প্রধানমন্ত্রী

ই-কমার্স সেক্টরের পরিধি বাড়ানোর জন্য কি কি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে?

 

১. প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উদ্যোক্তা তৈরী

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও আইসিটি বিভাগ ছাড়াও আন্তজাতিক সংস্থা She Trade, FNF এর সাথে যৌথ উদ্যোগে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে ই-কমার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ। এ যাবত ৫ হাজার তরুনকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। যাদের ৪০ শতাংশ নারী। এরা বেশীরভাগই উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে কেউ কেউ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থানের সুযোগ পেয়েছে।

 

২. মেলা ও প্রদর্শনীর মাধ্যমে আস্থা ও সচেতনতা বৃদ্ধি

ই-ক্যাব বাংলাদেশ ডাক বিভাগ ও মহিলা অধিদপ্তরের সাথে যৌথভাবে প্রতিবছর দেশের ৮টি বিভাগে ই-কমার্স মেলা আয়োজন করছে। এতে করে রাজধানীর বাইরে ই-কমার্সের ব্যপ্তিতে ভূমিকা রাখছে। চলতি বছর করোনার কারণে মেলা স্থগিত রয়েছে। তথাপি এবারের বাণিজ্য মেলা ভার্চুয়ালি আয়োজনের প্রস্তাব বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করেছে ই-ক্যাব। চলতি বছর ভার্চুয়াল ডিজিটাল ওয়াল্ডে প্রায় একশ এর মতো স্টল বরাদ্দ নিয়েছে ই-কমার্স সেক্টর।

 

৩. পণ্য ও সেবার পরিধি বৃদ্ধি

বর্তমানে দেশে ই-কমার্সের মাধ্যমে বেশী বিক্রি হচ্ছে গ্যাজেট, পোশাক ও বই। সাম্প্রতিক সময়ে করোনার কারণে নিত্যপণ্য এবং ইলেকট্রনিক্স সামগ্রীর বেচাবিক্রিও বেড়েছে। পণ্য ও সেবা বৃদ্ধির জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চলতি বছর ই-ক্যাবের সহযোগিতায় আয়োজন করে অনলাইন আমমেলা। এতে প্রায় ১৫২ হাজার কেজী আম বিক্রি হয়।। এছাড়া ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন এর সাথে যৌথ উদ্যোগে আয়োজন করে অনলাইন কুরবানি হাট। যাতে প্রান্তিক কৃষকের গরু বিক্রিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখে এই উদ্যোগ।

 

৪. অর্থ সংযোগ

ই-কমার্স সেক্টরে ব্যাংক ঋণ ও বিনিয়োগ প্রাপ্তিতে ব্যাপট ঘাটতি রয়েছে। তাই ই-ক্যাব বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাথে সংযোগ ঘটিয়ে অনলাইন উদ্যোক্তাদের জন্য ঋণ ও বিনিয়োগ এর সংকুলান করেছে। এর পরিমাণ কম হলেও। আর্থিক প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসায় এই সেক্টরে আশার সঞ্চার হয়েছে।

 

৫. উদ্যোগ সহজীকরণ

ইতোমধ্যে ই-ক্যাবের মেম্বারশিপ প্রক্রিয়া সহজিকরণ করা হয়েছে। যেকোনো উদ্যোক্তা দেশের যেকোনো অঞ্চলে বসে অনলাইনে আবেদন করে ই-ক্যাবের সদস্য হতে পারে। এছাড়া ট্রেড লাইসেন্স তালিকায় ই-কমার্স ক্যাটাগরি সংযুক্ত করা, কম খরচে ও সহজে ই-কমার্স ট্রেড লাইসেন্স প্রাপ্তির সুযোগ সংক্রান্ত ই-ক্যাবের একটি আবেদন বর্তমানে স্থানীয় সরকার মন্ত্রনালয়ে বিবেচনাধীন রয়েছে।

 

৬. দেশের প্রত্যন্ত অঞ্ছলে ই-কমার্সের ব্যাপ্তি

বাংলাদেশের ৭০ ভাগ মানুষ এখনো গ্রামে বসবাস করে। এবং আমাদের ভোগ্যপন্যের একটা বিরাট অংশ গ্রামে উৎপাদিত হয়। ফলে গ্রাম ও শহরের সংযোগ জরুরী। অনলাইনের মাধ্যমে এই সংযোগ ত্বরান্বিত হলে ই-কমার্স দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিস্তৃতি লাভ করবে। সেজন্য ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলা শহরে ই-ক্যাব সেমিনার ও কর্মশালার মাধ্যমে প্রান্তিক পর্যায়ে উদ্যোক্তা তৈরীতে কাজ করছে।

 

৭. সেবার মাধ্যমে আস্থা অর্জন

ঘরে ঘরে নিত্যপণ্য থেকে শুরু করে বিলাসী পণ্য সরবরাহ করছে অনলাইন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো। যাতে সময়মতো সঠিক পণ্য সঠিক দামে ক্রেতার কাছে পৌঁছতে পারে এজন্য ই-ক্যাব কাজ করছে। ই-ক্যাবের কার্যনির্বাহিী পরিষদ ক্রেটারিয়েট ও ১৬টি স্ট্যান্ডিং কমিটি ভিন্ন ভিন্ন সেক্টর নিয়ে কাজ করছে। একই সাথে সেবার মান ও দামসহ সার্বিক মান উন্নয়নে বাজারের উপর নজরদারীসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে।

 

৮. প্রচারণার মাধ্যমে বাজার বিস্তৃতি

প্রচারণারার মাধ্যমে ভোক্তাদেরকে সচেতন করা এবং উদ্যোক্তাদের অনুপ্রাণীত করার জন্য কাজ করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ই-ক্যাব। বিভিন্ন কর্মসূচী ভিত্তিক প্রমোশন ও প্রেস রিলিজ ছাড়াও করোনাকালীন সময়ে গৃহীত বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে যৌথ সংবাদ সম্মেলনেরও আয়োজন করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং ই-ক্যাব।

এছাড়া চলতিবছর করোনাকালীন সময়ে বাণিজ্য মন্ত্রনালয়ের অনুমতি ও সহযোগিতায় সারাদেশে নিত্যপন্যের সাপ্লাইচেইন সচল রাখতে কাজ করে ই-ক্যাব। এতে করে ই-কমার্সের প্রবৃদ্ধি স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় দ্বিগুন হচ্ছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। এ ব্যাপারে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমও বিস্তারিত প্রতিবেদন পেশ করেছে।

আরো যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন

১. ট্রেড লাইসেন্সে ই-কমার্স বিজনেস ক্যাটাগরি যুক্ত করতে হবে এবং স্বল্প ফিতে  ট্রেড লাইসেন্স করার সুযোগ থাকতে হবে। অনলাইন উদ্যোক্তাদের জন্য বাণিজ্যিক এলাকায় অফিস স্থাপন এবং বাড়ীভাড়ার বাধ্যকতা থাকা বাস্তবসম্মত হবেনা।

২. বৈদেশিক ব্যয়ের ক্ষেত্রে বর্তমানে অনলাইন উদ্যোক্তাগণ অনলাইনে বিজ্ঞাপন ও বুদ্ধিভিত্তিক পণ্যক্রয়ের ক্ষেত্রে বেসিস সদস্যদের ন্যায় কোনো সীমা ভোগ করতে পারছেনা। বর্তমানে এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাবনা বাংলাদেশ ব্যাংকে বিবেচনাধীন রয়েছে।

৩. বাংলাদেশ ডাক বিভাগের মাধ্যমে জেলা ভিত্তিক ওয়ার হাউজ স্থাপন করে। অনলাইন উদ্যোক্তাদের সেবাকে প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে দেয়ার একটি প্রস্তাব ই-ক্যাবের পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছে। উক্ত প্রস্তা্বটি বাস্তবায়িত হলে সেবার মান উন্নত হবে এবং ই-কমার্সের পরিধি বাড়বে।

৪. ক্রসবর্ডার ই-কমার্সের ক্ষেত্রে পণ্য শিপমেন্ট প্রক্রিয়া, শিপমেন্ট খরচ ক্রস বর্ডার ই-কমার্সের মাধ্যমে প্রেরিত পণ্যকে রফতানী পন্যের আওতায় বিবেচনা করা জরুরী হয়ে পড়েছে। এটা না হলে ক্রস বর্ডার ই-কমার্সখাতে বিদ্যমান ৭৪% প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা সম্ভব হবে না।

 

২. বৈদেশিক বিনিয়োগ

যেহেতু ই-কমার্স একটি ক্রমবিকাশমান খাত তাই এই খাতে বিদেশী বিনিয়োগের সুযোগ ও পরিধি দিন দিন বেড়ে চলেছে। শুধু বিদেশী বিনিয়োগ নয় এই খাতে দেশী বিনিয়োগও এখনো পর্যাপ্ত নয়। বিশেষ করে সাপ্লাইচেইন উন্নয়ন ও গ্রামীণ পণ্য শহরে ভোক্তাদের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় লজিস্টিক অবকাঠামো উন্নয়ন প্রয়োজন। এজন্য এই খাতে ব্যাপক সরকারী বেসরকারী ও বিদেশী বিনিয়োগ প্রয়োজন। যেমন-

১. এখনো প্রত্যন্ত অঞ্চলে পন্য ডেলিভারী দিতে পারবে এরকম কোনো সাপ্লাইচেইন গড়ে উঠেনি।

২. এখনো গ্রামের কৃষকের পণ্য শহুরে ক্রেতাদের কাছে পৌঁছে দেবে এমন কোনো বৃহদাকার প্লাটফরম গড়ে উঠেনি।

৩. এখনো গ্রামীণ নারীদের হস্তশিল্প ও কুটির শিল্পের পণ্য বিক্রির আলাদা, একক ও স্বয়ং সম্পূর্ণ কোনো  মার্কেটপ্লেস গড়ে উঠেনি।

৪. অনলাইন পেমেন্ট নিয়ে ক্রেতাদের আস্থা বাড়াতে SCROW সিস্টেম চালু হয়নি।

সূতরাং, এসব বিষয়ে দেশী ও বিদেশী বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু কোন খাতে বিদেশী বিনিয়োগ দেশের স্বার্থকে অক্ষুন্ন রাখবে সে বিষয়ে সুনিদিষ্ট নীতিমালা বা নির্দেশনা প্রয়োজন।

বর্তমান বৈদেশিক বিনিয়োগের নীতিমালার ক্ষেত্রে ই-ক্যাব দেশের স্বার্থ ও দেশীয় উদ্যোক্তাদের কথা বিবেচনা করে নিন্মলিখিত প্রস্তাব পেশ করে আসছে। কারণ বর্তমান নীতিমালায় দেশীয় উদ্যোক্তাদের স্বার্থ রক্ষা করা হয়নি বরং শর্তবিহীন বিদেশী বিনিয়োগ এর অনুমতি দেয়া হয়েছে। তাই এই মুহুর্তে শর্ত বা নীতিমালা পরিবর্তন না করলে যেকোনো বিদেশী বিনিয়োগ স্থানীয় উদ্যোক্তাদের জন্য হুমকি তৈরী হয়েছে।

আমরা জানি বিদেশী বিনিয়োগ দেশে ৪ ভাবে হতে পারে।

ক. দেশীয় প্রতিষ্ঠানকে বিদেশী প্রতিষ্ঠান ক্রয় করতে পারে।

খ. বিদেশী প্রতিষ্ঠান সরাসরি বিদেশী ব্রান্ড নামে দেশে ব্যবসা চালু করতে পারে।

গ. বিদেশী বিনিয়োগকারী সরাসরি দেশে কোনো কোম্পানী খুলতে পারে।

ঘ. দেশীয় প্রতিষ্ঠানে বিদেশী বিনিয়োগকারী আংশিক বিনিয়োগ করতে পারে।

বর্তমানে বিদেশী বিনিয়োগ উন্মুক্ত থাকায় ক,খ ও গ উপায়ে বিদেশী বিনিয়োগ হচ্ছে এতে করে দেশীয় উদ্যোক্তারা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে।

প্রথমত, তারা বিদেশী মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের সাথে অসম প্রতিযোগিতার মুখোমুখী হচ্ছে।

দ্বিতীয়ত, ব্যবসার ক্ষেত্রে ঝুঁকি বেড়ে গেছে ফলে তারা দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারছেনা।

তৃতীয়ত, তারা যখন বিনিয়োগ পাওয়ার জন্য দেশী বিদেশী বিনিয়োগকারীদের শরনাপন্ন হচ্ছে তখন তারা অসম প্রতিযোগিতার কারণে বিনিয়োগকারীরকে আস্থার জায়গা দেখাতে পারছেনা।

চতুর্থত: দেশীয় ক্ষুদ্র মাঝারী প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে কাজ শিখে কর্মীরা বিদেশী মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে চলে যাচ্ছে। ফলে ছোট প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তারা সাময়িক সমস্যায় পড়ছে।

বর্তমানে ২০০ থেকে ৫০০ ক্ষুদ্র উদ্যোগ দেশী বিদেশী বিনিয়োগ পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু ইতোমধ্যে বৃহৎ প্রতিষ্ঠানে বিদেশী বিনিয়োগ আসায় তাদের সাথে প্রতিযোগিতায় ক্ষুদ্র উদ্যোগগুলো বিকাশের পথ বাধাগ্রস্থ হচ্ছে।

 

 

এছাড়া, ই-ক্যাবের আরো প্রস্তাব রয়েছে যে, বিদেশী কোম্পানীসমূহ যখন তাদের বাংলাদেশী ই-কমার্স বা মার্কেটপ্লেস এর জন্য ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে বিজ্ঞাপন প্রদান করবে। তখন সেটা অবশ্যই বাংলাদেশী মুদ্রায় এবং বাংলাদেশী এজেন্সির মাধ্যমে প্রদান করার বিধান থাকতে হবে। এই বিধান না থাকলে সরকার বড়ো অংকের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হবে। ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রির প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন হিসেবে ই-ক্যাব দেশীয় উদ্যোক্তা ও ইন্ডাস্ট্রির বৃহত্তর স্বার্থের বিষয়ে সর্বদা সজাগ রয়েছে।

-জাহাঙ্গীর আলম শোভন

1,547 total views, 2 views today

Comments

comments