রাজকীয় কেনাবেচা
জাহাঙ্গীর আলম শোভন
কতকিছুইনা বাজারে বিক্রি হয়। পন্য আর সেবাইকি বিক্রি হয়। বিক্রি হয় মানুষের স্বপ্নও। বিক্রি হয় গালভরা বুলি থেকে ভিক্ষার ঝুলি। ভাবছেন এ আবার কেমন কথা। স্বপ্ন না হয় বিক্রি হয় মানুষ লক্ষ্য হাসিল করার জন্য নানা উপায় খুজে মরে তখন আরেক দল লোক তাদেরকে স্বপ্ন পাইয়ে দেয়ার আশা দিয়ে হাতিয়ে নেয় টাকা কড়ি সম্বল। আর গালভরা বুলি কত মিথ্যা প্রতিশ্রুতিতে আমরা ভুলে গিয়ে জীবনে কত মানুষ এর কাছ থেকে কত পন্য কিনে ঠকেছি। আর ধার দেনা দিয়ে ভোগান্তির শিকার হননি এমন মানুষতো পাওয়াই মুশকিল। আর ভিক্ষার ঝুলি সেও অনেক উদাহরণ দেয়া যাবে, মোড়ে মোড়ে দানবাক্স নাকি ভিক্ষাবৃুত্তির প্রাতিসি।টানিক রুপ। ঢাকা শহরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় ভিক্ষার পজিশন বিক্রির কথাতো অনেকে শুনেছেন। শুনেছেন ভিক্ষা করার জন্য বাচ্চা ভাড়া দেয়ার গল্প। আর জোর করে হাত পা কেটে ভিক্ষুক বানানোর অপরাধে কয়েকবছর আগে আদালত নাকি ¯্রফে বকা দিয়েছে এক রাজনৈতিক কর্মীকে। অপারেশন করে হিজড়া বানানো হয় চাদাবাজি করার জন্য। হায় সেলুকাস।
১. ঘটনাস্থল কলিকাতা
কলকতা শহরে নাকি একবার প্রতিকায় এড দেয়া হয়েছে। কোটিপতি হতে চান? ২০০ টাকা মানি অর্ডার করে পাঠান এই ঠিকানায়। মানি অর্ডার করে পাঠানোর পর উত্তর এসেছে আপনিও একই রাস্তা অনুসরণ করুন। এমএলএম আসার আরো অনেক আগে আমাদের দেশে ¯্রফে ফরম বেচার একটা ব্যবসা এসেছিল। কি আর বলবো মানুষ যে কত কিছু বেচতে পারে। কিন্তু একটা কথা মানতে হবে যারা এসব জিনিস বেচতে পারে তারা কিন্তু অসাধারণ কোয়ালিটি রাখে।
এখন ধরে নিই যে কেউ তাদের পরামর্শ মতো ওভাবে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে মানি অর্ডার ব্যবসায় শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু কেউতো রুখে দাড়াবেই। আর তাতে যা হবার তাই হবে।
কি শিখলাম: হুজুগে কোনো কিছু করা ঠিক নয় ।
২. বেচলেতো বেচ আইফেল টাওয়ার
বলছি ফ্রান্সের বিলাস নগরী প্যারিস হেলেন অব ট্রয়ের স্মৃতি জড়ানো শহর প্যারিস এর কথা। এই শহরের প্রধানতম টুরিস্ট আকর্ষণ কি সেটা নিশ্চই কাউকে বলে দিতে হবেনা। হ্যাঁ ঘটনা ‘আইফেল টাওয়ার’ নিয়ে। এর আগে আমি আপনাদের ‘‘ সুপার সেলম্যানের গল্পে’’ আইফেল টাওয়ার বিক্রির একটি ঘটনা লিখেছি।
কাউন্ট ভিক্টর, সেদেশের পাবলিক ওয়ার্কস মিনিস্ট্রীর একজন অফিসার। ভিক্টর এক নতুন আইডিয়া বের করলেন তারপর নগরীর ৫ জন ব্যবসায়ীকে ডেকে বললেন, ‘অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলছি যে আইফেল টাওয়ার ভেংগে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। কারণ ব্যয় ভার বহন করা সরকারের পক্ষে এখন আর সম্ভব হচ্ছে না। তাছাড়া একে এভাবে শহরের মাঝখানে এতো জায়গাজুড়ে দাঁড় করিয়ে রাখার কোনো মানে হয় না। ইতিমধ্যে ভিক্টর তার কাজের জন্যে একজন পার্টনারও নিয়ে নিলো।
এরমধ্যে পুরোপুরি ৭ হাজার টন খাটি লোহা আছে। ৫ টন খুচরো লোহা বিক্রির জন্য উপস্থিত ক্রেতার কাছ থেকে বিড আহ্বান করা হলো, আইফেল টাওয়ার এর মামলা বলে দর এসে পৌঁছুতে মোটেই দেরী হলো না। আর প্রত্যেক বিডের সাথে কন্ট্রাকটারদের জামানত এর মতো একটা সুনির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা জমা দিতে বলা হলো । ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করবেন আরকিছু জামানত দেবেন না, তা কি হয়? সূতরাং কিছু মানি মিলে গেল।
এই টাকা পাওয়ার ঘন্টা খানেকের মধ্যেই তারা উভয়ে সব টাকা ক্যাশ করে ভিয়েনায় পাড়ি দিলো। ভিয়েনার হোটেলে বসে উভয়েই পরের দিন খবর নিলো? নাহ, মনে হয় বাঁচা গেল কোথাও আইফেল টাওয়ার বিক্রীর খবর নেই। কি বুঝে মাস ছয়েক পর তারা আবার প্যারিসে ফিরে এলো। আবার তারা আইফেল টাওয়ার বিক্রীর অভিজাত ব্যবসায়টি শুরু করলো। কিন্তু এবার অন্য স্টাইল। কিন্তু এবার আর ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়নি। ভিক্টর গং ধরা না পড়লেও ব্যবসায় সুবিধে হয়নি।
কি শিখলাম: সততাই ব্যবসায়ের প্রধান মুলধন।
৩. সৌদি যুবরাজের হিথরো এয়ার পোর্ট কেনার প্রস্তাব
১৯৮৭ সালে সৌদী বাদশাহ ফাহদ এসেছেন লন্ডনে। এখনকার মতো তখন হিথরো বিমানবন্দর বিশাল আর ব্যস্ততম। সাথে কনিষ্ট পুত্র আবদুল আজিজ।যিনি তখনকার পৃথিবীর সবচাইতে ধনী কিশোর। মাত্র ১৪ বছর বয়সে তার ব্যক্তিগত কার্ডিলাক গাড়ী ৭টি, ৩টি প্রাইভেট জেট, ৬০ লাখ পাউন্ড তার সাপ্তাহিক খরচ, সুইস ব্যাংকে তার একাউন্টের জমা ১ বিলিয়ন ডলার প্রায় । এসব ভালো কি মন্দ সেটা অবশ্য ভিন্ন প্রশ্ন।
রাজার বিমান রাজ এয়ারপোর্টে নামবে তাই তো ছিলো স্বাভাবিক। হিথরো পাবলিক বিমান বন্দরে তা অবতরণ করলো। এখানে রাজকিশোরদের জন্যও জন্যে একই টার্মিনালে কোনো স্বতন্ত্র ব্যবস্থা নেই। সেদিন এয়ারপোর্টের গ্রাউন্ড স্টাফের লোকেরা ধর্মঘট করেছে। তাই গ্রাউন্ড সার্ভিস নেই।প্লেন ল্যান্ড করতে, কিংবা পরে সব ক্লিয়ার হতে বেশ সময় লেগে যাচ্ছে। কিন্তু এতে যুবরাজ বিরক্ত হয়ে পড়েছেন তিনি সরাসরিই জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই গোটা এয়ারপোর্টের দাম কতো?’ বুঝুন অবস্থা। যতই কম বা বেশী দাম হোক তার কাছে হিথরো বিমানবন্দর বিক্রি করার কোনো কারণ নেই। ফলে বিমান বন্দরের গল্প এখানেই শেষ হলো। কিন্তু যুবরাজের গল্প শেষ হলোনো।
লন্ডনে আসার পর রাণীর পক্ষ থেকে তাদের বাকিংহাম প্রাসাদে ভোজের জন্যে নেমতন্ন করা হয়েছে। খাবার টেবিলে বসে সৌদি যুবরাজ ব্রিটেনের রাণীর কাছে প্রস্তাব করলেন, রানী যেন পুরো রাজবাড়ী তার কাছে বিক্রী করেন?’ শুনে রানীতো আক্কেলগুড়–ম। হকচকিত রানী বিনয়ের সাথে বললেন, ‘না বাছা, এ প্রাসাদ বিক্রীর জন্যে নয়।’ পরে প্রিন্স এন্ড্রকে বললো, ‘আমাদের আগমনে প্রাসাদের গেইটে যারা প্যারেড করেছে তাদের পুরো বাহিনীটাকে আমি কিনতে চাই।’ বুঝেন অবস্থা ধনের কারণে অন্ধ হয়ে সব কিছু বিক্রিযোগ্য মনে করছে।
কি শিখলাম: সব কিছুই বিক্রয় হয়না।
প্রিন্স অব বাংলাদেশ
আমাদের বাংলাদেশের এক ধনকুবের মুসা বিন শমসের। ইনি একবার ব্রিটেনের একটি দ্বীপ কেনার প্রস্তাব দিয়ে বিশ্বময় হইচই ফেলে দিয়েছেন। এই ভদ্রলোকের পোষাকগুলো আসে ইটালির পৃথিবী বিখ্যাত ফ্যাশনহাউসগুলো থেকে। এই ভদ্রলোককে নাকি কেউ দেখেনি যে তিনি দুটো পার্টিতে একই পোষাক পরেছেন। তার কলমখানি সোনার আর এর অগ্রভাগে রয়েছে হীরাও। ৪০ টি দামী ঘড়ি রয়েছে তার, যেগুলো ঘড়ি কোম্পানীকে দিয়ে ১ পিস করে তৈরী করেছেন, এবং ডিজাইন স্বত্বসহ কিনে নিয়েছেন। তিনি ব্রিটেনের নির্বাচনে রাজনৈতিক দলকে চাাঁদা দেন, ব্যাংককে লোন দেন। না এগুলো আমার কথা নয় বিশ্ববিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন তাকে নিয়ে কাভার স্টোরি করেছে, আর ভারতের দ্যা হিন্দ পত্রিকা করেছে বিশেষ প্রতিবেদন তাতই লেখা এসব। প্রিন্স অব বাংলাদেশ খ্যাত এই ব্যক্তি নাকি ব্রিটেনের রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনে বড় অংকের চাাঁদা দেন।
যুক্তরাজ্য প্রবাসী এই ধনকুবের পৃথিবীর সেরা ধনীদের মধ্যে নেই। কিন্তু সৌখিত ধনীদের মধ্যে নাম্বার ওয়ান। তবে তিনি ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে দ্বীপটি কিনতে ব্যর্থ হয়েছেন।
কি শিখলাম: কি লাভ এমন ধনরতœ দিয়ে যদি তা মানবতার কল্যানে না লাগে?
৫. স্বপ্ন দেখতে কোনো বারণতো নেই
পৃথিবীতে অনেক ঘটনা বা নজীর রয়েছে যখন কেউ এসবের স্বপ্ন দেখেছে, অন্যরা হেসে উড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু স্বপ্নটা একদিন সফল হয়েছে। এর সবচে প্রকৃষ্ঠ উদাহরণ হলেন
ক. আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা যিনি ছোটবেলায় স্বপ্ন দেখতেন তিনি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হবেন।
খ. প্রিন্স উইলিয়ামের স্ত্রীর এক বাল্যবন্ধু এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, মেয়েটি কিশোরী বয়স থেকে প্রচন্ড আত্মবিশ্বাস রাখতো যে সে রাজবধূ হবে।
গ. একই কথা হিটলারের বেলায় শোনা যায়।
ঘ. এ প্রসঙ্গে বলতে পারি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, কিংবা সাবেক প্রেসিডেন্ট আবদুল কালামের নামও।
এই লেখায় আমি ভালো মন্দ মিলিয়ে ৪টি আনকোরা বেচাকেনার স্বপ্ন সম্বলিত গল্প তুলে ধরেছি। প্রতিটি গল্প হলো ব্যর্থ বেচাকেনা। কিন্তু যারা এই বেচাকেনার সাথে জড়িত তারা কিন্তু সে পর্যায়ের ছিলো যারা এ ধরনের কাজে সফল হন।
যেমন
প্রতিটি মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়। তাই স্বপ্ন দেখতে আমরা যেন কুণ্ঠীত না হয়। ভারতের অন্যতম সেরা ধনী আজীম প্রেমজি বলেছেন ‘‘ তোমার স্বপ্ন নিয়ে যদি কেউ হাসাহাসি না করে বুঝতে হবে তোমার স্বপ্নটা খুব বড়ো নয়’’। এজন্য ই কমার্স ব্যবসায়ীদের স্বপ্ন দেখতে হবে আগামীর বাংলাদেশ নিয়ে বড়োসড়ো রকমের, তবে পরিকল্পনা প্রণয়নের সময় বাস্তবতাকে প্রাধান্য দিতে হবে। শেষের দিকের চারটি ঘটনা কিন্তু আমাদের মনে করিয়ে দেয়। স্বপ্ন সফল করার কথা।
5,495 total views, 2 views today