মহান একুশ: ভাষার মাসে ভাষা সংস্কৃতি ও শিক্ষা বিকাশ বিষয়ক ৫টি রচনা
জাহাঙ্গীর আলম শোভন
১. তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলাভাষার ব্যবহার: তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা প্রতিশব্দের ব্যবহার
২. আমাদের ভাষা আমাদের গৌরব
৩. উন্মুক্ত আকাশে (অনলাইনে) তুলে করুন আপনার ভাষা ও সংস্কৃতিকে
৪. মুক্ত্ধারায় শিক্ষাকার্যত্রম
৫. আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় নীতি ও পদ্ধতিগত ত্রুটি ১ ও ২
তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলাভাষার ব্যবহার: তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা প্রতিশব্দের ব্যবহার
জাহাঙ্গীর আলম শোভন
(তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক নামে ইংরেজীর পরিবর্তে বাংলাভাষা ব্যবহার করার উদ্দেশ্যে এ লেখা নয়। এটা শুধু এই বার্তা দেয়ার জন্য যে বাংলাভাষাও সমৃদ্ধ ভাষা এ ভাষায় তথ্যপ্রযুক্তি চর্চা করা সম্ভব)
একসময় সর্বস্তরে বাংলাভাষা চর্চার আওয়াজ উঠলো কিন্তু সে উদ্যোগ কখনই নেয়া হয়নি। উচ্চ আদালতে বাংলা চর্চার কথা বলা হলো, সেটি আর কখনো হবে বলে মনে হয়না। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান শিক্ষার কথা বলে গেছেন ড. কুদরত ই খুদা ও ড. আব্দুল্যাহ আল মুতি তা শুরু হলেও শেষ পর্যন্ত টেকে কিনা দেখার বিষয়। এখন মাতৃভাষায় তথ্যপ্রযুক্তি চর্চার কথা বলা হচ্ছে কিন্তু আগেই সে ধারাবাহিতকতা রক্ষা না হওয়ায় এখন তা আর সহজ রইলনা। মোবাইলে যে বাংলা ব্যবহার করা হয় সেটা কেমন যেন গোবোজোরে ধরনের। মহান ভাষা দিবসের মাসে তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে বাংলাকে এবং শিক্ষাকে তুলে ধরার জন্য ৫টি প্রবন্ধ লিখলাম। এটি তার প্রথমটি। এখানে মুলত বাংলা ভাষায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে যেসব ইংরেজী শব্দ ব্যবহার করা হয়, সেগুলো কিভাবে বাংলায় ব্যবহার করা যায়। তার একটা রুপায়ন দেখালাম মাত্র। আমি ইংরেজী ভাষা বা শব্দ ব্যবহার, কোনোটারই বিরোধী নই। আমি শুধু বলতে চাই আমরা বাংলাকে বাংলার মতো বলবো আর ইংজেীকে ইংরেজীর মতো বলার চেস্টা করবো। আমরা বাংলাকে ইংরেজীর মতো বলার হাস্যকর চেস্টা থেকে বিরত থাকবো। এই মেসেজটা দিতে চাই। সেজন্য আমাদের ভাষার অতীত গৌরব, পরবর্তী সমস্যা, মিশ্রণ ও বিভিন্ন ভাষার গতি প্রকৃতি নিয়ে আলোচণা রাখলাম। মাতৃভাষায় বিশেষকরে বাংলাভাষায় যে বিজ্ঞানচর্চা তথা তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক লেখা তৈরী সম্ভব সেটা একটু দেখাতে চেয়েছিলাম। আমি বলতে চাই আমার ভাষা দীণ এবং হীণ নয়। ইনভেনশান এবং ডিসকভার এর একটি মাত্র বাংলা থাকলেও বাংলায় আমাদের এতো বেশী শব্দ আছে যেটা ইংরেজীতে নেই। ভাত, চাল, আর ধানের কিন্তু একটাই ইংরেজী। আমার ভাষা অনেক সমৃদ্ধ কেবল মাত্র উপনিবেশ শাসনের জেরে একটি উপদ্বীপের ভাষা হয়েও ইংরেজী আজ বিশ্বভাষার আসনে বসা। কোনো একজন জমিদার একবার অভিমান করে বলেছিলেন যে ভাষায় কাকা-মামা- খালু একই অর্থ হয়। চাচাতো ভাই- বোন, খালাতো- ভাই বোন, মামাতো ভাই- বোন ও ফুফাকো ভাই-বোন সবাই এক কাজিন শব্দ দিয়ে হয়। সে ভাষা এত কষ্ট করে শেখার দরকার কি?
আমি ইংরেজী ভাষার বিরোধী নই। আমি আমি এটাও চাইনা কাল থেকে সবাই কম্পিউটারকে বলুক গণকযন্ত্র আর আর ল্যাপটপকে বলুক শোয়া গণকযন্ত্র। সেটা নিশ্চয় ভালো শোনাবেনা, শিখতেও ভালো লাগবেনা। বরং সারা বিশ্বে একটা যন্ত্রকে এক নামে চিনলে সেটাই সুবিধা। তবে কিছু কিছু স্থানে আমরা কিন্তু বলতেই পারি যেমন, একিটি ফ্রিজকে কিন্তু আমরা ঠান্ডা আলমারি বলতেই পারি যেমনটা মোবাইলকে বলি মুঠোফোন। সেটা যদি মুঠো আলাপনি হতো হয়তো আরো ভালো হতো। কিন্তু সেভাবে হয়ে আসেনি বিধায় লটাও এখন কঠিন বটে। তবে আমরা নিশ্চয় অহেতুক ইংরেজী শব্দের ব্যবহার না করে কথা বলতে পারি। বিকৃত উচ্চারনে বাংলা বলা থেকে বিরত থাকতে পারি।
প্রথম লেখাটিতে আমি মূলত প্রতিশব্দগুলো দেখিয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তিক্ষেত্রে কোন শব্দের পরিবর্তে কোন শব্দ ব্যবহার করা যায়। এটা ব্যবহার প্রচলনের জন্য জন্য নয় বরং শুধু এই মেসেজটা দিতে চেয়েছি যে আমার ভাষা অনেক সমৃদ্ধ। সেজন্য ইংরেজী শব্দ হিসেবে আমরা চিনি এ ধরনের শব্দের ব্যবহার পরিহার করে ভাষার গৌরব বিষয়ক রচনাটি তৈরী করেছি। তৃতীয় রচনাটি ভাষা সংস্কৃতির জন্য আমাদের করনীয় সম্পর্কে । এটিতে বন্ধনীতে ইংরেজী মূল শব্দটি যেটি বহুল প্রচলিত সেটি রেখে দিয়েছি। চতুর্থ লেখায় বন্ধনীতে বাংলা শব্দটি দিয়েছি। ১ম ও পঞ্চম রচনা স্বাভাবিক বাংলায় লেখা তবে প্রচলিত ও প্রয়োজনীয় ইংরেজী শব্দ রয়েছে। আর আলাদা ছকে শব্দরুপ দেখানো হয়েছে মাত্র।
যদিও বাংলা ভাষায় প্রচুর বিদেশী শব্দ রয়েছে, বেশীরভাগ সংস্কৃত, ফার্সী ও আরবি, এগুলো পরিহার করিনি। এগুলো এখন বাংলাভাষার শব্দ হয়ে গেছে। এগুলো ছাড়া লেখা আমার জন্য সহজ হতোনা। হিন্দি উর্দূ ভাষায় এর চেয়ে ঢের বেশী আরবি ফার্সী শব্দ রয়েছে সেগুলো এখন হিন্দিভাষার শব্দ হয়ে গেছে বলে তাতে সে ভাষার জৌলশ কমেছে বলা হয়না। সমস্যাটা হয় বিনা প্রয়োজনে অতিমাত্রায় ইংরেজী ব্যবহারে। যদিও আজকাল সব ভাষায় ইংরেজী শব্দ অতিমাত্রায় ঢুকে পড়েছে। আমার কাছে মনে হয় এই ঢুকে পড়ার ক্ষেত্রে মাত্রাটা সীমার মধ্যে থাকা উচিত। আর যদি একটি ভালো শব্দ আমার ভাষায় থাকে তাহলে খুব জরূরি নয় যে সেটা অন্য ভাষা থেকে নিতে হবে। আজকের ইংজেী ভাষার গুরুত্বপূর্ণ শব্দসমূহ গ্রীক ও ল্যাটিন এমনকি রোমন জার্মান ও ফরাসি ভাসা থেকে আসা। সূতরাং ভাষার মিশ্রণটা স্বাভাবিক। কিন্তু সেখানে একটা সীমা আছে বলে ইংরেজী ভাষাকে গ্রীক বা ল্যাটিন ভাষা দ্বারা আক্রান্ত মনে হয়না। আর ইয়রেজী ভাষা একটা উপদ্বীপের ভাষা ছিলো বিধায় সে ভাষা পূর্ণাঙ্গ হওয়ার জন্য সেসব সংযোজনের প্রয়োজন ছিলো।
আসুন দেখা যাক শব্দভান্ডার ও তার ব্যাখ্যা
অনলাইন-খোলাধারা/ মুক্তধারা = যেকোন একটি হতে পারে বা দুটিও।
ইন্টারনেট- আন্তজাল= এটা অনেকে ব্যবহার করেছেন।
কম্পিউটার – বৈদ্যুতিক গনকযন্ত্র= কম্পিউটার শব্দের অর্থ গণণাকারী তাই সব দিক বিবেচনায় এই শব্দ ভালো মনে হয়েছে।
ক্যালকুলেটর- হিসাবযন্ত্র/ নামতাযন্ত্র: এই হিসাব মানে বুক কিপিং নয় এই হিসাব মানে গণনা
ল্যাপটপ- ভাঁজগণকযন্ত্র= যেহেতু এতে দুটো অংশ থাকে এবং ভাঁজ করা যায়।
ট্যাব- পাটাগণকযন্ত্র= পাটাতনের মতো একটি পাটা থাকে বলে এই নাম।
মোবাইল ফোন- মুঠোফোন/ মুঠো আলাপনি= শব্দটি অবশ্য অনেকের কাছে পরিচিত।
ওয়াল্ড ওয়াইড ওয়েব- বিশ্ব বি¯তৃত তরঙ্গ= মোটামোটি শব্দ তিনটির অর্থ করলে এমনই দাঁড়ায়
রেফ্রিজারেটর- ঠান্ডা আলমারি = এর জন্য এর চেয়ে ভালো শব্দ আমি পাইনি।
ব্লগ-পঞ্জি= পঞ্জিকা থেকে পঞ্জি
পোস্ট: দাখিলা/পেশ/ডাক= যেকোন ১টি বা ৩টিও হতে পারে।
সার্চ ইঞ্জিণ- অন্বেষী যন্ত্র, অন্বেশৈলী =অনুসন্ধান এর চাইতে অন্বেষন শব্দটা বেশী মানাসই মনে হলো।
ভিডিও- ছলচ্চবি= সিনোম যেহেতু চলচ্চিত্র
অডিও-শব্দধারা= সরাসরি অর্থ না করে, বাস্তবতার আলোকে এই শব্দ ব্যবহার করা যায়।
মাল্টিমিডিয়া:সমন্বিত মাধ্যম= এর জন্য অবশ্য আরো ভালো শব্দ বের করা যেতে পারে।
ওয়েব সাইট- অবতরঙ্গ বা হাওয়াইমাকাম বা বাতায়নী= অনেক শব্দ বসানো যায়।
স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল: আকাশীয় দূরদর্শণ রেখী= চ্যানেল শব্দটার ভালো বাংলা এমুহুর্তে মনে পড়ছেনা।
কম্পিউটার প্রোগ্রাম: গণক আনুষ্ঠা= অনুষ্ঠান থেকে অনষ্ঠা (অনুষ্ঠান এবং এ্যাপস যেন আলাদা বোঝা যায়)
সফ্্টওয়ার: বায়বীয় হাজু (ওয়ার এর বাংলা যাই লিখে তা পদার্থ মনে হয়। তাই এখানে একটি আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহার করেছি)
হার্ডওয়ার- শক্ত হাজু )
লিংক- সংযোগ (এটাতো ডিকশনারীতে আছেই)
সিংক-বিযোগ (মূল শব্দটার নতুনত্বের কারণে যোগ শব্দের একটা বিশেষ রুপ ব্যবহার করা হলো)
পোস্টকাড- ডাকপত্র-= অন্যকোন শব্দ যথার্ত মনে হয়নি।
স্মার্টফোন: বহুমূখী আলাপনী= নিশ্চয় চটপটে আলাপনি শুনতে ও এর কাযকারিতা বোঝাতে যথাযত মনে হতোনা।
টিউটোরিয়াল- শিখনী= এটা মোটামোটি সহজ শব্দ
ভিডিও টিউটোরিয়াল- চলচ্চবি শিখনী
ট্রান্সলেটর- অনুবাদী
স্ক্যান- বুলা: হাত বুলাতে বা চোখ বুলানো তা থেকে নেয়া।
সিডি- কলের গুমনি: তাঁতের গুমনির কথা ভেবে এই নাম রাখা হয়েছে।
লেকচার শীট- বক্তপত্র= বক্তৃতাপত্রও হতে পারতো।
ইউনিকোড- সম্ববর্ণ=
ডিজিটাল- আঙ্কিক
ই কমার্স- দ্যুতি ব্যবসায়= (এখানে বিদ্যুৎ বা বৈদ্যুতিক বাজার বললে আমরা বিদ্যুৎ এবং বিদ্যূৎ সামগ্রী বুঝতে পারি, তাই এ শব্দ।)
সাইনবোর্ড- নামফলক
সিনেমাহল-পেক্ষাগৃহ
গাইডবই (বোধিনী)
কোনো সন্দেহ নেই, এই অভিধান ভাষাবিদ পন্ডিতরা তৈরী করলে আরো নিখুত হতো। কিন্তু এটা আসলে ব্যবহারিক অভিধান নয় এটা কেবল এটা বার্তা মাত্র।
বিদেশী লোকেরা যখন বাংলা শিখে তখন তারা বানান ও উচ্চারণ এর বিভিন্ন সমস্যায় পড়ে। অনেককেই বলতে শোনা যায় যে তোমরা ভাষার অধিকারের জন্য জীবন দিয়েছো অথচ ভাষার উন্নয়নের জন্য কোন পদক্ষেপ নিচ্ছনা। আসলেও তাই লাখো জীবনের বিনিময়ে অর্জিত দেশ উন্নয়ন এর ব্যাপারেও আমরা কতা আন্তরিক? এসব প্রশ্ন তো রয়ে যায়। কিন্তু ভাষার উন্নয়ন বিশেষ করে অভিন্ন বানানরীতি অনুসরণের ব্যাপারে পদক্ষেপ এবং বিকৃতিরোধে কার্যকর কর্মসূচী গ্রহণ করা দরকার। হিন্দি ও ইংরেজীর বহুল প্রভাব থেকে বাঁচতে ভারতের বিভিন রাজ্য ইতোমধ্যে কাজ শুরু করে দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার এরই মাঝে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। আদালত বাংলায় নামফলক বাধ্যতামূলক করাসহ বেশকিছু নির্দেশণা জারি করেছে। এবং ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে নিজেদের ভাষার দূরদর্শণ বেশী দেখে হিন্দির চেয়ে। পেক্ষাগৃহে হিন্দি সিনেমার আধিপত্য থাকলেও রাজ্য সরকার গুলো নিজেদের ছবির চেয়ে হিন্দি ছবিগুলোর জন্য অনেকবেশী কর ধার্য করে থাকে।
আমাদের দেশে হিন্দি ও ভারতীয় দূরদর্শণএর কু প্রভাব মারাত্বক আকার ধারণ করেছে। আমাদের টিভি চ্যানেল যেখানে ভারতে দেখানো হয়না সেখানে আমরা তাদের সব চ্যানেল দেখাই। অন্তত বাজে দূরদর্শণগুলো বিশেষ করে স্টার জলসাটা, সাটার প্লাসটা তো আমরা অন্তত বন্ধ করতে পারি। কয়েকজন কিশোরীর মৃত্যুর পর আমাদের বোঝা উচিৎ এগুলো আমাদের সমাজ জীবনে কতটা খারাপ প্রভাব ফেলছে। সব প্রভাব হয়তো আমরা সেভাবে বুঝতে পারছিনা। কিন্তু আজকের সামাজিক ও পারিবারিক সংকট যে ঘরে ঘরে তৈরী হয়েছে। পত্রিকার পাতায় যেগুলো আমাদের দেখে শিওরে উঠতে হয়। এসবের হয়তো অনেক কারণ রয়েছে। কিন্তু একটা কারণ যে হিন্দি বাংলা নেতিবাচক দূরদর্শণগুলোর উদ্ভট সব নাটক ও অনুষ্ঠানের কারণে হচ্ছ্ েসেটাতো প্রমাণ হয়েই গেলো। জ্ঞানীরা আগেই শেখে, বুদ্ধিমানেরা দেখে শেখে, বোকারা ঠেকে শেখে, আমরা কখনোই শিখলামনা।
6,297 total views, 2 views today