দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে এখন ই-কমার্স একটি উদীয়মান সেক্টর। ইন্দোনেশিয়া, মায়ানমার, থাইল্যাণ্ডে অনলাইনে কেনাকাটা বেড়েই চলেছে। জনপ্রিয় টেক-বিজনেস ওয়েবসাইট টেক ক্রাঞ্চ ২০১৬ সালে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে ই-কমার্সের কি কি ট্রেন্ড হতে পারে তা নিয়ে একটি আর্টিকেল প্রকাশ করেছে। ই-ক্যাব ব্লগ এর পাঠকদের জন্যে সংক্ষিপ্ত আকারে এ ট্রেন্ডগুলো তুলে ধরলাম-
Source: Northrop & Johnson
১. ই-কমার্স সেক্টরে মেধাবী কর্মীদের বেতন খুব দ্রুত বৃদ্ধি পাবে-
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর ই-কমার্স সেক্টরের সবচেয়ে বড় দূর্বলতা হচ্ছে এখাতে মেধাবী কর্মীদের স্বল্পতা। যার ফলে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো সবসময়ে মেধাবী কর্মীদের খোঁজে থাকে এবং অন্য প্রতিষ্ঠান থেকে বেশি বেতন এবং সুবিধা নিয়ে কর্মীদের নিয়ে যায়। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদের ব্যবসার জন্যে এটি মোটেও ভাল কৌশল নয়। সুযোগ-সন্ধানী কর্মচারীরা অনেক সময় এমন পদে চাকরি পায় যা তাদের অভিজ্ঞতা এবং যোগ্যতার সাথে মানানসই নয়।
২. অনলাইন বিজ্ঞাপনে বিশাল পরিবর্তন
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ই-কমার্স মার্কেট অনেক ভাগে বিভক্ত। ইংরেজি ভাষায় যাকে বলে “Fragmented।” তাই ২০১৬ সালে এই বাজারে অনলাইনে বিজ্ঞাপন প্রদান করে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করা হবে একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ।
৩. পণ্য ডেলিভারি:
২০১৬ সালে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে যেসব ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসা করছে তাদের অনেকেই নিজস্ব ডেলিভারি সিস্টেম চালু করবে কারণ অনলাইনে অর্ডার বৃদ্ধি পাবে এবং এসব অর্ডার ডেলিভারি দিতে না পারলে ব্যাপক সমস্যার সৃষ্টি হবে। যেসব থার্ড-পার্টি-লজিসটিক্স সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান আছে তারা মূলত বি-টু-বি সেবা দেবার ক্ষমতা রাখে। বি-টু-সি মোডে পণ্য ডেলিভারি দেবার জন্য থার্ড পার্টি লজিসটিক্স ভাল নয়। বি-টু-সি মোডে শুধু পণ্য ডেলিভারি দিলেই হয় না, ফেরত প্রদানকৃত পণ্যের ব্যবস্থাপনা, পণ্য ডেলিভারি দেবার আগে ক্রেতার সাথে যোগাযোগ, বিভিন্ন জায়গায় ডেলিভারি প্রদান এবং তার সাথে ক্যাশ-অন-ডেলিভারি সম্পর্কিত ঝামেলা তো আছেই। বাংলাদেশে ডেলিভারি সমস্যাটা আরো প্রকট এবং বি-টু-সি ই-কমার্স পণ্য ডেলিভারি দিতে পারে এমন কুরিয়ার নেই। যেসব কুরিয়ার আছে তারাও আসলে ই-কমার্সের পণ্য ডেলিভারি দেবার উপযুক্ত নয়।
৪. গুগল এবং ফেইসবুকের বিকল্প:
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে অনলাইনে ব্যবসা প্রমোশনের ক্ষেত্র খুবই সীমিত। দুই তিনটি প্ল্যাটফর্ম ছাড়া এমন কোন প্ল্যাটফর্ম নেই যেখানে লক্ষ লক্ষ লোক জড়ো হয় যেমন-সংবাদপত্র ওয়েবসাইট, সামাজিক যোগাযোগ সাইট (ফেইসবুক, টুইটার ইত্যাদি) এবং গুগল এসইও। কিন্তু ২০১৬ সালে অনেক উদ্যোক্তা বিকল্প প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলবার চেষ্টা করবেন যার মাধ্যমে ই-কমার্স ব্যবসা বিজ্ঞাপন দিতে পারে যেমন- প্রাইস কমপ্যারিজন ওয়েবসাইট, কুপন সাইট, ক্যাশ-ব্যাক সাইট ইত্যাদি। এছাড়াও বিভিন্ন ধরণের অভিনব অ্যাফিলিয়েটিং মার্কেটিং পন্থা এবং প্ল্যাটফর্ম ডেভেলপ করা হবে।
৫. সিঙ্গল ফ্যাশন স্টোর বিলুপ্তির আশঙ্কা:
Source: Reco Platform
অনলাইনে সবচেয়ে বেশি বিক্রী হয় ফ্যাশন অ্যাণ্ড অ্যাকসেসরিজ পণ্য (PayPal Cross-Border Consumer Research 2015) এবং বর্তমানে অনলাইনে অনেক ফ্যাশন স্টোর আছে যারা নিজস্ব ব্রাণ্ডের পণ্য বিক্রী করে থাকে। কিন্তু অনলাইন মার্কেটপ্লেসের দাপটে এসব স্টোর গুলো টিকে থাকতে পারবে না। কারণ এসব স্টোরগুলোতে যেসব পণ্য বিক্রী হবে সেই একই ধরণের পণ্য অনেক কম দামে অনলাইন মার্কেটপ্লেসে পাওয়া যাবে। শুধু তাই নয় ফেইসবুক, টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগ সাইটগুলোতে অনেক ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠান পণ্য বিক্রী করছে যার ফলে অনলাইন মার্কেটপ্লেসগুলোর জন্যেও লাভ করতে বেশ কষ্ট হবে।
৬. ক্যাশ-অন-ডেলিভারি
২০১৬ সালেও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্যে ক্যাশ-অন-ডেলিভারি একটি বড় মাথা-ব্যথার কারণ হয়ে থাকবে। ২০১৪ সালে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনলাইন পেমেন্টের ৭৪% ছিল সিওডি এবং ২০১৫ সালে ৫৩%। ইতিমধ্যেই অনেক প্রতিষ্ঠান অনেক বিকল্প তৈরি করেছে কিন্তু মূল চ্যালেঞ্জটা হচ্ছে এসব বিকল্প ব্যবস্থা কতটা বিস্তৃত অর্থাৎ মানুষ কত সহজে এসব ব্যবস্থা তাদের হাতের কাছে পাবে। এই নেটওয়ার্ক যত উন্নত হবে তত সিওডি এর হার কমতে থাকবে।
৭. ক্রস-বর্ডার ই-কমার্স এর বদলে সিল্ক রোড ২.০:
২০১৬ সালে দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর মধ্যে সেভাবে ক্রস-বর্ডার ই-কমার্স বাড়বে না যদিও বিগত কয়েক বছর ধরে আসিয়ান ইকনোমিক কমিউনিটি (এইসি)নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে কিন্তু এইসি ক্রস-বর্ডার ই-কমার্স বৃদ্ধিতে ততটা কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারবে না কারণ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো এখনো আভ্যন্তরীন ই-কমার্স বাজার কেন্দ্রিক। এসব দেশগুলোতে ই-কমার্স বাজার এখনো বাড়ছে এবং আরো বাড়বে। এর পাশাপাশি আসিয়ান দেশগুলোর সরকারের নীতির মধ্যেও ব্যাপক অসামঞ্জস্য আছে যা ক্রস-বর্ডার ই-কমার্সের বিশাল প্রতিবন্ধক।
Source: Wikipedia
যা হবে তা হলো চীনের ই-কমার্স সাইট অনলাইনে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে পণ্য বিক্রী করবে।যেমন-গত বছরে জেডি ডট কম ইন্দোনেশিয়াতে তাদের ব্যবসা শুরু করেছে। একে বলা হচ্ছে সিল্ক রোড ২.০(Silk Road 2.0.)। আলিবাবা এসব দেশে দীর্ঘদিন ধরে পণ্য বিক্রী করছে অনলাইনে। প্রাচীন কালে চীনের সিল্ক রুট ধরে বিখ্যাত সিল্ক কাপড় এশিয়া ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছিল। ঠিক একইভাবে ই-কমার্সের মাধ্যমে চীনের পণ্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়বে।
৮. বি-টু-সি প্রতিযোগিতা এড়িয়ে নতুন নিসে কমার্স
২০১৪-২০১৫ অর্থ বছরে অ্যামাজন ইন্ডিয়ার নেট লস এর পরিমাণ ১৭২৪ কোটি রুপি। কিন্তু বিক্রী বেড়েছে ছয় গুণ। এর আগের বছরে অ্যামাজন ইন্ডিয়ার নেট লস এর পরিমাণ ছিল ৩২১কোটি রুপি। ভারতের সবচেয়ে বড় তিনটি ই-কমার্স সাইট -অ্যামাজন ইন্ডিয়া, স্ন্যাপডিল এবং ফ্লিপকার্ট এর সমন্বিত নেট লস এর পরিমাণ ৫,০৫২ কোটি রুপি। এই বিশাল ক্ষতির পিছনে অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলো লাভ না করে ভারতের ই-কমার্স বাজারের বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ নেবার চেষ্টা করছে। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্যে তারা ক্রেতাকে ব্যাপক ডিসকাউন্ট দিয়ে সাইট থেকে পণ্য কিনতে আকৃষ্ট করছে। এর পাশাপাশি কর্মী নিয়োগ, বিজ্ঞাপন খাতে তারা প্রচুর খরচ করছে। ফলে লাভ করতে পারছে না। ২০১৬ সালেও বি-টু-সি খাতে এ অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলতে থাকবে কিন্তু অনেক বি-টু-সি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান এ ধরণের অসু্স্থ প্রতিযোগিতা এড়িয়ে নিস মার্কেট (Niche Market) এ ব্যবসা করবে।
৯. ওমনি চ্যানেলে ব্যবসা:
ওমনি (Omni) শব্দটির অর্থ হচ্ছে সব কিছু মিলিয়ে বা সর্বব্যাপী। ওমনি চ্যানেল বলতে এখানে অনলাইন অফলাইন এর সমন্বিত অবস্থা। এর মানে হলো এমন এক পরিবেশ তৈরি করা যেখানে অনলাইন এবং অফলাইনের মধ্যে কোন পার্থক্য থাকবে না। ক্রেতা অনলাইনে কেনাকাটা করলেও যেন দোকানে কেনাকাটা করছে এরকম সুবিধা পায়। ২০১৬ সালে অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান যেগুলো প্রথাগত দোকানের মাধ্যমে ব্যবসা করে সেগুলো অনলাইনে ব্যবসা বিস্তার করবে এবং অন্যদিকে অনেক অনলাইন প্রতিষ্ঠান অফলাইনে তাদের ব্যবসা বাড়াবে।অনলাইন প্রতিষ্ঠান অফলাইনে যাবার কারণ হলো তারা বিভিন্ন স্থানে দোকান বা ডেলিভারি সেন্টার স্থাপনের মাধ্যমে ক্রেতাকে আরো ভালভাবে ডেলিভারি দিতে পারবে এবং ক্রেতার সাথে যুক্ত হতে পারবে।
১০. ব্রান্ড ডট কম এর উত্থান:
উন্নত বিশ্বে ই-কমার্সের উত্থান টা দেখলে দেখা যাবে যে প্রথমে এসেছে পি-টু-পি (Craigslist) তারপরে সি-টু-সি (eBay) এবং বি-টু-সি (Amazon)। এরপরের স্তরটা হচ্ছে ব্রাণ্ড ডট কম অর্থাৎ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত ব্রাণ্ড অনলাইনে তাদের পণ্য বিক্রী করবে যেমন- Nike, J.Crew and Gap। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ই-কমার্সেও এ ধরণের ট্রেন্ড হবে ২০১৬ সালে। ইতিমধ্যে বি-টু-সি ই-কমার্স খুবই জনপ্রিয় হয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে। এর পরের ধাপে নামী ব্র্যাণ্ড গুলো তাদের অনলাইন স্টোর খুলবে। চীনে ইতিমধ্যেই এটা শুরু হয়ে গিয়েছে। চীনের ক্রেতারা পাশ্চাত্য বিশ্বের নামী-দামী ব্র্যাণ্ডের পণ্য প্রচুর ব্যবহার করেন।
সূত্রঃ
10,287 total views, 3 views today