এটি আলিবাবা সিরিজের তৃতীয় এবং শেষ পোস্ট। এর আগের পোস্টে আমি আলিবাবা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা জ্যাক মা এর জীবন সম্পর্কে লিখেছিলাম। আলিবাবা এখন চীনের সবচেয়ে বড় এবং সফল ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান কিন্তু এ সাফল্য নিয়ে চুপচাপ বসে নেই প্রতিষ্ঠানটি। চীনে নিজের অবস্থানকে কিভাবে আরো শক্তিশালী করে তোলা যায় এবং একই সাথে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নিজেদের ব্যবসা বিস্তার করা যায় সে লক্ষ্য নিয়ে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে আলিবাবা গ্রুপ।

আলিবাবা গ্রুপের নতুন প্রেসিডেন্ট মাইকেল ইভান্স:

Michael-Evans_portrait1

এ বছরের আগস্টে আলিবাবা গ্রুপ মাইকেল ইভান্সকে তাদের নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা দেয়। আগস্টের ৪ তারিখে মাইকেল ইভান্সকে সিইও ঘোষণা করা হয়। গতবছরের সেপ্টেম্বর থেকে ইভান্স আলিবাবা গ্রুপের ম্যানেজমেন্ট বোর্ডের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ইভান্স এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কিং ফার্ম গোল্ডম্যান স্যাক্স গ্রুপে ২০ বছর ধরে কর্মরত ছিলেন। তিনি গোল্ডম্যানের গ্লোবাল গ্রোথ মার্কেট এর প্রধান এবং গোল্ডম্যান এশিয়ার প্রধান হিসেবে ছিলেন।

লাভ বেড়েছে আলিবাবা গ্রুপের :  

অক্টোবর ৮, ২০১৫ তারিখে আলিবাবা গ্রুপ তাদের ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে আলিবাবা নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জে তাদের প্রাথমিক গণ-প্রস্তাবনা ছাড়ার পরে এটাই তাদের প্রথম ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্ট।

২০১৫ অর্থ বছরে আলিবাবা গ্রুপ আয় করেছে ১২.২৯ বিলিয়ন ডলার যা গত অর্থবছরের তুলনায় ৪৫.১৪% বেশি। নেট প্রফিট হয়েছে ৩.৯২ বিলিয়ন ডলার যা গত বছরের তুলনায় ৩.৯২% বেশি।

2

আলিবাবা গ্রুপ তাদের তাওবাও এবং টি-মল মার্কেটপ্লেসের মাধ্যমে ৩৯৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য বিক্রী করেছে। প্রতিষ্ঠানটির বর্তমানে ৩৫০ মিলিয়ন ক্রেতা আছে যার মধ্যে ২৮৯ মিলিয়ন মোবাইল ডিভাইস ব্যবহার করে পণ্য ক্রয় করে থাকে।

1

রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে যে, ২০১৩ সালে বিশ্বের বৃহত্তম ই-কমার্স বাজার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে প্রথম স্থানটি দখল করেছে চীন। এ বছরে দেশটির ই-কমার্স বাজারের আকার বৃদ্ধি পেয়ে ৬২৭ বিলিয়ন ডলার হবে অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ই-কমার্স বাজারের আকার হবে ৩৪৯ বিলিয়ন ডলার।

রিপোর্টটি ডাউনলোড করতে চাইলে এ লিঙ্কে ভিজিট করুন:

http://ar.alibabagroup.com/2015/assets/pdf/20-F.PDF

ইউরোপে আলিবাবার ব্যবসা প্রসার এবং যুক্তরাষ্ট্রে আলি-ক্লাউডের নতুন ডাটা সেন্টার চালু: 

আগামী কয়েক মাসের মধ্যে ফ্রান্স, ইতালি এবং জার্মানিতে আলিবাবা ব্যবসা শুরু করবে।

আলিবাবার ক্লাউড সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান আলি-ক্লাউড ক্যালিফোর্নিয়াতে আরেকটি ডাটা সেন্টার চালু করেছে। আলি-ক্লাউডের মূল মার্কেট চীন কিন্তু এ বছরের শুরুতে প্রতিষ্ঠানটি আন্তর্জাতিক ক্লাউড বাজারে প্রবেশ করে এবং যুক্তরাষ্ট্রে তাদের প্রথম ডাটা সেন্টার চালু করে। অক্টোবর ১২, ২০১৫ তারিখ থেকে নতুন এ ডাটা সেন্টারটি পুরোদমে চালু করা হয়। বিশ্ব জুড়ে এটি আলি-ক্লাউডের নবম ডাটা সেন্টার এবং এ বছরে ঘোষিত চতুর্থ ডাটা-সেন্টার।  এ বছরের মার্চেই আলি-ক্লাউড সিলিকন ভ্যালিতে একটি ডাটা সেন্টার চালু করে। উক্ত ডাটা সেন্টারকে ব্যাক-আপ প্রদানের জন্যে নতুন এ সেন্টার নির্মাণ করা হয়েছে। আগামী তিন-থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত আলি-ক্লাউড  ‍ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে ক্লাউড এবং বিগ-ডাটা ভিত্তিক সেবা প্রদান করবে।

আলিবাবা ডিফাইণ্ড:

আলিবাবা গ্রুপ তাদের ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্ট প্রকাশ করার সাথে সাথে একই দিনে একটি নতুন সেবা চালু করে। বিশ্বের অনেক দেশের লোক আলিবাবা সম্পর্কে জানলেও তাদের ব্যবসা সম্পর্কে অতটা বিশদভাবে জানে না। তাদের কথা মাথায় রেখেই এ নতুন সেবাটি চালু করা হয়েছে। এখানে আলিবাবা গ্রুপের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, সহ নানা ধরণের তথ্য জানা যাবে।

এছাড়াও কেউ যদি চীনের ব্যবসা, অর্থনীতি সম্পর্কেও জানতে পারবেন কারণ আলিবাবার ব্যবসার প্রধান কেন্দ্র হচ্ছে চীন এবং আলিবাবার ব্যবসাকে ভালভাবে বুঝতে হলে চীনের ব্যবসা এবং অর্থনীতিকেও ভালভাবে বুঝতে হবে।

ওয়েবসাইটটির লিঙ্ক: http://ar.alibabagroup.com/2015/index.html#CrossBorder

আলিবাবার ডিজিটাল কন্টেন্ট ব্যবসা:

চীনের সিনেমা খুবই বড় এবং দ্রুত বর্ধনশীল একটি ইণ্ডাস্ট্রি। তাই সিনেমা দর্শকদের জন্যে নতুন সেবা চালু করতে যাচ্ছে আলিবাবা গ্রুপ। সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটি বেইজিং এর ক্যাপিটাল সিনেমা চেইন এর সঙ্গে পার্টনারশিপ করার ঘোষণা দিয়েছে। গত মাস থেকে আলিবাবা নতুন সিস্টেম চালু করে যার মাধ্যমে একজন সিনেমা দর্শক তার টিকেট আরেক দর্শকের সাথে বিনিময় করতে পারবে। শুধু তাই নয়, দর্শক চাইলে তার টিকিট ফেরত দিয়ে টাকাও রিফাণ্ড করতে পারবেন।

ধরা যাক, আগামী মঙ্গলবার গডজিলা ছবিটি মুক্তি পাবে এবং আপনি টিকেট কিনেছেন। আপনি গডজিলা দেখতে চান না আপনি আশিকী দেখতে চান তখন আপনি আরেক দর্শকের সাথে টিকেট বিনিময় করতে পারবেন।

যে কোন ছবি হলে দেখানোর নূন্যতম ২৪ ঘন্টা আগে ক্রেতাকে রিফাণ্ডের জন্যে তার টিকেট ফেরত দিতে হবে এবং টিকেট পরিবর্তন করে নতুন টিকেট নিতে হলে নূন্যতম তিনঘন্টা আগে তা করতে হবে।

আলিবাবার সফটওয়্যার বিভাগ গুয়াংডং ইয়ুএকে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং কো.  নতুন সফটওয়্যার তৈরি করেছে। এর মাধ্যমে হলে ঢোকার সময়ে দর্শকরা তাদের স্মার্টফোন দেখালেই হয়ে যাবে। এ সফটওয়্যারের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরণের তথ্য বিশ্লেষণ করে সিনেমা হলগুলো দর্শকদের পছন্দ সম্পর্কে আরো বিশদ জানতে পারবে।

এছাড়াও চীনের অন্যতম জনপ্রিয় অনলাইন ভিডিও ওয়েবসাইট ইয়ুকু তুডো (Youku Tudou) কে ৩.৬ বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে কিনে নিতে যাচ্ছে আলিবাবা। ইয়ুকু তুডোর প্রতিষ্ঠাতা শেয়ার হোল্ডাররা ইতিমধ্যেই সম্মতি প্রদান করেছেন এ ব্যাপারে। চুক্তি মতে আলিবাবা ইয়ুকু তুডোর শেয়ার ২৬ ডলারে ক্রয় করবে। প্রতিমাসে ৫০ কোটি লোক ইয়ুকু তুডোতে ভিডিও উপভোগ করে থাকে। প্রতিষ্ঠানটি গত বছর এবং এ বছরের প্রথমার্ধে ব্যবসায় লাভ করতে পারে নি। কিন্তু তারপরেও আলিবাবা ইয়ুকু তুডো কিনতে চায় কারণ এর জনপ্রিয়তা।

চাইনিজ সিঙ্গলস ডে গ্লোবাল শপিং ফেস্টিভ্যাল        

নভেম্বরে অনুষ্ঠিত হবে চাইনিজ সিঙ্গলস ডে গ্লোবাল শপিং ফেস্টিভ্যাল যা কিনা বিশ্বের বৃহত্তম অনলাইন শপিং ফেস্টিভ্যাল। এ উপলক্ষে অক্টোবর ১৩, ২০১৫ তারিখে আলিবাবা গ্রুপের হাং ঝু হেডকোয়ার্টারে একটি লঞ্চিং সেরেমণি আয়োজিত হয়। ২০০৯ সাল থেকে আলিবাবা ১১.১১ গ্লোবাল শপিং ফেস্টিভ্যাল উদযাপন করে আসছে। আলিবাবা গ্রুপের বর্তমান সিইও ড্যানিয়েল ঝাং এ ফেস্টিভ্যাল চালু করেন। তখন তিনি আলিবাবা গ্রুপের অন্যতম জনপ্রিয় অনলাইন মার্কেটপ্লেস টি-মল এর দায়িত্ব পালন করছিলেন। ১১.১১ গ্লোবাল শপিং ফেস্টিভ্যাল বিশ্বের বৃহত্তম ২৪ ঘন্টাব্যাপী অনলাইন সেলস উৎসব। পশ্চিমা বিশ্বে ব্ল্যাক ফ্রাইডে (Black Friday) এবং সাইবার মণডে (Cyber Monday) তে সবচেয়ে বেশি অনলাইন সেলস হয়ে থাকে। সাইবার মণডে এবং ব্ল্যাক ফ্রাইডে এর মিলিত সেলস থেকেও বেশি অনলাইন সেল হয় ১১.১১ গ্লোবাল শপিং ফেস্টিভ্যালে। গত বছরে চাইনিজ সিঙ্গলস ডে গ্লোবাল শপিং ফেস্টিভ্যালে মাত্র একদিনেই ৯.৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য বিক্রী হয়।

table-cbn

২০১৫ ১১.১১ শপিং ফেস্টিভ্যাল এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ব্র্যাণ্ডগুলোকে আলিবাবার ওয়েবসাইটে আকর্ষণ করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে আলিবাবা। যে কোন আন্তর্জাতিক ব্র্যাণ্ড চীনে তাদের পণ্য বিক্রী করতে চাইলে আলিবাবা হবে “Gateway to China।।” এটাই এ অনুষ্ঠান আয়োজনের মূল লক্ষ্য। ৩৯টি দেশের প্রতিনিধি, ৪০টির বেশি আন্তর্জাতিক ব্র্যাণ্ড এবং প্রায় ৩০টি ফ্রেশফুড অ্যাসোসিয়েশন এ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবে। এ বছরের ফেস্টিভ্যালে মূল থিম সমূহ হলো- গ্লোবালাইজেশন, লজিস্টিক্স, মোবাইল, এবং ওমনি-চ্যানেল। আলিবাবা গ্রুপের নির্বাহী চেয়ারম্যান জ্যাক মা, প্রধান নির্বাহী ড্যানিয়েল ঝাং এবং প্রেসিডেন্ট মাইকেল ইভান্স এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন।

১১.১১ গ্লোবাল শপিং ফেস্টিভ্যাল সম্পর্কে জ্যাক মা বলেন যে বর্তমানে চীনে ৩০ কোটি মধ্যবিত্ত আছে এবং আগামী ১০-১৫ বছরে এ সংখ্যা বেড়ে ৫০ কোটিতে পৌছাবে। চীনের এ মধ্যবিত্ত ভোক্তারা শুধু চীনের অর্থনীতি নয় বরং বিশ্ব অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকা শক্তি হয়ে উঠবে।

ড্যানিয়েল ঝাং সাংবাদিকদের বলেন যে বিগত ছয় বছরে ১১.১১ সেলস ইভেন্ট অনলাইন শপিং এর একটি মার্কেটিং ইভেন্ট থেকে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ এবং জনপ্রিয় অনলাইন শপিং ইভেন্ট হয়ে উঠেছে। এ ইভেন্ট বিশ্বের কাছে আলিবাবার সফলতা এবং এর বিশাল ব্যবসাকে তুলে ধরবে।

সূত্র:

বিজনেস ওয়্যার (১)

বিজনেস ওয়্যার(২)

মার্কেট ওয়াচ

চায়না বিজনেস নিউজ

ভেঞ্চার বিট

জিবি টাইমস

আলিজিলা

বিজনেস স্পেকটেটর

ইবাদা ডট কম

সিসিটিভি ইংলিশ

আগের দুটি পোস্টের লিঙ্ক:

http://blog.e-cab.net/আলিবাবা-গ্রুপ-১/

http://blog.e-cab.net/আলিবাবা-গ্রুপ-২-প্রতিষ্ঠ/

লেখক: এস এম মেহদী হাসান

8,010 total views, 3 views today

Comments

comments