
কেন ই-কমার্স আইন চায় না উদ্যোক্তারা?
jahangir Alam Shovon
দেশে মাত্র ৫-৭ শতাংশ মানুষ অনলাইনে কেনাকাটা করে এবং মাত্র ২% এর কাছাকাছি মানুষ নিয়মিত কেনে। কিন্তু প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষের অনলাইন থেকে কেনাকাটার সুযোগ রয়েছে। এই খাতে করোনাকালীন সময়ে ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ার মতো দেশে ৭০০% পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি ঘটেছে যেখানে আমাদের প্রবৃদ্ধি একটিমাত্র শাখায় ৩০০% এর বেশী হয়নি। তাই এই অবস্থায় এখানে কোনো বন্ধন ও শৃংখল এই খাতের বিকাশকে বাঁধাগ্রস্থ করবে বলে খাত সংশ্লিষ্ঠরা মনে করছেন।
১) ই-কমার্সকে সরকার এখনো স্বতন্ত্র ব্যবসা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। বিশেষ করে ট্রেড লাইসেন্স করার সময় এই খাতের উদ্যোক্তারা ব্যবসার ধরণ হিসেবে ‘‘ই-কমার্স’’ লিখতে পারেন না। কারণ ট্রেড লাইসেন্স অ্যাক্ট ২০১৬ তে এই নামে কোনো ব্যবসা নেই। এ ব্যাপারে একাধিক চিঠি ও মিটিং হলেও আজো অবধি এটা সংযোজন হয়নি। যেখানে এটিকে আলাদা ব্যবসা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। সেখানে এই বিষয়ে নতুন আইন যুক্তিসঙ্গত নয়।
২) এখনো বিভিন্ন বিধি ও নির্দেশিকাতে ই-কমার্স এর সংজ্ঞা পরিষ্কার করা হয়নি এবং ই-কমার্সকে আইটি ওআইটিইস এর খাত থেকে আলাদা করা হয়েছে। কিন্তু এজন্য সরকারের কোনো খাতে কোনো ধরনের বাড়তি সহযোগিতা দেয়া হয়নি। এই খাত মাত্র বিকশিত হতে শুরু করেছে। এই অবস্থায় আইন হলে এই খাতের উন্নতি বাঁধাগ্রস্থ হতে পারে।
৩) ইতোপূর্বে দুটো ডিজিটাল ব্যবসাখাতে লাইসেন্স পদ্ধতি চালু করা হয়েছে একটি হলো কল সেন্টার এবং অন্যটি হলো রাইড শেয়ার। লাইসেন্স অথরিটি করে ডুয়িং বিজনেস তথা ব্যবসাটিকে নানা শর্ত দিয়ে কঠিন করে দেয়া হয় এতে এর বিকাশ হয়না উল্টো এটি সংকুচিত হয়ে যায়। এই দুটো খাত তার প্রমাণ
৪) এ ধরনের লাইসেন্স জাতীয় অনুমোদন এর ক্ষেত্রে অথরিটি সাধারণত কার্যক্রম কাগজেপত্রে সীমাবদ্ধ থাকে। ফলে বড়ো প্রতিষ্ঠানগুলো সেসব মেনে চলে। এবং মানতে গিয়ে তারা ব্যবসা করতে পারে না। কারণ অন্যরা নিয়মগুলো মানে না। এবং সংশ্লিষ্ঠ অথরিটি এসব বিষয় ঠিকভাবে দেখে না। বর্তমানে রাইড শেয়ারিং ব্যবসা লাইসেন্স নিয়ে করার নিয়ম করা হলেও। রাইডাররা রাস্তায় লোক ডেকে ডেকে সেবা দিচ্ছে। এতে একদিকে নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরী হচ্ছে অন্যদিকে সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কিন্তু বিষয়টি কেউ দেখছেনা। এতে যারা নিয়ম মেনে ব্যবসা করছে তারা ক্ষতির মুখে পড়েছে। ই-কমার্স এর ক্ষেত্রে এরকম হওয়ার আশংকা রয়েছে।
৫) ই-কমার্সের ক্ষেত্রে বিগত দিনগুলোতে যেসব অনিয়ম সংগঠিত হয়েছে। সেগুলোর শাস্তি ও বিচারের কথা বাংলাদেশের কোনো না কোনো আইনে রয়েছে। এখন বিষয়ে আবার আইন ও শাস্তির ব্যবস্থা হলে বিচারের ক্ষেত্রে দ্বৈততা হওয়ার আশংকা আছে।
৬) চীণ ছাড়া পৃথিবীর কোনো দেশে ই-কমার্স সংক্রান্ত আইন আছে বলে তথ্য পাওয়া যায়নি। ভারতে ভোক্তা আইনের অধীনে একটি বিধি রয়েছে মাত্র। তাই এই খাত বিকাশের আগে এখানে আইন তৈরী হলে তা যথেষ্ঠ সময়োপোযোগী না হওয়ার আশংকা রয়েছে। এবং এতে হীতে বিপরীত হতে পারে। আমাদের ই-কমার্স চীণ ও ভারতের চেয়ে বহুগুনে পিছিয়ে রয়েছে।
৭) বর্তমান প্রচলিত আইনের মাধ্যমে ই-কমার্স খাতের প্রতারণা রোধ করা সম্ভব বলে প্রতীয়মান হয়েছে। কারণ আইন ও বিধি প্রয়োগের মাধ্যমে এই খাতে অনিয়ম দূর করা সম্ভব হয়েছে। এতে প্রমানিত হয়েছে আইন নেই একথা ঠিক নয় বরং আইনের প্রয়োগ করা হয়নি বলে সমস্যা তৈরী হয়েছে।
৮) বর্তমানে প্রায় ২০টির বেশী কতৃপক্ষ ই-কমার্স খাতকে তদারকী করে। কারণ এই খাত কোনো নির্দিষ্ঠ পণ্য সেবা ভিত্তিক নয় বরং সব ধরনের ব্যবসাই এই খাতে হয়। এতসব কতৃপক্ষের তদারকীতে অনেক সময় উদ্যোক্তারা তাদের স্বাভাবিক কাজ করতে পারেন না। আরো একটি কতৃপক্ষ হলে সে সমস্যাটি আরো প্রকট হতে পারে।
৯) ই-কমার্স অন্য ব্যবসার মতোই ব্যবসা শুধু এতে ডিজিটাল গেজেট ব্যবহার করা হয়। অন্য ব্যবসা খাতের মতো এখানে দ্বি-পাক্ষিক সমস্যা, অসম প্রতিযোগিতা এবং ভোক্তা পযর্ায়ে প্রতারণার ঘটনা ঘটেছে। যা ভোক্তা অধিকার আইন, প্রতিযোগিতা আইন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, কোম্পানী আইন, নিরাপদ খাদ্য আইন ও পেনাল কোড দ্বারা এসব সমস্যার সমাধান সম্ভব।
১০) এতদসত্বেও ই-কমার্সের কথা যেহেতু আইন গুলোতে পরিভাষাগতভাবে উল্লেখ নেই, সে সমস্যা দূর করতে ইতোমধ্যে ভোক্তা অধিকার আইনের সংশোধন চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে এবং প্রতিযোগিতা আইন সংশোধন এর প্রাথমিক খসড়া তৈরীর কাজ চলছে এবং ট্রেড লাইসেন্স অ্যাক্ট সংশোধনী ইতোমধ্যে প্রস্তাব করা হয়েছে। যাতে এই খাতের সব বিষয় অন্তভূক্ত হয়ে আসছে। এ অবস্থায় আরেকটি আইন দ্বৈততা নিয়ে আসার আসবে বলে সকলে মনে করছে।
১১) প্রস্তাবিত ডিজিটাল কমার্স আইনে যেসব বিধান প্রস্তাব করা হয়েছে তা কোনো না কোনো আইনে রয়েছে এবং যেসব শাস্তির প্রস্তাব করা হয়েছে তা বাস্তবসম্মত ও যুক্তি সঙ্গত নয়। যেমন উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, নিবন্ধনবিহীণ ব্যবসায় ১ লাখ টাকা জরিমানা। যেখানে প্রস্তাবিত আইনে ট্রেড লাইসেন্স ফি ধরা হয়েছে ৫শ টাকা এবং ডিবিআইডি কোনো ফি নেই সেখানে এধরনের একটি ব্যবসার জন্য এ ধরনের জরিমানা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তাছাড়া ট্রেড লাইসেন্স ছাড়া ব্যবসা করলে যেখানে এ ধরনের জরিমানা নেই অনলাইনের ক্ষেত্রে এ ধরনের বিধান। সাংবিধানিক সমতার পরিপন্থি।
১২) বিভিন্ন পর্যায়ে ই-কমার্স নিয়ে নীতি নির্ধারকদের এখনো ধারণা পরিষ্কার ও গভীর নয়। সেখানে এ ধরনের একটি আইন তৈরীর সিদ্ধান্ত ও কাজের ক্ষেত্রে ঝুঁকি থেকেই যায়।
১৩) ডিজিটাল কমার্স উন্নয়নে সরকার ডিজিটাল কমার্স পলিসি ২০১৮ প্রনয়ন করে। এখনো এই পলিসির ৭০ ভাগ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয়নি। এ অবস্থায় এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না করে আইন প্রণয়ন করা একটি স্ববিরোধী সিদ্ধান্ত হতে পারে। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে প্রাইভেট সেক্টর ডেভলপমেন্ট কমিটির ১৩তম সভায় এই খাতের উন্নয়নে গৃহিত পদক্ষেপসমূহ আজো আলোর মুখ দেখেনি।
১৪) নিবর্তনমুলক আইন কল্যানমূখী বাজারের বিপরীত এতে রক্ষনশীল মনোভাব ও নানারকম বিধিনিষেধের কারণে বিদেশী বিনিয়োগ বাঁধাগ্রস্থ হয় এবং দেশীয় উদ্যোক্তারা নিজেদের বিনিয়োগ বিদেশে স্থানান্তর করতে পারে। এ ধরনের আইন হলে এখানে একই আশংকা থেকে যায়।
বর্তমানে ক্রস বর্ডার ই-কমার্সের মাধ্যমে রপ্তানীমুখী ই-কমার্সের উন্নয়নঘটিয়ে দেশের পণ্যের বাজার বিদেশে বিকশিত করে বৈদেশিক মূদ্রা অর্জনের সুযোগ থাকা সত্বেও এই খাতে সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত ও সেবা পর্যায়ে নানা সমস্যার কারণে এটি বিকশিত হচ্ছে না উপরন্তু এই খাতের উদ্যোক্তারা বিদেশে ব্যবসা স্থানান্তর করছেন। এই অবস্থায় আরেকটি আইন এই খাতে ইতিবাচক বার্তা না দিয়ে নেতিবাচক বার্তা দিচ্ছে বলে সকলে মনে করছেন।
জাহাঙ্গীর আলম শোভন
নির্বাহী পরিচালক, ই-ক্যাব
1,040 total views, 3 views today