ দিবে সে পরিমাণ ফেরত দিবে বেশী বা কম দিতে পারবেনা। ক্রেতা যদি নিজে সময়মতো পণ্য নিতে না পারে সেক্ষেত্রে সময়সীমা শিথিল হবে।(৩.৫.১)  ((এখানে ক্রেতার ভুলে অর্ডার ক্যানসেল বা পণ্য ফেরত আসলে চার্জ কেটে রাখার প্রস্তাব ছিল সেটা আসেনি)) ((( এখানে আসলে অনেক ধরনের পরিস্থিতি তৈরী হতে পারে। বিস্তারিত আসেনি। এইটুকু মেনে চললে অনেক সমস্যা কমে যাবে))

১৭।  ডিসকাউন্ট ক্যাশব্যাক মূল্য পরিশোধের ৭২ ঘন্টার মধ্যে কার্যকর করতে হবে। মূল্য ছাড় বা ক্যাশব্যাক অফারের ঘোষিত অর্থ বিক্রেতার নিয়ন্ত্রনে থাকা ওয়ালেটে জমা রাখা যাবে না। ক্রেতাকে দিতে হবে।  (৩.৫.২-৩.৫.৩) ((( ক্রেতাকে নগদে ফেরত দিতে হলে। ক্রেতার কাছ থেকে অর্থ নেয়ারই প্রয়োজন নেই। যদি নিয়ে ক্রেতার ইচ্ছায় অন্য কোনো পণ্য তাকে ক্রয় করার সুযোগ দেয়া হয় ক্রেতা চাইলে সে সুযোগ নিতে পারে। না চাইলে ক্রেতাকে ফেরত দিতে হবে। এভাবে থাকলে ভাল হতো।))) ((( এখানে বিপরীত যুক্তিও আছে। বিক্রেতা ক্রেতাকে তার মূল্যের বিনিময় পণ্য যদি ১০০ ভাগ দিয়ে থাকে। এর বাইরে মূল্যছাড় বা ক্যাশব্যাক বিক্রেতার পক্ষ থেকে ক্রেতাকে উপহার। এই উপহার বিক্রেতা কিভাবে দিবে এটা বিক্রেতার উপর থাকা উচিৎ। এই ধারাটি সম্পূর্ণ নয় ।এটি ভবিষ্যতে সংশোধন করতে হবে।))) তবে কখনো পণ্য দিতে না পারলে সে অর্থ ফেরত দেয়ার পরিবর্তে ওয়ালেটে জমা করা সম্পূর্ণ অন্যায় বা নিষিদ্ধ হওয়া উচিৎ। যদিও সে অর্থ যেহেতু ক্রেতাকে ৭২ ঘন্টার মধ্যে ফেরত দিতে বলা হয়েছে। তাই বিষয়টি এখানে আলোচনায় আাসেনি।

আরেকটি বিষয় হলো-সব সময় প্রথমবারই সব কিছু ১০০% ভাগ এ্যাচিভ করা যায়না। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ৯০% ভাগ এ্যাচিভ করা বিরল ঘটনা। বিষয়টা যদি সরকারের সাথে হয়। ১৭টি এজেন্সি ও ২টি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মতামত নিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সেখানে ই-ক্যাবের মতামত বেশী প্রাধান্য পেয়েছে। অল্প কিছু জায়গায় ই-ক্যাবের প্রস্তাবনাটা আসেনি। ভবিষ্যতে সংশোধনের সময় আশা করি ই-ক্যাব এ বিষয়ে জোরালো ভূমিকা রাখবে।

জাহাঙ্গীর আলম শোভন

3,405 total views, 2 views today

Comments

comments