মোবাইল কমার্স নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। এশিয়াতে মোবাইল প্রযুক্তির হাত ধরেই ই-কমার্সের উত্থান হয়েছে এবং পশ্চিমা দেশ গুলোতেও মোবাইল কমার্স জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এ বছরেই বিশ্বে ২ বিলিয়নতম মোবাইল ফোন এবং ৫ বিলিয়নতম পিসি বিক্রী হবে। যুক্তরাষ্ট্রের অধিবাসীদের প্রতি ১০ জনে ৯ জন ২৪ ঘন্টা তাদের মোবাইল ফোন সঙ্গে রাখেন। এ বছরে যুক্তরাষ্ট্রে মোবাইল কমার্স কেমন হতে পারে তা নিয়ে বিজনেস ইনসাইডার (বিআই) ইন্টেলিজেন্স এবং সফটওয়্যার ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান মুভওয়েব দুটি রিপোর্ট তৈরি করেছে। এ দুটি রিপোর্টে ২০১৬ সালের মোবাইল কমার্সে কি হবে তার সার সংক্ষেপ ই-ক্যাব ব্লগের পাঠকদের কাছে তুলে ধরলাম।
বিজনেস ইনসাইডার (বিআই) ইন্টেলিজেন্স রিপোর্টে বলা হয়েছে যে ২০২০ সাল নাগাদ যুক্তরাষ্ট্রের ই-কমার্স এর ৪৫% হবে মোবাইল কমার্স। এই ৪৫% কে ডলারের হিসেবে নিলে দাঁড়াবে ২৮৪ বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ ২০২০ সাল নাগাদ দেশটির মোবাইল কমার্স ২৮৪ বিলিয়ন ডলারে পৌছাবে। ২০১৬ সালে দেশটির ই-কমার্সের ২০.৬% হবে মোবাইল কমার্স। ডলারে এর পরিমাণ ৭৯ বিলিয়ন। এ থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায় যে যুক্তরাষ্ট্রে মোবাইল কমার্স কিভাবে বাড়বে এ বছরে।
গত বছরের ক্রিসমাস শপিং সিজনে মোবাইল কমার্সের উত্থান আরো পরিস্কার হয়ে উঠেছে। অ্যাডোবি মার্কেটিং ক্লাউডের ভাইস-প্রেসিডেন্ট ম্যাট অ্যাসে (Matt Asay) বলেন, “ স্মার্টফোনে কেনাকাটা যদিও মানসিক চাপ বাড়িয়ে থাকে এ বছরের হলিডে সিজন মোবাইলে কেনাকাটা করার জন্যে ছিল চমৎকার একটি সময়।”
বিজনেস ইন্টেলিজেন্স রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট জেমি টপলিন (Jaime Toplin) বলেন যে, এ বছরে বেশ কয়েকটি কারণে মোবাইল কমার্স আরো জনপ্রিয় হয় উঠবে। স্মার্টফোন মিলেনিয়ালদয়ের (যারা ১৯৮০ থেকে ২০০০ এর মধ্যে জন্ম নিয়েছে) প্রাইমারি ডিভাইস। অনলাইন কেনাকাটার ক্ষেত্রে তারা স্মার্টফোন ব্যবহার করবে। একই সাথে রিটেইলাররাও মোবাইল কমার্সের দিকে ঝুকবেন।
অনলাইন অফলাইন কেনাকাটার মধ্যে আর পার্থক্য রাখা হচ্ছে নাঃ
বর্তমানে দুই তৃতীয়াংশ আমেরিকান নুন্যতম দুইটি ডিভাইস এবং এক তৃতীয়াংশ আমেরিকান তিনটি ডিভাইস ব্যবহার করে থাকে। এর ফলে তাদের কেনাকাটা করার ধরণও বদলে গিয়েছে। রিটেইলাররা এটা ভালভাবে অনুধাবন করছেন। তাদের এখন মূল চিন্তা হলো ক্রেতা দোকানে, ঘরে, অফিসে যেখানেই থাকুন না কেন, তিনি সেখানেই যেন কেনাকাটা সেরে ফেলতে পারেন। ওয়ালমার্ট, বেস্ট বাই এর মতো বড় বড় প্রতিষ্ঠান যাদের দোকান আছে এবং যারা অনলাইনেও পণ্য বিক্রী করে থাকে তারা তাদের অফলাইন অবকাঠামো, ওয়েবসাইট এবং মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন সব মিলিয়ে এমনি একটি পরিবেশ তৈরি করার চেষ্টা করছেন যেখানে ফিজিক্যাল দোকান বা ভার্চুয়াল দোকানের মধ্যে কেনাকাটা করায় কোন পার্থক্যই থাকবে না। ক্রেতা যদি উক্ত বিক্রেতার দোকানে গিয়ে স্মার্টফোনে পণ্য রিভিউ বা কেনার জন্যে ব্যবহার করে তাও করতে পারবে।
অনেক রিটেইলার থার্ডপার্টি অ্যাপ্লিকেশন এর সাথে পার্টনারশিপ করছে। একজন ক্রেতা উক্ত অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করে পণ্য কিনে পরে তার নিকটবর্তী দোকান থেকে পিক-আপ করছে। ক্রেতারা অনলাইনে একটি পণ্য বা সেবার বুকিং দিতে পারে। পরে তারা দোকানে গিয়ে উক্ত পণ্যটি দেখল ঠিক আছে কিনা। অনেক বিক্রেতা সেইম-ডে-ডেলিভারি দিচ্ছেন।
রিটেইলাররা মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনে পুশ নোটিফিকেশন এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুলোতে বাই বাটন এর মাধ্যমে ক্রেতাদের পণ্য কিনতে উৎসাহিত করছেন। শুধু তাই নয় তারা তাদের ওয়েবসাইট এবং মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে ক্রেতাদের সম্পর্কে আরো তথ্য যোগাড় করার চেষ্টা করছে তাদের কাজকর্ম, গন্তব্য, খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদি। সোজা কথা ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো একটি ইনফরমেশন হাব গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। এর মাধ্যমে তারা আরো ভালভাবে ক্রেতাদের কাছে মার্কেটিং করতে পারবেন।
আইবিএম কমার্সের রবি শাহ বলেন, “আমরা এমন এক সময়ে বসবাস করছি যেখানে ক্রেতাদের আচার আচরণ বোঝার ক্ষেত্রে লোকেশন এবং অ্যানালিটিক্স খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। রিটেইলাররা ক্রেতা কোথায় যান বা থাকেন তা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে। ২০১৬ সালে রিটেইলাররা আরো উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করবেন।” ক্রেতা শপিং মল গিয়ে কোন পণ্য দেখে কেনার আগে মোবাইলে তার রিভিউ দেখলে উক্ত প্রতিষ্ঠানও দেখবে উক্ত ক্রেতা দোকানের কোন সেকশনে আছে এবং রিটেইলারও জানতে পারবে একজন ক্রেতা কিভাবে তার দোকানে ঘুরছে।
ক্রেতাদের মোবাইল ব্যবহারের মানসিকতার জন্যেই রিটেইলাররা মোবাইল কমার্সে ঝুঁকছেন
ধরা যাক, আপনি অফিসে যাচ্ছেন বাসে করে। হঠাৎ মনে হলো আজকে আপনার বিবাহ-বার্ষিকী এবং বিকালে আপনার স্ত্রীর জন্যে একটা উপহার কিনতে হবে। আপনার মনে হলো যে আপনার স্ত্রী যাত্রা স্টোরের ফেইসবুক পেইজে একটি শাড়ি দেখেছিলেন যা তার খুব মনে ধরেছে। আপনি ঠিক করলেন যাত্রা থেকে সেই শাড়িটি কিনবেন। আপনি আপনার স্মার্টফোন খুলে যাত্রা শপ এর ফেইসবুক পেইজে গিয়ে শাড়িটি দেখলেন যে স্টোরে আছে এবং কিনে ঐ স্মার্টফোনের মাধ্যমেই দাম মিটিয়ে ফেললেন এবং বাসায় ডেলিভারির অর্ডার দিলেন। এখন আপনি যদি দেখেন যে শাড়িটা আউট অব স্টক বা মোবাইলে পেমেন্ট গ্রহণ করার তাদের অপশন নেই। তাহলে কিন্তু আপনি আর ঐ শাড়ি নিয়ে চিন্তা করবেন না।
উন্নত বিশ্বে ক্রেতারা ঠিক এভাবে মোবাইল কমার্স ব্যবহার করে থাকেন। তারা কাজের মধ্যে দ্রুত মোবাইলে কেনাকাটা সেরে ফেলতে চান।৯১% ক্রেতা অন্য কাজ করার সময়ে তাদের স্মার্টফোন ব্যবহার করে থাকেন। তারা মোবাইল ডিভাইসে যে সময়ে যে জিনিস কিনতে চান তখনি যদি সেই জিনিসটা সহজে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে কিনে ফেলা যায় তবেই তারা মোবাইলে সেটি কিনবেন নতুবা না। ক্রেতাদের এ ধরণের মানসিকতা বুঝে যুক্তরাষ্ট্রের রিটেইলাররা মোবাইল কমার্সে ঝুঁকছেন। তারা বুঝতে পেরেছেন যে ক্রেতারা মোবাইল ডিভাইসে দ্রুত কেনাকাটা সেরে ফেলতে চায়। তাই এখানে ক্রেতাদের দ্রুত এনগেইজ করতে হবে। একবার তাদেরকে আরামে কেনাকাটা করার স্বাদ পাইয়ে দিলে তারা বার বার আসবেন।
কিন্তু এখানে চ্যালেঞ্জটা হচ্ছে ক্রেতাকে দ্রুত এবং আরামে কাজ করতে পারেন তা নিশ্চিত করা। রিটেইলারকে অবশ্যই একটি সুন্দর ডিজাইন করা এবং রেসপন্সিভ ওয়েবসাইট তৈরি করতে হবে যা মোবাইল ডিভাইসে দ্রুত লোড হয়। অ্যাডোবি ইঙ্ক তাদের The State of Content Rules of Engagement For 2016 শীর্ষক এক রিপোর্টে বলেছে যে ডিজিটাল ভোক্তাদের ৫৯% সুন্দর করে ডিজাইন করা কন্টেন্ট পড়বে।৬৫% ভোক্তার কাছে কিভাবে কন্টেন্ট দেখান হচ্ছে তা খুবই জরুরি। ৫৪% ভোক্তার কাছে সুন্দর লে-আউট ডিজাইন, ভাল ফটো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কন্টেন্ট আপলোড হতে সময় বেশি নিলে বা কন্টেন্ট সুন্দর ভাবে সাজানো না থাকলে প্রতি ১০ জন ভিজিটরদের ৯ জন ডিভাইস বদলে ফেলে। খুব বড় কন্টেন্ট হলে ৬৭% ভিজিটর কন্টেন্ট আর দেখেই না।
সোশ্যাল কমার্সঃ
২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সেরা ৫০০ রিটেইলার সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে ৩.৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য বিক্রী করেন। ফেইসবুক, টুইটার, পিন্টারেস্ট, ইনসটাগ্রাম এর মতো জনপ্রিয় সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলো গত বছরে তাদের সাইটে বাই বাটনের মাধ্যমে পণ্য কেনাকাটার অপশন যোগ করেন এবং প্রচুর লোক সোশ্যাল নেটওয়ার্ক সাইটের মাধ্যমে পণ্য কিনেছেন। ২০১৬ সালে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে পণ্য কেনাকাটা আরো বৃদ্ধি পাবে। সোশ্যাল মিডিয়া ভিত্তিক রিটেইল এবং রেফারাল আরো বাড়বে। তাই রিটেইলাররা মোবাইল ডিভাইসে সোশ্যাল নেটঅয়ার্কিং সাইটে কিভাবে বিক্রী আরো বাড়ান যায় তা দেখবেন।
মোবাইল ওয়েব সাইট গুরুত্বপূর্ণ অ্যাপ্লিকেশন নয়ঃ
বর্তমানে স্মার্টফোন ব্যবহারকারীরা যতক্ষণ তাদের স্মার্টফোনে সময় কাটান তার ৮৫% খরচ করেন মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনে। কিন্তু সব অ্যাপ্লিকেশন নয়। শুধুমাত্র তাদের পছন্দের ২/৩টি অ্যাপ্লিকেশন তারা সময় কাটান। যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম সারির ৩০টি রিটেইল প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র দুটি প্রতিষ্ঠান- অ্যামাজন এবং ওয়ালমার্ট- অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছে।রিটেইলারদের মোবাইল সেলস এর ২০%-৩০% এসেছে অ্যাপ্লিকেশন থেকে। দ্যা স্টেট অব অনলাইন রিটেইলিং ২০১৫ রিপোর্টে বলা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ৫৬% রিটেইলার মনে করে যে মোবাইল অ্যাপ তাদের মোবাইল সেলস স্ট্রাটেজির জন্যে এতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। এ রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে যে, মোবাইলের মাধ্যমে বিক্রীর ২০%-৩০% আসে মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে।তাই ২০১৬ সালে মোবাইল কমার্সের ক্ষেত্রে মোবাইল ওয়েব খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
গত বছরে অনেক রিটেইলার মোবাইল ডিভাইসে ক্রেতাকে আকৃষ্ট করার জন্যে প্রথমবারের মতো তাদের নিজস্ব অ্যাপ্লিকেশন ছেড়েছেন। এ বছরে তারা এসব অ্যাপ্লিকেশন বন্ধ করে দেবেন না তবে এসব অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে রিটেইলাররা তাদের নিয়মিত ক্রেতাদের ডিসকাউন্ট সহ বিভিন্ন ধরণের সুবিধা প্রদান করবে।
সূত্র:
6,621 total views, 3 views today