কিছু গল্প বেচা কেনার
জাহাঙ্গীর আলম শোভন
স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবসায় কাকে বলে, উহা কত প্রকার ও কি কি? কারবার পদ্ধতি প্রত্র যোগাযোগ অনেক পড়েছি। এখন ওসবের আর সময় নেই। ই কমার্স ব্যবসা শুরু করেছি। পারলে কিছু বুদ্ধি দেন, তা পারলে পরামর্শ দিন আর তাও যদি না পারেন তাহলে আইডিয়া দিন। হ্যা ইতিপূর্বে আপনাদের বেশকিছু আইডিয়া দিয়েছি। আজ বরং কিছু বাস্তব ঘটনা শেয়ার করি, যাতে এর থেকে আপনারা কোনো আইডিয়া খুজে পান।গল্পে গল্পে আজকের ঘটনাগুলো শেয়ার করা যাক
১. হাফিজ ও মফিজ:
হাফিজ মিয়া 5 বছর ধরে এই বাজারে ব্যবসা করে। স্টেশনারী, বই খাতা এইসব। হঠাৎ পাশের বাড়ির মফিজ মিয়া দেখলো হাফেজ মিয়াতো তলে তলে এই ব্যবসায় ভালোই তরক্কি করেছে। তাহলে আমিও এই ব্যবসাটাই করবো। যে কথা সে কাজ ঠিক একশ গজ দূরত্বে মফিজ মিয়া একখানা দোকান দিলেন।কিন্তু বেচাকেনা আর হয়না। একদিন একজন পরামর্শ দিলো ‘‘আরে বোকা তোকে তো আগে কাস্টমার ধরতে হবে তারপর বেচাকেনা কিন্তু কিভাবে কাস্টমার ধরা যায় এই বিষয়ে মফিজ মিয়ার কোনো ধারনাই নেই। কাস্টমারকে কি বাড়ী থেকে ধরে আনতে হবে। মনে মনে প্রশ্ন করে মফিজ। বড়ভাই যেন তার মনের কথা শুনতে পেলো ‘‘ আরে হাদারাম কাস্টমার রাস্তা থেকে ধরে আনতে হয়না’’ সব জিনিস কম দামে ছেড়ে দে, সবাই যখন জেনে যাবে তোর দোকোনে জিনিস কম দামে পাওয়া যায়, বেচাকেনা বেড়ে গেলে তখন আস্তে করে দাম বাড়িয়ে দিবি, বলবি মার্কেট উঠে গেছে।
কথাটা মনে ধরলো মফিজের, তাই শুরু হলো কম দামে বেচার মিশন কেনা দামে বেচা শুরু করলো মফিজ, কখনো কখনো তার চেয়েও কম। দৈনিক 2-4 শ টাকা লস দিলে কি এমন ক্ষতি। আসলে তাই েএতে কাজ হলো বেচাকেনা বেড়ে গেল।
বিষয়টা টের পেলা হাফিজ মিয়া, প্রথমে মনে কষ্ট পেলো, পরে চিন্তা করলে ‘‘ নাহ মন খারাপ করে লাভ নেই। কৌশলে এগুতে হবে।
তারপর এক অদ্ভুদ বুদ্ধি বের করে চুপচাপ বসে রইলো। ছেলে মেয়রা সব মফিজ এর দোকান থেকে কেনাকাটা করে আর হাফিজ চেয়ে চেয়ে দেখে। মফিজের দোকানে ভালোই বিক্রি হয়। ছয়মাস পর দেখা গেলো মফিজের 2 লাখ টাকা লস। এখন নুতুন চালান করবে সেই টাকা পর্যন্ত নেই। তখন জুন মাস বেচাকেনাও খারাপ। মাল আনলেও পড়ে থাকবে। বইয়ের ব্যবসা সারা বছর চলে না। এখন বেচাকেনার জন্য যে আরো 6 মাস মানে জানুয়ারী পর্যন্ত অফেক্ষা করবে সেই অবস্থা নেই। বউ এটা ওটা আনতে বলে। কিন্তু বাজার করার পয়সাটাতো তার পকেটে থাকতে হবে। মফিজ হিসেব করে দেখলো 2 লাখ টাকা তুলতেই আগামী 2 বছর লাগবে তারপর শুরু হবে লাভ। তাই অনেক ভেবে সে দোকানটা বিক্রি করে দিল। দোকান কিনলে হাফিজ মিয়া।
রহস্যটা হলো: মফিজ মিয়ার বেশীরভাগ জিনিসই লোক দিয়ে আগেই কিনেছে হাফিজ মিয়া। তার দোকানে একটু বেচাকেনা কম হয়েছে । কিন্তু যা বেচা হয়েছে সব মাল মফিজের কাছ থেকে আনা, পাইকারী রেটে আনার পরও ওগুলোর উপর হাফিজের লাভ হেয়েছে। কারণ এগুলো গঞ্জে থেকে আনতে গেলে হাফিজের অনেক টাকা গাড়ি ভাড়া যেত।
মোহাম্মদ আলী:
ছোটবেলায় আমাদের এলাকায় নোয়াখালী কলেজের হাশেম স্যারের একটি গান খুব জনপ্রিয় ছিলো। নোয়াখালির আঞ্চলিক গান ‘‘ ডুবাই গেছে আঙ্গো বাইর মোহাম্মদ আলী, আলীর মা কান্দে, বৌ কান্দে, কান্দে আলীর হালি’’ (হালি মানে শালী)। তো আমাদের আজকের গল্প ধরি সে মোহাম্মদ আলীকে নিয়ে। ডুবাইতে খুব সবিধা করতে না পেরে মোহাম্মদ আলী দেশে চলে এলো। দেশে এসে ঢাকা শহরের এক এলাকায় পুরানা ফার্নিচারের দোকান দিলো। প্রথমে পোস্টারিং ‘‘ নতুন পুরাতন ফার্নিচার ক্রয় বিক্রয় করা হয়’’ তারপর কিছু ফার্নিচার সহ রেলগেটের পাশে বসে গেলো। বিদেশ থেকে আনা টাকায় বেশ ফার্নিচার কিনতে পারলো। প্রতিদিন 3-5টি আইটেম বিক্রি হয়। 5শ টাকা করে লাভ হলে দুই হাজার টাকা, আরো বেশী হলেতো কথাই নেই।
মোহাম্মদ আলীর লাভের রহস্য হলো: মোহাম্মদ আলীর কাছে যদি 10টি আলমারীও থাকে সে একটাই শো করে,, আর বলে যে মাত্র এক পিস ই আছে। সাধারনত অল্প আয়ের মানুষেরা এখান থেকে কিনে। তাদের কাছে দাম একটা বিষয় আবার যদি শুনে একটাই আছে আর নাই, কবে এমন পুরান মাল পাওয়া যাবে তারও ঠিক নাই। তখন দরদামে 5শ একহাজার টাকা নিজের আন্দাজ থেকে বেশী মনে হলেও সেটা লোকেরা কিনে ফেলে। এতে করে প্রতিটা আইটেমে আলীর ভালো লাভ থাকে। আলী এখন বেশ ভালো আছে। দুটা বড়ো স্টোর রুম আছে, 5/6 জন মিস্ত্রি আছে যারা পুরনো ফার্ণিচারগুলো মেরামত করে।
গাজী মিয়া:
গাজী মিয়া গ্রামে থাকেন তার অতো শতো ব্যবসা করার সময় নেই। গ্রামেই তাকে কিছু করতে হবে। সমসাময়িক অনেকে মুরগির ফার্ম দিয়ে লস খেলো। তাই সেটাতেও ভয়। একবন্ধু মাছের প্রজেক্ট করলো প্রতিবেশীর সাথে শত্রুতা থাকায় বিষ দিয়ে তার মাছ সব মেরে দিলো। তার এক ভাই গরুর খামার দিলো। একদিন রাখালসহ সব গরু উদাও একেবারে মাথায় হাত। এসব দেখে গাজী মিয়ার কোনোকিছুতে মন বসে না। এদিকে তার একটা ভালো ঘর নেই। ঘর তোলা দরকার।গাজী মিয়ার হঠাৎ খেয়াল হলো, গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে তারা বাবা বেচে থাকতে বেশ কিছু গাছ কিনে রেখে গেছে। খুব ছোট নয় আবার খুব বড়ো নয়। 100 টাকা থেকে 500, 1000, 1200 এ ধরনের দামে গত 10 বছর ধরে গাজী মিয়ার বাপ কাজী মিয়া মোট 42 টি গাছ কিনেছেন। কথাছিলো গাছ যেভাবে আছে এভাবে থাকবে। কাজী মিয়ার যখন প্রয়োজন তখন বা বড়ো হলে গাছ নিয়ে যাবে। গাছ বিক্রেতাও খুশি হলো, অভাবের সময় নগদ কিছু টাকাও হলো আর যতদিন গাছ থাকবে ততদিন কিছু ছায়া বা ফলও খাওয়া যাবে। কথাটা গাজী মিয়া ভুলেই িগেয়েছিলো যদি না পাশে বাড়ীর মাঝি এসে না বলতো যে মাঝির ঘরের পাশের তার বাবার কেনা গাছটা কিনে এবার কেটে আনতে হবে কারণ মাঝি তার রান্নাঘর বড়ো করবে।
বাড়ি বাড়ি হেটে সব গাছের খবর নিয়ে গাজী মিয়া দেখলো। 42টা গাছ কম করে হলেও 3 লাখ টাকা বিক্রি করা যাবে। সব গাছ কেটে কিছু গাছ ঘরের জন্য রাখলো বাকীগুলো বেচে দিলো। হাতে কিছু নগদ টাকাও এলো। এবার গাজী মিয়া চিন্তা করলো হ্যা আমি এই ব্যবসাটাই করবো।
তবে ভাই, এই আইডিয়া শোনার পর কেউ যদি অন্যের ই কমার্স পেজে রাখা পন্য আগে দাম দিয়ে কিনতে চান। তাহলে লেনদেনটা সাবধানে করবেন। এ ধরনের আরেকটি লেনদেন হয়। ইটখোলা গুলোতে যেমন ধরুন আপনি 2000 টাকা দরে সিজন আসার আগেই 10.000 ইট কিনলেন। কারবারী আপনাকে কোন ইট দেয়নি। চুক্তিটা এই রকম যখন শুকনো সিজন আসবে দখন ইট ব্যবসায়ী আপনার ইট 2500 টাকায় হাজার বিক্রি করে আপনার টাকা আপনাকে রিটার্ন করলো। মাঝখানে একটি হালাল ব্যবসা করে ছয়মাসে 25% হারে লাভ পেলেন। তবে যারা পুজি সংগ্রহ করতে চান তাদের জন্য এটা ভালো রাস্তা। আপনি আপনার পন্যের দাম ধরে একজনের কাছে থেকে বিনিয়োগ নিলেন কথা থাকবে। 500 শাড়ি আপনার কাছে আপমি 800 টাকা দামে বিক্রি করলাম। এখন এই শাড়ি আমার এখানে দোকানে থাকবে। যখন শাড়ি বিক্রি হবে। আপনি 1000 টাকা দরে দাম পেয়ে যাবেন।
- রফিকের মা:
রফিকের মা নামক এক মহিলাকে আমরা দেখতাম ছোটবেলায় বিভিন্ন জিনিসপত্র ফেরী করতে। রফিকের মা দরিদ্র মহিলা ছিলেন। অনেক মাল একসাথে এনে বিক্রি করা তার পক্ষে সম্ভব হতো না। ফলে রফিকের মা যেকোনো জিনিস এক কপি করে বাড়ী বাড়ী যেতেন বৌ ঝিয়েদের কাছ থেকে অর্ডার নিতের কেউ আগাম দাম দিয়ে দিত কেউ দিতনা। রফিকের মা আবার 517 দিনর সময় নিয়ে নিতেন। বেশ কয়েকজনের অর্ডার জমলে গঞ্জে গিয়ে কিনে আনতেন আর বাড়ী বাড়ী পৌছে দিয়ে দাম নিয়ে নিতেন। আবার দোকানদারদের সাথে তার কথা থাকতো যে মাল যদি বিক্রি না হয় তাহলে ফেরত দিতে পারবে। শর্ত হলো পন্য নস্ট হতে পারবেনা।এভাবে অল্প পূজিতে এই বিধবা মহিলা একদিন তার ব্যবসাটা ঠিকই দাড় করিয়েছেণ।
5. মনাভাই:
মনাভাই স্বল্পআয়ের লোক ছোট চাকুরীতে চলেনা। তাই কিছু একটা করবেন বলে কলোনীর পাশে একটা দোকান নিলেন। যেদিন দোকান উদ্ভোধন হবে সেদিন আর মনা ভাইয়ের হাতে কোন টাকা পয়সা নেই। দোকানের সেলামী আর ডেকোরেশন মিলে সব টাকা খরচ হয়ে গেছে। এখন মাল তুলবেন সে টাকা তার হাতে নেই। মনভাই তার সহকর্মীদের দ্বারস্থ হলেন। কারো কাছে ২০০০ কারো ৫০০০ এভাবে ২০ ২৫ জনের কাছে ৫০-৬০ হাজার টাকা ধার করে মাল তুললেন। প্রায় বিকেলে বন্ধুরা মনভাইর দোকান তেমন চলছে তাই দেখতে আসে। মনাভাই মিস্টি কথা বলে তাদের কাছে তেল সাবান চিনি যার যা দরকার তা দিয়ে দেয়। তারপর খাতায় লিখে রাখে। মাস শেষে দেখা গেল বন্ধুদের অর্ধেক টাকাই তার পরিশোধ হয়ে গেছে মাল দিয়েই। এতে একদিকে লাভ হলো, দোকানে বেচাকেনাও হলো, দেনাতো শোধ হলোই। বাকী অর্ধেক দেনার জন্য মনা ভাই বন্থুদের বলল ভাই তোমাদের তো ডাল চাল লাগে তা সে তোমরা আমার দোকান থেকেই নাও। বন্ধুরা সায় দিলো। কিন্তু সবাই কি আর মানে আতিক ভাই আর শফিক ভাই কোনো মাল নিলনা বরং বলল ভাই টাকা লাগবে টাকা দাও অত কথা বুঝি না। কাশেম ভাই বলল ভাই যে টাকার মাল দিয়েছে বাকী টাকা দাও লাগলে আবার নিও। জামাল আর সবুজ বলল ঠিক আছে টাকা লাগলে আরো নাও। ইলিয়াছ আর ছায়েদসহ অন্যরা বলল ঠিক আছে বাকী টাকাও মাল দিয়ে শোধ দিও। মনাভাই বুদ্ধিমান লোক যারা টাকা ফেরত চাইলো ২/৩ দিনের মধ্যে সবার টাকা দিয়ে দিল। একদিকে মনাভাইর সুনামটাও থাকলো অন্যদিকে মনাভাইর ব্যবসাটাও দাড়ালো। গত ১৫ বছরে মনাভাইর দোকানটা এখন অনেক বড়ো হলো। ৩ জন কর্মচারী সব সময় কাজে করে। মনাভাইর বৌ বাচ্চা শহরে থাকে। বেড়িবার্র দিকে গত বছর ৪ কাঠা জমিও কিনেছেন আমাদের মনা ভােই। মনাভাই জিন্দাবাদ।
7,245 total views, 2 views today